চূড়ান্তভাবে যেদিন লোকটা আমার কাছে এলো, সেদিন আমার আর কিছুই করার ছিল না।
আমি তখন সবে দুপুরের খাবার খেতে প্লেটটা নিয়ে বসেছি, তখনই আমার কাচের গ্লাসে খট-খট শব্দ। ডোরবেলের সুইচ টিপে ইশারা দিতেই ভেতরে ঢুকল আমার পিএস রাসেল—‘স্যার, একজন আসছে দেখা করতে।’
অন্য সময় হলে খাবার প্লেটটা সরিয়ে তখনই ভেতরে নিয়ে আসতে বলতাম। কারণ সাইকিয়াট্রিস্ট হিসেবে চেম্বার খুলে এতদিনেও তেমন একটা পয়সাকড়ি করতে পারিনি। আমারই অত পসার নেই, নাকি ইদানীং সবার মানসিক সমস্যা ‘নাই’ হয়ে গেছে আমি জানি না। তবে এই খরা এখন অনেকটাই কেটে গেছে। একের পর এক সহিংসতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা—সবকিছু মিলিয়ে আবার মানুষ ট্রমায় পড়তে শুরু করেছে, আমার চেম্বারেও নিয়মিত লোকজন আসছে মানসিক চিকিৎসা নিতে। তাই একজন এলেই এত পাত্তা দেওয়ার কিছু নেই, রাসেলকে বললাম, ‘বসতে বলো, খেয়ে নিই আগে।’
খেতে খেতে মাউসে ক্লিক করে বাইরের সিসিটিভি একবার দেখে নিলাম। লুকিয়ে লুকিয়ে মানুষকে এভাবে পরখ করতে আমার বেশ আনন্দ লাগে। মাথায় চুল নেই, এরকম একটা লোক অপেক্ষা করছে। বাংলাদেশিরা বুকপকেটে সেভাবে কিছু রাখেন না, কিন্তু তার বুকপকেটটা ফুলে আছে। একটু পর দেখলাম বুকপকেট থেকে একটা রুমাল বের করে টেকো মাথা মুছে আবার পকেটে রেখে দিলেন। এভাবেই একটু পরপর করছেন। এসির ভেতর টেকো মাথায় ঘাম জমছে কী করে?
খাওয়া শেষে আসতে বললাম লোকটাকে। সিসিটিভিতে যেমন দেখেছিলাম, ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে একটু বেশি লম্বা মনে হলো এবং সামনে থেকে বয়সে অনেক বেশি তরুণ মনে হলো। আমার থেকে অন্তত দশ বছরের কম হবে। চেয়ারে বসার সঙ্গে সঙ্গেই আমি বললাম, ‘ভাই, আপনার কী সমস্যা বলেন তো আমাকে।’
‘আমার মা মারা গেছেন,’ বলল লোকটা।
আমি একটু নড়েচড়ে বসলাম। কারও মা মারা গেছেন, এটা কোনো সমস্যা হতে পারে না। এক সেকেন্ড ভেবে মনে হলো, নাহ্ এটাই তো জীবনের সবচেয়ে বড় সমস্যা। আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম, মায়ের কথা মনে পড়ল। ভেবে রাখলাম, এই রোগী দেখা শেষ হলেই মাকে কল করব।
‘সরি, আপনার মা নিশ্চয়ই শান্তিতে আছেন,’ বললাম আমি। কবরের আজাব মাফ হয়ে যাক বলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু লোকটা যদি অমুসলিম হয়! তাই আর রিস্ক নিলাম না। ‘আপনার মা কতদিন হলো মারা গেছেন?’ কথা চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম আমি।
‘বাস্তবে মারা যাননি।’
‘তাহলে?’ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করি আমি।
‘আমার মা বেঁচে আছেন, কিন্তু আমি স্বপ্নে দেখেছি আমার মা অলরেডি মারা গেছেন।’
‘স্বপ্নের ভেতর ঠিক কী কী দেখেন? একই স্বপ্ন বারবার দেখেন, নাকি প্রতিবার আলাদা স্বপ্ন দেখেন? আমাকে ঠিকঠাক খুলে বলুন,’ আস্তে আস্তে কথা চালিয়ে যাচ্ছি আমি।
‘আমার মা’কে নিয়ে দুই সপ্তাহ ধরে আমি বাজে স্বপ্ন দেখছি। আরো স্পেসিফিকভাবে বললে, তার মৃত্যুর স্বপ্ন দেখছি। প্রতিবারই ভিন্ন স্বপ্ন দেখি এবং স্বপ্নগুলো এরকম যেন আগের স্বপ্ন যেখানটায় শেষ হয়েছিল, তার পর থেকে পরের স্বপ্ন দেখছি। অনেকটা ক্রোনোলজির মতো,’ পকেট থেকে রুমাল বের করে মাথাটা মুছে নিল লোকটা।
আমি ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে আছি। আমার মাথার ভেতর অনেকগুলো হিসেব ঘুরছে। স্বপ্নে মায়ের মৃত্যু দেখা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। কাছের মানুষ হারানোর ভয় থেকেই এই স্বপ্নের উৎপত্তি। অনেক সময় মা অসুস্থ হওয়ার কারণে মায়ের মৃত্যু স্বপ্নে দেখা যেতে পারে। কিন্তু সেগুলো নিশ্চয়ই ক্রোনোলজিকালি স্বপ্ন হওয়ার কথা নয়। স্বপ্নগুলো শুনলে ভালোভাবে বোঝা যেতে পারে।
‘স্বপ্নগুলো ছোট হয়, কিন্তু খুবই ডিটেল। যেমন প্রথম দিকের স্বপ্নগুলো হতো মৃত্যুশয্যায় মা শুয়ে আছেন। আমি ও আমার ভাইয়েরা তার শিয়রে আতঙ্কিত মুখ নিয়ে বসে আছি। পরে হয়তো স্বপ্নে দেখতাম মায়ের হেঁচকি উঠছে, আমি পানি নেওয়ার জন্য দৌড়ে যাচ্ছি। এভাবে আস্তে আস্তে একটা স্বপ্নে দেখলাম, মা মারা গেছেন।’
আমি বিষয়টা চট করে ধরতে পারলাম। এটাকে ডিলিউশন বলা ঠিক হবে কি না জানি না। মূলত ভেতরে ভ্রান্ত একটা ধারণা পুষে বেড়াচ্ছেন লোকটা, বাস্তবে যার কোনো অস্তিত্ব নেই। যদিও তার মা বাস্তবে সুস্থ এবং মৃত্যু হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই, কিন্তু স্বপ্নে তিনি দেখছেন তার মা মারা যাচ্ছেন। হয়তোবা তার ভেতরে অন্য কোনো ভয় সুপ্ত অবস্থায় রয়েছে, যেটি ধীরে ধীরে স্বপ্নের মাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। এতে করে স্বপ্নে তার মা মারা গেলেও বাস্তব মনোজগতেও প্রভাব ফেলছে। খুব জটিল কিছু নয়, আবার খুব স্বাভাবিক ঘটনাও নয়।
আমি তাকে প্রয়োজনীয় কিছু ওষুধ লিখে দিলাম। আমি ভেবেছিলাম, অভ্যাসের পরিবর্তন করতে পারলে আর নিয়মিত ওষুধ খেলে মানসিক রোগটা সেরে যাবে। কিন্তু তা ঘটল না। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই তিনি উপস্থিত হতে শুরু করলেন নতুন নতুন স্বপ্ন নিয়ে। সবগুলো স্বপ্নই খুবই স্বাভাবিক, তবে একদম ধারাবাহিকভাবে হচ্ছে। স্বপ্নে ইতোমধ্যে তার মা মারা গেছেন এবং মারা যাওয়ার পরের সময়গুলোয় তার পরিবারে কী কী ধরনের জটিলতা হচ্ছে, তিনি তা দেখতে পাচ্ছেন।
বিষয়টা নিয়ে আমি আমার শিক্ষকের সঙ্গে একটু আলাপ করলাম। তিনি আমাকে পরামর্শ দিলেন আরেকটু সিরিয়াসভাবে সমস্যাটাকে ডিল করতে। কারণ এই ধরনের ডিলিউশন থেকে একসময় অডিটারি হ্যালুসিনেশন শুরু হয়। তখন তিনি স্বপ্ন আর বাস্তবের মধ্যে পার্থক্য করতে পারবেন না। ভয়ংকর!
পৃথিবী যেন রহস্য পছন্দ করে। লোকটা যখন বাস্তব আর স্বপ্নের মাঝের ফারাকটা নিয়ে দোদুল্যমান অবস্থায় ভুগছেন, ঠিক তখনই একটা অদ্ভুত ঘটনা তার জীবনকে আরো জটিল করে তুলল। লোকটার মা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলেন।
এতদিন যাও খানিকটা ঠিক ছিল, এই ঘটনার পর অবধারিতভাবেই লোকটা প্রায় পাগল হয়ে গেলেন। একদিকে মায়ের আকস্মিক বিদায়, অন্যদিকে স্বপ্ন ও বাস্তব জগতের মধ্যে গিট্টু লেগে যাওয়ায় তিনি কেমন ঘোরলাগা জগতে চলে গেলেন।
এবার স্বপ্নে তিনি অবাস্তব জিনিস দেখা শুরু করলেন। গেন্ডারিয়ার একটি মাংসের দোকানের পাশে সরু গলি দিয়ে গেলে একসময় দেখা মেলে কলোনির মতো ছোট একটা মহল্লার অংশ। স্বপ্নে তিনি দেখলেন, সেখানে বসবাস করেন মৃত মানুষেরা। স্বপ্নে তিনি সেই মৃত মানুষের কলোনিতে যান, নিজের মাকে খোঁজেন। খুঁজতে খুঁজতে দেখা হয়, তার স্কুলের শিক্ষকের সঙ্গে কিংবা অকালে প্রাণহারানো কোনো পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে। কিন্তু মাকে আর তিনি খুঁজে পান না।
দিন দিন পাগলের মতো হয়ে যেতে থাকেন লোকটা। কাঁচাপাকা দাড়ি অগোছালোভাবে উঁকি দেয় চেহারা দিয়ে। চোখগুলো কেমন ফোলা ফোলা। আমার চেম্বারে এসে মাঝে মাঝেই আমার হাত ধরে কাঁদো কাঁদো চেহারা নিয়ে বলেন, ‘ভাই আম্মাকে খুঁজে বেড়াইতেসি। দুয়া করিয়েন যেন মরা মানুষের মহল্লায় আম্মাকে খুঁজে পাই।’ এতেই ক্ষান্ত হন না তিনি, বেশিক্ষণ স্বপ্ন দেখলে অনেক দ্রুত মৃত মাকে খুঁজে পাবেন, এই আশায় প্রতিদিন ঘুমের ওষুধ খাওয়া শুরু করলেন। নিজের চোখের সামনে আমি একজনকে রীতিমতো মানসিক রোগী হওয়া দেখতে থাকলাম। আমার কোনো থেরাপিতেই কাজ হচ্ছিল না।
চূড়ান্তভাবে যেদিন লোকটা আমার কাছে এলো, সেদিন আমার আর কিছুই করার ছিল না। লোকটা অদ্ভুত শান্ত ছিল সেদিন। আমাকে শান্ত গলায় বলল, ‘ভাই কাল রাতে আম্মাকে খুঁজে পেয়েছি। উনি একটা টিনশেড বাড়ির সামনে আরো কয়েকজন মহিলার সঙ্গে গল্প করতেসিলেন।’ এই কথা বলার সময় লোকটার কণ্ঠ কাঁপছিল। আমি নিঃশ্বাস আটকে বসেছিলাম। একজন মানুষ তার মৃত মাকে নিয়ে একটা অবাস্তব জগৎ গড়ে তুলেছেন, কিন্তু জগৎটা সম্পর্কে তার এতটাই বিশ্বাস যে, বাস্তবের চেয়েও বেশি সত্যি মনে হচ্ছে তার। একজন সামান্য মানসিক চিকিৎসক হিসেবে এখানে কি আমার কিছু করার আছে? মনে হয়, নেই।
‘ভাই, আমার আম্মাকে দেখে যখন আমি ডাকলাম, উনি আমাকে চিনতে পারলেন না। ভাই, আমার আম্মা আমাকে চিনতে পারতেসেন না,’ এটুকু বলেই হাউমাউ করে কাঁদতে থাকলেন লোকটা। আমি চুপচাপ ভাবতে থাকি। লোকটাকে দেখে আমার গ্রামের বাড়ির মাহুতের কথা মনে পড়ে, যার বড় হাতির বাচ্চাটা দৌড়াদৌড়ি কিংবা পানিতে ঝাঁপাঝাঁপি করার সময় কেউ কাছে কাছে এলে দৌঁড়ে লুকিয়ে যেত মা হাতির কোলের ভেতর। আমার সামনে বসে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকা লোকটাকে তখন আমার সেই বাচ্চা হাতিটার মতো মনে হয়। নিছক স্বপ্নে দেখা একটি দৃশ্য উথালপাতাল করে দিচ্ছে একজনের সত্যিকারের জীবন।

