Ad T1

আপনারা একই সঙ্গে ইহুদি এবং ফিলিস্তিনি হতে পারবেন না?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
প্রকাশ : ১০ মে ২০২৫, ১৩: ২১

Jewish Standard যুক্তরাষ্ট্রের ইহুদি সম্প্রদায়ের জন্য কাজ করা প্রাচীন ইহুদি সাপ্তাহিক। ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ যুক্তরাষ্ট্র সফর করলে এই সাপ্তাহিক থেকে তার এই সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। ইসরাইল প্রতিষ্ঠার বহু বছর আগে ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদ, আরব-ইসরাইল সংকট এবং ইহুদিবাদ নিয়ে তার অভিমত-পরামর্শ ব্যক্ত করেন।

সাক্ষাৎকারটি The English Writings Of Rabindranath Tagore বইয়ের তৃতীয় খণ্ড থেকে অনুবাদ করেছেন নওমি তাহরিন

আমি যখন রবীন্দ্রনাথকে জিজ্ঞেস করলাম ইহুদিবাদকে সমর্থন করেন কি না, তিনি বললেন, ‘ইহুদিবাদী আদর্শকে আমি শ্রদ্ধা করি। যারা এর জন্য কাজ করছে তাদের আত্মস্বার্থহীনতারও তারিফ করি। যতটা সম্ভব নিবিষ্টতা নিয়ে আমি খেয়াল করছি আপনাদের আদর্শ অবিচল ও অবিরামভাবে বাস্তব রূপ নিচ্ছে। দারুণ এগিয়েছেন আপনারা। কিন্তু এখন আপনাদের রাজনৈতিক চিন্তাধারা আপনাদের একটা কানা গলির দিকে নিয়ে যাচ্ছে; পরিণতিহীন পথের দিকে। এমনকি ইংল্যান্ড চাইলেও আরব-ইহুদি অংশীদারত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না। আরব-ইহুদি সম্প্রীতি জন্মাতে হবে খোদ ফিলিস্তিনে।’

‘কীভাবে সেটি অর্জন করা সম্ভব হবে’? সাক্ষাৎকার গ্রহীতা প্রশ্ন করেন।

‘আমি রাষ্ট্রনায়ক নই। আর এমন ভাবও দেখাতে চাই না যে, আমি আপনার এ জিজ্ঞাসার জবাব জানি।’ পাল্টা উত্তরে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বললেন কবি। ‘আরবদের চিনি আমি এবং আমার বিশ্বাস ইহুদিদেরও জানি। এ জন্যই মনে করি এদের মধ্যে আর্থ-রাজনৈতিক সহযোগিতার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। ইহুদি এক প্রাচীন জাতি। অনেক নিপীড়ন-নির্যাতন পার হয়ে এসেছে। তবু আত্মপরিচয় হারায়নি। ওদের শক্তির জায়গা নিজ ধর্ম ও সংস্কৃতি। আপনাদের রয়েছে এমন এক আত্মিক ঐতিহ্য, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরো শক্তিশালী হয়েছে। এটি আত্তীকরণ বা হজম করা সম্ভব নয়। আরবরাও অদম্য এক জাতি। এই দুই জাতির ধর্ম ও সংস্কৃতি উঠে এসেছে একই ছাঁচ থেকে। আরবরা আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে ইহুদিদের থেকে অনেক কিছু নিয়েছে। মৌলিক বিচারে আপনারা আর ওরা একই পরিবার। হ্যাঁ, এক বিরাট পরিবার। পারিবারিক ঝগড়া সর্বদা মারাত্মক’, হাসলেন দার্শনিক, ‘তবে মিটিয়ে নেওয়া যায়। আরবদের তুলনায় বহু দূরের ভিন মানুষদের সঙ্গে মানিয়ে চলা রপ্ত করেছেন আপনারা। যারা সব বিচারে আপনাদের কাছে বিদেশি। এমনকি যন্ত্রসংস্কৃতির মার্কিন মুলুকেও আপনারা একই সঙ্গে ইহুদি আবার আমেরিকান হয়ে বেঁচে থাকা শিখেছেন। তাহলে, আপনারা কি একই সঙ্গে ইহুদি এবং ফিলিস্তিনি হতে পারবেন না?’

এইটুকু বলে পেছনে হেলান দিলেন কবি। তার মুখাবয়বে ছড়িয়ে পড়ল প্রায় দৈবিক এক শান্ত ভাব। যেন তার নিজের কথার প্রতধ্বিনির দিকে কান পেতে আছেন। কিছুটা দ্বিধার সঙ্গেই তার শান্তির নীরবতা ভেঙে দিয়ে আমি বললাম, ‘কিন্তু ডক্টর ঠাকুর, ইহুদিবাদ তো সে দ্বৈত জীবন থেকেই মুক্তি চায়। যারা অন্য জাতিতে বিলীন হয়ে যেতে পারে না বা চায় না সেই ইহুদিদের জন্যই তো ইহুদিবাদ। আপনার পরামর্শমতো ইহুদিদের যদি ইহুদি জাতীয়তাবাদ আর ফিলিস্তিনিদের মধ্যে প্রভেদই করতে হয়, তাহলে ইহুদিদের কাছে তো ফিলিস্তিনও হয়ে উঠবে আর এক আমেরিকা, ফ্রান্স বা জার্মানি।’

কাব্যিক সুরেলা ভঙ্গিতে জবাব দিলেন কবি, ‘ইহুদিবাদকে আমার মহান বন্ধু আইনস্টাইন যেভাবে বোঝেন আমিও সেভাবেই বুঝি। আমি মনে করি, ইহুদি জাতিবাদ হলো ইহুদি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখা এবং আরো জোরদার করার অবিরাম চেষ্টা। এটি দরকারি বস্তুগত পরিপার্শ্বের সঙ্গে সঙ্গে অনুকূল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থাও নির্দেশ করে। আমি তা বুঝতে পারি। তবে, ফিলিস্তিনে শুধু তখনই সে অবস্থা তৈরি হবে, যখন ইহুদিরা তাদের আর্থ-রাজনৈতিক কর্মসূচিতে আরবদের যথার্থ অংশীদার করতে পারবে। এটুকু রাজনৈতিক সহযোগিতামূলক সম্পর্ক অর্জনের জন্য আপনাদের আধ্যাত্মিক বা সাংস্কৃতিক কোনো স্বার্থ ত্যাগেরও দরকার পড়বে না। আমি তো কল্পনায় এমন এক ফিলিস্তিন কমনওয়েলথ দেখতে পাই, যেখানে আরবরা নির্বিঘ্নে তাদের ধর্মীয় জীবনযাপন করবে। ইহুদিরাও পুনরুজ্জীবিত করে নেবে তাদের প্রোজ্জ্বল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। আর উভয়ে এসে মিলবে একটি একক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সত্তায়। আমি আপনার চোখে সন্দেহ দেখতে পাচ্ছি। আপনি ভাবছেন এসব হচ্ছে সরলমনা কবির অসংলগ্ন চিন্তা। আপনার মনে প্রশ্ন জাগছে, কীভাবে তা সম্ভব হবে। আমি কিন্তু ইহুদি জাতির মানুষদের সক্ষমতা আর বিশেষ গুণে বিশ্বাস করি। আরব আর আপনাদের আর্থ-রাজনৈতিক স্বার্থ যে একই-এ কথাটা যদি আপনারা আরবদের বোঝাবেন বলে মনস্থির করেন, যদি ওদের দেখাতে পারেন আপনাদের সাংস্কৃতিক পার্থক্য সত্ত্বেও ফিলিস্তিনে আপনারা যা করছেন, তা উভয়ের স্বার্থেই করছেন, তাহলে এক দিন আরবরাই হয়ে উঠবে আপনাদের সবচেয়ে বিশ্বস্ত মিত্র।’

এ পর্যায়ে সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী বিনয়ের সঙ্গে বলেন, ‘ইহুদিরা এতদিন ঠিক এই কাজটাই করে আসছিল। তা সত্ত্বেও গত বছর আগস্টে...’ [জেরুজালেমে বিলাপের দেয়াল (আল-আকসার পশ্চিম পাশের যে দেয়াল ধরে ইহুদিরা প্রার্থনা করে) নিয়ে ঝামেলার পর ইহুদিদের ওপর আরবরা হামলা করে]।

আমাকে কথা শেষ করতে দিলেন না রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। একটা ছায়া ছড়িয়ে পড়ল তার সুন্দর মুখাবয়বে। সেসব বাজে ঘটনার কথা আনবেন না, যা ঘটেছে তার জন্যই আমি এসব কথা বলছি। ইহুদিদের থেকে ভিন্ন হলেও আরব জাতিবাদ এখন পর্যন্ত মূলত আধ্যাত্মিক। বহু শতক ধরে আরবরা তাদের জন্মভূমির প্রতি অবহেলা দেখিয়েছে। কারণ আধ্যাত্মিকভাবে ওরা রাজনৈতিক জাতিবাদের ঊর্ধ্বে। পশ্চিমা সভ্যতা এই দেশটাকে বলে আদিম অসভ্য। যাই হোক, পশ্চিমের রাজনৈতিক জাতিবাদের খেলায় আরবরা নবাগত। ওরা এখনো যেমন বিভ্রান্ত, ওদের মনকেও সহজেই বিভ্রান্ত করা যায়। ওদের মাথায় ঢুকেছে, এখানে একটি ইহুদি আবাসভূমির প্রতিষ্ঠা তাদের আধ্যাত্মিক বা ধর্মীয় জীবনযাপনকে বিপদগ্রস্ত করবে। ফিলিস্তিনে অবিরাম দ্রুত হারে ইহুদি জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তির বিষয়টিকে তারা ভুল বুঝেছে। জনআবেগমুখী নেতৃত্ব সে চিন্তাকে আরো ত্বরান্বিত করেছে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পশ্চিমা কূটনৈতিক মনের পক্ষেও অনেক সময় ইহুদিবাদকে বোঝা কঠিন হয়ে পড়ে। আরব আদিম মনের কাছে তা তো একেবারেই নতুন আর অচেনা বিষয়। আমি বলতে চাচ্ছি, একটি ইহুদি আবাসভূমির অস্তিত্বের সঙ্গে আরব মনোভাবের খাপ খাইয়ে নেওয়ার কাজটা দিনে দিনে ধাপে ধাপে ঘটার বিষয়। আরবদের সঙ্গে সম্পর্ক যোজনে ইহুদিদের জানাশোনা এবং ধৈর্য থাকতে হবে। আপনারা তো পুব আর পশ্চিমের সভ্যতার চমৎকার মিশেল। আপনাদের হতে হবে মহৎ মনের শিক্ষক। রাজনৈতিক বাধাবিঘ্ন সত্ত্বেও আপনাদের আত্মিক ঐতিহ্য সমুন্নত রাখা জরুরি। ফিলিস্তিন জাতিবাদের অংশীদার আরবদের সঙ্গে মিলনের পথে ত্যাগ স্বীকারের পাশাপাশি আপনাদের অনেক ধীরস্থিরভাবে এগোতে হবে। দু-একটা ছোটখাটো বিষয়ে আমার দ্বিমত আছে আইনস্টাইনের ধর্মচিন্তার ব্যাপারে। কিন্তু তার ধর্মচিন্তা খুচরা অন্ধ দেশপ্রেম আর রক্ষণশীল জাতিবাদের বিরুদ্ধে। ইউরোপীয় কূটনীতির নানা কৌশল বা শ্বেতপত্র দিয়ে আইনস্টাইনের মহাজাগতিক বিশ্বাসকে টলানো যাবে না। সে বিশ্বাস আপনাদের এমন এক মহৎ ও বৃহত্তর জাতিবাদের দিকে নিয়ে যাবে, যা আপনারা ফিলিস্তিনে কায়েম করতে পারবেন, যা পুরো মানবজাতির সামনে উদাহরণ হয়ে উঠতে পারে। প্যারা আর অনুচ্ছেদের জালে আটকা পড়ে থাকবেন না। সব জাতির ইহুদিরাই ভালো করে জানে রাজনৈতিক নিরাপত্তা অর্থহীন। কোনো চুক্তিই আপনাদের নিপীড়ন থেকে রক্ষা করেনি। আগামীতেও করতে পারবে না। মুক্ত মন নিয়ে আপনাদের অংশীদার ফিলিস্তিনিদের কাছে যান। তাদের বলুন, ‘আমরা দুই-ই প্রাচীন জাতি। আমরা উভয়েই অদম্য জাতির মানুষ। তোমরা আমাদের দমাতে পারবে না। আমরা তোমাদের বদলাতে যাব না। এ সত্ত্বেও আমরা উভয়েই নিজের মতো হয়ে উঠতে পারি, আমাদের নিজ নিজ আত্মপরিচয় নিয়েও ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক লক্ষ্যের মধ্যে, ইহুদি ও আরব কমনওয়েলথের মধ্যে এক হয়ে মিশে যেতে পারি। আমি মানি প্রথম চেষ্টাতেই ওরা আপনাদের বুঝতে পারবে এমন নয়। সম্মান ও অহংকারের পশ্চিমা ধারণা দূরে ছুড়ে ফেলুন। এভাবে কাজ করে যান, যার লক্ষ্য হিসেবে সামনে থাকবে এমন এক ফিলিস্তিন, যেখানে ইহুদি ও আরব উভয়েই তাদের নিজ নিজ সাংস্কৃতিক এবং আধ্যাত্মিক জীবনযাপন করতে পারবে। তাহলে আপনারা অবশ্যই সফল হবেন।’

ক্লান্ত হয়ে পেছনে হেলান দিলেন ঠাকুর মশাই। নিচু গলায় প্রায় ফিসফিস করে যেন নিজেকেই বললেন, ‘লন্ডনে ইহুদিবাদী নেতারা আর ব্রিটিশ সরকারের আলোচনা দিয়ে ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান হবে না। ইহুদিবাদের সাফল্য পুরোটাই নির্ভর করছে আরব-ইহুদি সহযোগিতার ওপর। সেটি শুধু ফিলিস্তিনে সরাসরি আরব-ইহুদি বোঝাপড়ার মধ্য দিয়েই অর্জন করা সম্ভব। ইহুদিবাদী নেতারা যদি ফিলিস্তিনে তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ আরবদের থেকে আলাদা করার চেষ্টায় অটল থাকে, তাহলে পবিত্র ভূমিতে কুৎসিতের বিস্ফোরণ ঘটতেই থাকবে।’

চোখ বন্ধ করলেন রবীন্দ্রনাথ, নরম গলায় বিড় বিড় করে বললেন, ‘ইহুদিরা যদি পশ্চিমা জাতিবাদী চিন্তা থেকে মুক্ত হতে পারে, তাহলে আমরা কবিরা যে স্বপ্ন দেখেছি ফিলিস্তিনে ওরা বাস্তবে তা সৃষ্টি করে দেখাতে পারবে।’

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত