আমার দেশ জনপ্রিয় বাংলা নিউজ পেপার

এক দুপুরে চার্লস ডিকেন্স

অপূর্ব চৌধুরী
এক দুপুরে চার্লস ডিকেন্স

চার্লস ডিকেন্স মিউজিয়ামের দরজা খোলাই ছিল। ঢুকতেই অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা ঘিরে ধরল। আশেপাশে কেউ নেই। বাইরে লন্ডনের রোদেলা দুপুর, ভেতরে একটা হালকা অন্ধকার। লবির সিলিংয়ে আলো যেন কম লাগছে। ভাবলাম, সময় হয়তো নিজেকে ধীরে ধীরে গুটিয়ে নিতে চাইছে। সামনে তাকাতেই চোখ পড়ল কাঠের পুরোনো সিঁড়িটির দিকে। এমন সিঁড়ি সিনেমায় দেখি আমরা, হাঁটলে শব্দ করে, যেন অতীতের কথা বলে।

বাঁ দিকে ঘুরতেই রিসেপশন রুম। একটু উঁকি দিয়ে দেখলাম। ঘরের দেয়ালে হালকা হলুদ আলো। সামনে রিসেপশন। কাউন্টারের পেছনে কেউ নেই। ঢুকেই একটু দাঁড়িয়ে চারপাশে চোখ বুলাতে পাশের রুম থেকে কেউ একজন হাজির। ছাই রঙের টি-শার্ট পরা। কাউন্টারের পেছনে দাঁড়িয়ে হাসি দিয়ে বলল, হাউ কেন আই হেল্প ইউ?

বিজ্ঞাপন

টিকিট কিনলাম। তেরো পাউন্ড প্রায়। জানতে চাইলেন, আর কেউ আছে কিনা। হাতে একটি ছোট্ট গাইড বই আর একটি মানচিত্র তুলে দিলেন—ডিকেন্সের বাড়ির মানচিত্র। সঙ্গে বললেন, অডিও গাইড দরকার কিনা। প্রয়োজনে ভলান্টিয়ার গাইডারও আছেন। সামনে থাকা একটি বোর্ডের দিকে ইশারা দিয়ে বললেন, এই বারকোড ক্লিক করলে অডিও গাইডের সুবিধা পাবেন।

মোবাইল ফোনের ইন্টারনেট কেন জানি কাজ করছিল না তখন। বললাম, আপনাদের ওয়াইফাই কাজ করে কিনা!

ওই বোর্ডের নিচেই ওয়াইফাইয়ের ইউজারনেম এবং পাসওয়ার্ড ছোট করে লেখা ছিল। ইশারা দিয়ে বলতেই চোখে পড়ল ওটা।

মুঠো করে সেই মানচিত্র ধরে রিসেপশন ডিঙিয়ে পাশের করিডোরের দিকে গেলাম।

ম্যাপে চোখ বুলাতেই বুঝতে পেলাম আমি এখন গ্রাউন্ড ফ্লোরে। সিঁড়ি দিয়ে এক ধাপ নিচে নামলে বেসমেন্ট। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠলে ফার্স্ট ফ্লোর। ম্যাপে আরেকটু নজর দিতেই দেখলাম, সেকেন্ড ফ্লোরও আছে। তার মানে, সব মিলে বাড়ির পাঁচ ফ্লোর। পাঁচতলা বাড়ি বলা যায়।

রিসেপশন থেকে লবি ধরে বাঁয়ে ডাইনিং রুম। ঢুকে গেলাম। রুমের মধ্য বরাবর ছয় চেয়ারের একটি টেবিল, তাতে সম্ভবত ক্রিসমাসের কোনো এক সকালের ডামি খাবার সাজানো। একপাশে সাজানো চীনামাটির বাসন। এই ঘরেই ডিকেন্স তার বন্ধুদের আপ্যায়ন করতেন, পরিবারের সঙ্গে খেতে বসতেন। বন্ধুদের কেউ আসত সাহিত্যের আলোচনা করতে, কেউ রাজনৈতিক তর্কে মেতে উঠতে। মোমবাতির আলোয় সেই রাতগুলো কেমন ছিল? এক এক করে চোখের সামনে ফুটে উঠছিল কথোপকথনের দৃশ্য, হাসি, তর্ক ও টুকরো টুকরো কথার আনন্দ।

ডাইনিং রুমের পাশে মর্নিং রুম। কফি হাতে ডিকেন্স সেখানে বসতেন সকালে। ঘরের একপাশে একটি পুরোনো ঘড়ি। সময় থেমে আছে যেন; কল্পনায় দেখতে পেলাম, তার পা ছুঁয়ে আছে গরম কাঠের মেঝে, সামান্য বাতাসে কাগজের পাতা দুলে উঠছে। এমন মুহূর্তেই জন্ম নিয়েছিল Nicholas Nickleby, যার প্রথম খসড়া এই ঘরেই লেখা হয়।

মর্নিং রুম থেকে বেরিয়ে দ্বিধায় পড়ে গেলাম সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠব, নাকি নিচে নামব। ম্যাপের দিকে আবার তাকিয়ে বুঝলাম, বেসমেন্ট দেখে আবার উপরে উঠে আসব। বেসমেন্টে কিচেন, প্রিপারেশন রুম, ওয়াশ রুম ও লন্ড্রি রুম। ভিক্টোরিয়ান পিরিয়ডের কিচেন আর ওয়াশরুমের সাজসজ্জা দেখে উপরে উঠে এসে ফার্স্ট ফ্লোরে গেলাম।

প্রথম ঘরেই চোখ আটকে গেল। ডিকেন্সের স্টাডি রুম, লেখার রুম। ছোট্ট একটা কক্ষ, একটি ডেস্ক, একটি চেয়ার, আর দেয়ালে ঝুলছে ডিকেন্সের হাতে লেখা কিছু পাণ্ডুলিপি। কেমন করে বসতেন তিনি? জানালার ধারে, বাইরের কুয়াশা-ঢাকা লন্ডনের দিকে চেয়ে, হয়তো মাথার মধ্যে ঘুরছিল Pip-এর গল্প, কিংবা Oliver-এর কান্না। বইয়ের তাকে লাইন দিয়ে সাজানো পুরোনো বই। টেবিলের উপর কাচে ঘেরা তার একটা কলমদানি। টেবিল বরাবর একটি চেয়ার। হাতওয়ালা চেয়ার। বেতের সিট। তাকিয়ে রইলাম চেয়ারটার দিকে। এমনই একটি চেয়ারে বসে কি তিনি লিখতেন Oliver Twist? এই টেবিলেই কি তৈরি হয়েছিল David Copperfield-এর প্রথম খসড়া?

রুমটি ছিমছাম, কিন্তু নিঃশব্দে বলছে অনেক কথা। দেয়ালে ডিকেন্সের একটি প্রতিকৃতি—চোখ দুটি গভীর, যেন কাগজে কলম ছোঁয়ানোর আগেও হাজারটি গল্প দেখতেন ভেতরে ভেতরে। স্টাডি রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম পাশের রুমটির দিকে। সিটিং বা ড্রইং রুম এটি। জানালা বরাবর সোফা। অন্যপাশের দেয়ালের দিকে রিডিং টেবিল। টেবিলটার নকশা ডিকেন্স নিজে করেছিলেন। অনেকটা বক্তৃতা দেওয়ার উঁচু ডায়াসের মতো।

হাঁটছিলাম যখন, অনুভব করছিলাম প্রতিটি ঘরের মেঝে কাঠের, পায়ের নিচে হালকা শব্দ হচ্ছে। সোফার পেছনে জানালা। ভিক্টোরিয়ান আমলের বিশাল বিশাল জানালা। একটি জানালার পাশে একটি চেয়ার রাখা। হয়তো মাঝে মাঝে সেখানে বসতেন। জানালা খুলে সামনের রাস্তা দেখতেন।

জানালা দিয়ে বাইরের আলো ঢুকছে। দুপুরের গনগনে আলো। মনে হলো সেই আলো যেন অতীতের কোনো আলো। কোথাও বইয়ের পাতা ওলটানোর শব্দ, কোথাও এই রুমের দেয়ালে রাখা আয়নায় ডিকেন্সকে খুঁজতে থাকা। যে রুমেই যাচ্ছি, ঘরের দরজাগুলো খোলা, অথচ যেন প্রতিটি রুম নিজস্ব ভাষায় ডাকছে।

ট্রাউজারের পকেটে এক হাত ঢুকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছি—সবকিছুই যেন কেমন চুপচাপ, অথচ জীবন্ত। একেকটা জিনিসের কাছাকাছি যেতেই মনে হচ্ছে—কেউ দেখেনি, আমার মন ছুঁয়ে দেখছে প্রতিটি অংশকে। রুমের প্রতিটি দেয়াল যেন অনুভব করেছে সেই ছোঁয়া।

ডিকেন্সের ব্যবহৃত চশমা, তার হাতে লেখা চিঠি, তার ইটালিক হ্যান্ড রাইটিং—সবকিছু যেন আটকে রেখেছে সময়কে। কিছু একটা চাপা রোমাঞ্চ কাজ করছে ভেতরে ভেতরে, যেন আমি শুধু একজন লেখকের ঘরে নয়, একটা সময়ের, একটা যুগের, একটা পিরিয়ডের, একটি কালের মধ্যে ঢুকে পড়েছি কিছুক্ষণের জন্য।

এই বাড়িটি ছিল ডিকেন্সের লেখালেখির সময়কার বসতঘর। যদিও তিনি এখানে ছিলেন ১৮৩৭ থেকে ১৮৩৯ সাল পর্যন্ত। এখানে তিনি লিখেছেন The Pickwick Papers, Oliver Twist ও Nicholas Nickleby। আর এই তিনটাই তাকে এনে দিয়েছিল পরিচিতি। এখানেই প্রথমবার খ্যাতি আকাশ ছুঁয়েছিল তার। এই দেয়ালগুলোই শুনেছে একজন লেখকের প্রথম অশ্রু, প্রথম উল্লাস, প্রথম আনন্দ আর চারদিকে তার জয়জয়কার। আবার ফিরে এলাম স্টাডি রুমে। দাঁড়িয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। কিছু অনুভব শুধু চোখে দেখা যায় না—তাকে শুনতে হয়, ধীরে ধীরে, আত্মার কান দিয়ে।

সিঁড়ি ডিঙিয়ে উপরে উঠলাম। ফার্স্ট ফ্লোর। আমাদের দেশের ভাষায় দোতলা, এখানে বলে ফার্স্ট ফ্লোর বা প্রথম তলা। আমাদের যা প্রথম তলা, তাকে এখানে বলে গ্রাউন্ড ফ্লোর। যদিও বেজমেন্ট থাকায় এটিকে তিনতলা বলা যায়। এই ফ্লোরে বেডরুম। একটি ডিকেন্সের, আরেকটি তার স্ত্রীর। ডিকেন্সের রুমের পাশে তার ওয়াশরুম। প্রথমে ঢুকলাম ডিকেন্সের বেডরুমে। এই রুমে রাখা ছিল তার স্ত্রীর ব্যবহৃত আয়নাটি, সঙ্গে ছোট সোফা চেয়ার, দেয়ালে পারিবারিক কিছু ছবি। এইখানে ডিকেন্স একজন স্বামী, একজন বাবা। লেখকের বাইরেও একজন মানুষ, যিনি হাসতেন, ভাবতেন ও ক্লান্ত হতেন।

lal
lal

স্ত্রীর বেডরুমটি দেখে আবার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলাম। এই ফ্লোরে দুটি রুম। একটি বাচ্চাদের, আরেকটি সার্ভেন্টদের।

একটি শিশুরুম। ছোট্ট খাট, খেলনা ও কাঠের দোলনা। হ্যাঁ, ডিকেন্সের সন্তানদের জন্য সাজানো রুম। এখানে এসে মনে পড়ে গেল David Copperfield—ছোটবেলায় মায়ের কোলে বসে থাকা সেই চরিত্র, যার ভেতর আছে ডিকেন্স নিজেই।

ডিকেন্সের জগৎ শুধু বইয়ের মধ্যে নয়, এই দেয়ালের মধ্যেও বেঁচে আছে। ঘরে ঘরে ঘুরতে ঘুরতে আমি আর আমি থাকলাম না, ডিকেন্সের সৃষ্টি প্রতিটি চরিত্র যেন আমার সঙ্গী হয়ে হাঁটছে। আমি হয়ে উঠলাম এক পাঠক, এক চরিত্র, এক সফরসঙ্গী—ডিকেন্সের সাহিত্যিক সংসারে এসে যে হারিয়ে গেছে।

পুরো মিউজিয়ামটি পাঁচটি ফ্লোরে উপরে-নিচে ভাগ হলেও সাইডের দিক থেকে তিন ভাগে বিভক্ত। মাঝ বরাবর সিঁড়ি, করিডোর, আর লবি। তার দুপাশে রুম। বাঁ পাশে ডিকেন্সের পুরো বাড়ির ছক। কিচেন, ডাইনিং, সিটিং, রিডিং, মর্নিং, বেডরুম এবং চিলড্রেন আর সার্ভেন্ট রুম। ডান পাশে রিসেপশন থেকে শুরু করে অ্যাডমিন কক্ষ, রিসার্চ রুম, স্মৃতির সংগ্রহশালা, দর্শনার্থীদের রিডিং রুম, ক্যাফে, ওয়াশরুম—এমন কিছু কক্ষ।

ফার্স্ট ফ্লোরে এসে থামলাম সংগ্রহশালার সামনে। ঢুকলাম রুমটিতে। এই অংশে আসতেই এক অন্যরকম অনুভূতি হলো। এ যেন কোনো কাগজে লেখা অতীতের নয়, একেবারে ছুঁয়ে দেখার মতো ইতিহাস। দেয়ালের পাশে পাশে সাজানো কাচের ভিট্রিন, প্রতিটিতে যেন একটি করে গল্প।

প্রথমেই চোখে পড়ল ডিকেন্সের হাতে লেখা একটি চিঠি। কালি একটু বিবর্ণ, হস্তাক্ষর শক্ত আর প্রাণবন্ত। ইটালিক রাইটিং। সেই লেখায় রয়েছে ব্যক্তিগত ভাবনার ছাপ, আবার লেখকসুলভ স্নায়বিক উত্তেজনা। মনে হলো, চিঠিটি পড়ে ফেললে আমি যেন আরো কাছে পৌঁছে যাব সেই মানুষটার, যিনি এতগুলো চরিত্র সৃষ্টি করেছিলেন। এগুলোর দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিল, পাঠকরা হলেন এমন এক গ্রুপ, যারা শিল্পীর দেহ ছুঁতে পারে না; কিন্তু তার ছোঁয়া, তার ধরা জিনিসগুলোকে নিয়ে অনুভব করতে পারে। হয়তো অনেক কিছুই পারে না, হয়তো অনেক কিছুই কল্পনার রঙ মিশিয়ে অনুভব করে নিতে হয় আমাদের।

একটি ঘরে রাখা তার বিখ্যাত বইগুলোর প্রথম সংস্করণ Bleak House, Little Dorrit ও A Tale of Two Cities রাখা আছে। প্রতিটির মলাট যেন একেকটি সময়ের প্রতিচ্ছবি। পাশে বড়পর্দায় চলছে ভিডিও ফুটেজ—ডিকেন্সের জীবন, লেখালেখির গল্প এবং লন্ডনের সেই সময়কার চিত্র। এখানে-ওখানে কিছু পোস্টার।

এই সংগ্রহশালা শুধু বই বা বস্তু নয়, এটি এক আবেগের সংরক্ষণাগার। এই জায়গা বুঝিয়ে দেয়—লেখকের জীবন কেবল কাগজে নয়, সে ছুঁয়ে থাকে কলম, জানালা, একটি পুরোনো চেয়ার, এমনকি একটি নীরব ঘড়ির কাঁটা হয়ে।

Google News Icon

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন