ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সারা দেশের মতো দিনাজপুর-৪ (খানসামা-চিরিরবন্দর) আসনেও বইছে ভোটের হাওয়া। দীর্ঘদিন পর অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রত্যাশায় জনগণের মধ্যে আগ্রহ ও উদ্দীপনা বেড়েছে বহুগুণ। গ্রামাঞ্চল থেকে হাটবাজার, সামাজিক অনুষ্ঠান—সর্বত্রই এখন আলোচনার বিষয়বস্তু ভোট। এ আসনে আলোচনার কেন্দ্রে আছে বিএনপির ধানের শীষ এবং জামায়াতে ইসলামীর দাঁড়িপাল্লা প্রতীক। ঐতিহাসিকভাবে আসনটিতে বিএনপির জনপ্রিয়তা থাকলেও এবার তাদের সামনে চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে জামায়াত। তবে আসনটিতে সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয় বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল, যা ক্রমেই ধানের শীষের মাঠ জটিল করছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
জানা গেছে, দিনাজপুর-৪ আসনে জামায়াত বেশ গোছালো এবং দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে নেমেছে। কেন্দ্রীয়ভাবে মনোনয়ন পাওয়া সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও জেলা জামায়াতের সাবেক আমির আফতাব উদ্দিন মোল্লা টানা আট মাস ধরে নিয়মিত গণসংযোগ করছেন। হাটবাজার, পথসভা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদভিত্তিক আলোচনা—সবখানেই তার উপস্থিতি দৃশ্যমান। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও দলটির নেতাকর্মীরা প্রচারে সক্রিয়।
স্থানীয়দের মতে, দীর্ঘ দমনপীড়ন পেরিয়ে দলটি আবার শক্ত কাঠামো গড়ে তুলেছে। কয়েকজন সাবেক আওয়ামী লীগকর্মীর জামায়াতে যোগদান নিয়ে কিছু বিতর্ক তৈরি হলেও মাঠপর্যায়ে তার কোনো প্রভাব পড়েনি।
অন্যদিকে ঐতিহাসিকভাবে বিএনপি এ আসনে শক্তিশালী দল। সংগঠন, জনসম্পৃক্ততা ও মাঠের রাজনীতিতে দলটির অবস্থান সবসময়ই দৃঢ়। এবারো সাবেক সংসদ সদস্য আখতারুজ্জামান মিয়া মনোনয়ন পাওয়ায় এ শক্তি আরো গতিশীল হয়েছে। মনোনয়ন পাওয়ার পর থেকে তিনি নিয়মিত পথসভা, উঠান বৈঠক ও গণসংযোগ করছেন। ২০০১ সালে ব্যাপক জনপ্রিয়তা নিয়ে এমপি নির্বাচিত হওয়া আখতারুজ্জামান দীর্ঘদিন আন্দোলন-সংগ্রামেও নেতৃত্ব দিয়েছেন। নাশকতার মিথ্যা মামলায় কারাবন্দি হওয়ার ঘটনাও তাকে বিএনপি সমর্থকদের মাঝে বেশি গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে।
মনোনয়ন ঘোষণার পর দুই উপজেলায় নিয়মিত পথসভা, উঠান বৈঠক, গণসংযোগ ও পেশাজীবীদের নিয়ে বৈঠক করছেন তিনি। কিন্তু এই শক্তিশালী প্রস্তুতির মাঝেই প্রকাশ্যে আসে দলটির অন্তর্দ্বন্দ্ব। মনোনয়ন ঘোষণার পর থেকেই দলের ভেতর থেকে উঠতে থাকে নানান বিরূপ প্রতিক্রিয়া, যা দ্রুত প্রকাশ্য রূপ নেয়।
গত ১৬ নভেম্বর খানসামায় মনোনয়ন পরিবর্তনের দাবিতে শোভাযাত্রা, মৌন মিছিল ও মতবিনিময় সভা করেন মনোনয়নপ্রত্যাশী অ্যাডভোকেট আবদুল হালিম এবং কর্নেল (অব.) মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী। ঘটনাটি স্থানীয় রাজনীতিতে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি করে এবং সাধারণ নেতাকর্মীদের মাঝেও প্রশ্ন ওঠে—দলের ভেতরে বিভাজন চললে নির্বাচনি লড়াইয়ে কতটা শক্তভাবে লড়তে পারবে বিএনপি।
এরপর ১৯ নভেম্বর দিনাজপুর প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে এ দুই নেতা বর্তমান প্রার্থীর গ্রহণযোগ্যতা ও তৃণমূলের মতামত উপেক্ষার বিষয়ে প্রশ্ন তোলেন। তাদের অভিযোগ, ভোটারদের প্রত্যাশা বিবেচনায় না নিয়ে প্রার্থী বাছাই করায় তৃণমূলে বিভক্তি বাড়ছে। এটি নির্বাচনি প্রস্তুতিকে দুর্বল করছে বলেও দাবি করেন তারা। অভ্যন্তরীণ এই অস্থিরতা এখন বিএনপির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
বিএনপির কোন্দল তীব্র আকার ধারণ করায় সুবিধা পাচ্ছে জামায়াত। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপি দ্রুত অভ্যন্তরীণ সংকট নিরসন
করতে না পারলে সরাসরি লাভবান হবে জামায়াত। দলটি ইতোমধ্যে শক্তিশালী সংগঠন ও তৃণমূলভিত্তিক প্রচারের কারণে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আরো সক্ষম হয়ে
উঠেছে। কারণ, গত কয়েক মাসে নিজেদের যে সংগঠিত কাঠামো ও মাঠের প্রস্তুতি তৈরি করেছে জামায়াত, তাতে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠার জন্য দলটি এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি প্রস্তুত।
আসনটিতে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ (চরমোনাই), জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও গণঅধিকার পরিষদও মাঠে সক্রিয়। এনসিপির সম্ভাব্য তিন প্রার্থী শাপলা প্রতীকে প্রচার চালাচ্ছেন। তবে মাঠের রাজনীতিতে তাদের বেশি গুরুত্ব নেই।
জামায়াতে ইসলামী মনোনীত প্রার্থী আফতাব উদ্দিন মোল্লা আমার দেশকে জানান, দুই দফা উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হওয়ার অভিজ্ঞতা এবং জুলাই বিপ্লবপরবর্তী জনমতের পরিবর্তন তাদের আশা দেখাচ্ছে। তিনি দাবি করেন, মাঠে যে সাড়া পাওয়া যাচ্ছে, তাতে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তাদের বিজয় প্রায় নিশ্চিত।
প্রাথমিকভবে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী আখতারুজ্জামান মিয়া আমার দেশকে বলেন, আমি গত দুই মাস ধরে নির্বাচনি এলাকায় নিয়মিত গণসংযোগ ও প্রচার চালিয়ে যাচ্ছি। দলের মহাসচিব নিজেও আমার উঠান বৈঠক ও গণসংযোগে উপস্থিত ছিলেন, যা তৃণমূলে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। আমি বিশ্বাস করি, সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে ধানের শীষের বিজয় নিশ্চিত।
অন্যদিকে বিএনপির প্রার্থী হতে চাওয়া কর্নেল (অব.) মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী আমার দেশকে বলেন, মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় তৃণমূলের মতামত উপেক্ষিত হয়েছে। আমরা চাই জনগণের প্রত্যাশার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রার্থী বাছাই করা হোক।
স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার প্রশ্নে তিনি বলেন, এখনো চূড়ান্ত মনোনয়ন হয়নি। আগে দলের সিদ্ধান্ত দেখব। বিএনপির কর্মী হিসেবে দলীয় সিদ্ধান্তই মেনে নেব।
তবে তিনি মাঠের বাস্তবতা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, তৃণমূল, সাধারণ কর্মী এবং সংখ্যালঘুরা বর্তমান প্রার্থীকে গ্রহণ করবে না। আখতারুজ্জামান মিয়ার বিরুদ্ধে সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। এমন প্রার্থীর পক্ষে ভোট চাইলে জনগণ নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখাবে, আমাকেও গ্রহণ না করতে পারে।
তিনি আরো বলেন, ব্যক্তিগত মতানৈক্য থাকলেও দলের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তই আমাদের জন্য শেষ কথা।
বর্তমান পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বড় যে চিত্র স্পষ্ট, সেটি হলো—বিএনপি ঐক্যবদ্ধ থাকতে না পারলে
এবং ভেতরের বিভাজন দূর করতে ব্যর্থ হলে সে সুযোগ দক্ষভাবে কাজে
লাগাতে পারে জামায়াত। শেষমেশ দিনাজপুর-৪ আসনে প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে—বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল কি ধানের শীষের শক্ত অবস্থান নড়বড়ে করে দেবে, নাকি এ বিভেদই জামায়াতকে এগিয়ে নিয়ে বড় লড়াইয়ের মুখোমুখি দাঁড় করাবে।


বরগুনা-১ আসনে নির্বাচনি প্রচারে ব্যস্ত প্রার্থীরা
গুমের নির্দেশ দিতেন হাসিনা, বাস্তবায়ন করতেন তারিক সিদ্দিক