সারোয়ার তুষার
বছর ঘুরে আরেক জুলাই এসে হাজির। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হওয়ার পর ‘জুলাই’ শুধু মাস নয়; এটি এখন একটি চিহ্নে পরিণত হয়েছে, যার মধ্য দিয়ে আমরা ন্যায়-অন্যায়, গণতান্ত্রিকতা, ফ্যাসিবাদ ইত্যাদির ব্যাপারে সিদ্ধান্তে আসতে পারি। হঠাৎ মনে হলো কি, এক তীব্র অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়েই না গত বছরের এ মাসটি আমরা পার করেছি! ফ্যাসিবাদী ও অবৈধ আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ বিস্ফোরণের অপেক্ষায় ছিল। অবশেষে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটল।
শুরু থেকেই এ আন্দোলনের প্রতি আমাদের সমর্থন ছিল। তবে ১৪ জুলাই গণহত্যাকারী পলাতক শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলে গালি দেওয়ার পর আন্দোলন আর কোটায় সীমাবদ্ধ থাকেনি। ১৬ জুলাই আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে শহীদ হওয়ার পর সারা দেশে আন্দোলন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। তারপর দিন, অর্থাৎ, ১৭ জুলাইয় আবু সাঈদের সর্বশেষ ফেসবুক পোস্ট আমার নজরে আসে। তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছিলাম ‘অভ্যুত্থান চাইলেই অভ্যুত্থান হয় না; আবার যদি হতে থাকে, তাহলে শত আপত্তি দিয়েও তা ঠেকানো যায় না। ১৬ জুলাই আবু সাঈদের শহীদির মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতি গণঅভ্যুত্থান পর্বে ঢুকে গেছে। একে আর পেছনে ফেরানো যাবে না।’
মূলত আবু সাঈদ শহিদ হওয়ার ঘটনা সারা দেশের শিক্ষার্থী সমাজসহ জনসাধারণকে তুমুলভাবে নাড়া দেয়। এদিকে আন্দোলনকারী নেতৃত্ব বাংলা ব্লকেড, কমপ্লিট শাটডাউন ইত্যাদি সফল কর্মসূচি ঘোষণা করছিল; অন্যদিকে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকার সব রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে কারফিউ জারির মাধ্যমে বাংলাদেশকে লাশের কারবালায় পরিণত করেছিল।
আমার বিবেচনায় ১৬ থেকে ২০ জুলাই বাংলাদেশে প্রথম পর্বের গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়ে গিয়েছিল। সে সময় ফেসবুকে লিখেছিলাম- ‘১৬-২০ জুলাইয়ের বাংলাদেশ কাঁপানো পাঁচ দিনের অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের রাজনীতি নতুন ঐতিহাসিক পর্বে প্রবেশ করল। গণরাজনৈতিক ধারার জন্য এ সময়টা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।’
কিন্তু আবু সাঈদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি গণঅভ্যুত্থান পর্বে ঢুকে গেছে— এতটা নিশ্চিত করে বলতে পেরেছিলাম কীভাবে? নিরস্ত্র আবু সাঈদ পুলিশের গুলির সামনে নিজের বুক পেতে দিয়েছিলেন। সাঈদ তার সর্বশেষ ফেসবুক পোস্টে উনসত্তরের পাকিস্তানি সামরিক স্বৈরশাসক আইয়ুববিরোধী ছাত্র-শ্রমিক-জনতার গণঅভ্যুত্থানের বীর শহীদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রক্টর অধ্যাপক শামসুজ্জোহাকে স্মরণ করেছিলেন। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা যেন ছাত্রদের গুলি করতে না পারে, সে জন্য অধ্যাপক জোহা ছাত্রদের ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন এবং বুকের তাজা রক্ত দিয়ে ছাত্রদের রক্ষা করেছিলেন।
সাঈদের ওই ফেসবুক স্ট্যাটাস আমার মধ্যে তীব্র এক অনুভূতি তৈরি করে। কীভাবে ইতিহাস হানা দেয়, বর্তমানে তা যেন প্রত্যক্ষ করলাম! উনসত্তর এসে মিলে গেল চব্বিশে, রাজশাহী থেকে রংপুর হয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ল বিদ্রোহের আগুন।
আসলে জুলাইয়ের শেষ পনেরো দিন কেটেছে চরম উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তায়। ১৯ জুলাই পল্টন থেকে প্রেসক্লাব অভিমুখী আমাদের মিছিলে গুলি চালায় পুলিশ। এরপর আমরা সাময়িক সময়ের জন্য হাইড আউটে যেতে বাধ্য হই। শুরু হয় ইন্টারনেট ব্ল্যাক আউট। একদিকে রাজপথে প্রতিবাদ, মিছিল সমাবেশ করছিলাম; অন্যদিকে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে সক্রিয়ও ছিলাম। আবু সাঈদ শহীদ হওয়ার পরই আমরা গণঅভ্যুত্থানের আঁচ টের পেয়েছিলাম। বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থান হওয়া উচিত—এ ব্যাপারে আমার কখনো কোনো সংশয় ছিল না। কিন্তু ১৬ জুলাইয়ের পর থেকে তা আর ঔচিত্যের পর্যায়ে ছিল না; বাঁচার দাবিতে পরিণত হয়েছিল। ১৬-৩১ জুলাই বিভিন্ন ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে থিসিস আকারে আমি বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ কখনো ডায়েরিতে, কখনো ফেসবুকে টুকরা টুকরা পোস্টের মাধ্যমে, কখনো হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেলে টুকে রাখছিলাম ‘জুলাই থিসিস’র ৪ নম্বর পয়েন্টে লিখেছিলাম, ‘শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে লাশের কারবালায় পরিণত করেছেন। হেলিকপ্টার থেকে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি, হাই রাইজ বিল্ডিং থেকে স্নাইপার দিয়ে গুলি—এর আগে কখনোই বাংলাদেশে কোনো আন্দোলন দমনে দেখা যায়নি। একটা সরকার স্বৈরাচারী হতে পারে। বাংলাদেশের মানুষের স্বৈরাচারী সরকারের অভিজ্ঞতা বহু পুরোনো। কিন্তু জুলাই অভ্যুত্থান যেভাবে দমন করা হচ্ছে, তা নজিরবিহীন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ কোনো হানাদার সরকারের অধীনে পরাধীন হয়ে আছে। এ যেন আরেক মুক্তির সংগ্রাম। একমাত্র কাশ্মীর ও পশ্চিমতীরের সঙ্গে এ পরিস্থিতি তুলনীয়। কার/কাদের নির্দেশে শেখ হাসিনা এই পথ ধরলেন, তা সময়ই বলে দেবে।… আওয়ামী লীগ দিল্লির দখলদারত্বের স্থানীয় এজেন্টের ভূমিকা পালন করছে।’
আন্দোলন দমনে হাসিনারা যতগুলো যুক্তি ব্যবহার করেছে, তার সবগুলোই দিল্লি-ইসরাইলি ব্লকের আন্দোলন দমনের কৌশলের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। সেই প্রেক্ষাপটে লিখেছিলাম, ‘পুরো মডেলটা হচ্ছে ইসরাইলি কাউন্টার ইন্সার্জেন্সি ও কাউন্টার টেররিজমের মডেল। দিল্লি ইসরাইলের কাছ থেকে স্রেফ অস্ত্র ও যন্ত্রপাতিই কেনে না; সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে নিরাপত্তার মতাদর্শ এবং পদ্ধতিও রপ্ত করে। কাশ্মীরসহ ইন্ডিয়ার নানা জায়গায় এই মডেল অলরেডি পরীক্ষিত। এবার আমাদের এখানে প্রয়োগ করা হলো। আওয়ামী লীগ সরকার এবার পুরো বয়ানটাকে জঙ্গিবাদের দিকে নিয়ে গেছে। ইসরাইলের প্রশিক্ষণে ইন্ডিয়ার পুলিশের ক্রমাগত সামরিকায়ন ঘটেছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ইন্ডিয়ার সামরিক প্রশিক্ষণ আদান-প্রদানের নানা সমঝোতা ও চুক্তি বিদ্যমান।’
বাংলাদেশের ইতিহাসে একসঙ্গে এত বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী ও তরুণ গ্রেপ্তার, তুলে নিয়ে যাওয়া এবং হতাহতের শিকার হওয়ার নজির নেই। পুলিশের গুলিতে নিহত হলে অন্তত লাশটা যেন পরিবারের কাছে যায়, তাই পকেটে এক চিরকুটসমেত প্রতিদিন রাস্তায় নামতাম। ৩ আগস্ট লাখো জনতার উপস্থিতিতে নাহিদ ইসলাম অভিনব এক দফা ঘোষণা করলেন : ‘ফ্যাসিবাদের পতন এবং ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ।’ তা ছিল-‘এক দফা এক দাবি, অমুক তুই কবে যাবি’-এর তুলনায় আলাদা। তরুণদের অভ্যুত্থান-পরবর্তী রাজনীতি বুঝতে হলে এই এক দফার গভীর অনুধাবন প্রয়োজন।
৪ আগস্ট আরেক ছাত্রনেতা আসিফ সারা দেশের জনগণকে পরের দিন (৫ আগস্ট) ঢাকায় আসতে আহ্বান জানালেন। ‘ছাড়তে হবে ক্ষমতা, ঢাকায় আসো জনতা…’ এই কাব্যিক আহ্বানে সাড়া দিয়ে ৫ আগস্ট বাংলাদেশে ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে। ৪ আগস্ট রাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছিলাম : ‘ডিয়ার ঢাকা! হু উইল ফল টুমোরো? ইউ অর মাস মার্ডারার হাসিনা? প্লিজ ডিসাইড!’
হাসিনা টিকে যাওয়া মানে ছিল ঢাকার পতন, ঢাকাবাসীসহ সারা দেশের মানুষের পতন। আর গণঅভ্যুত্থানের নগরী ঢাকার দাঁড়িয়ে যাওয়া মানে ছিল হাসিনার পতন।
আমাদের গড়ে তুলেছে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান। আমরা এই গণঅভ্যুত্থানের রুহানি সন্তান। আবার এটাও ঠিক, আমাদের বিগত কয়েক বছরের লাগাতার বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতায় আওয়ামী বয়ান কারখানা ধসে পড়েছিল। সেই অর্থে এই অভ্যুত্থানও অনেকটা আমাদের সৃষ্টি। এ দেশের জনগণের ঐতিহাসিক এক অর্জন। তবে এই অভ্যুত্থানকে সফল করতে এখনো অনেক কাজ বাকি। ইতোমধ্যেই পুরোনো ফ্যাসিবাদী ক্ষমতা নিজেকে সংহত করতে সক্ষম হয়েছে। গণক্ষমতার সাময়িক পশ্চাদপসরণ ঘটেছে। ইতিহাস সাক্ষী যে গণক্ষমতার উদ্বোধন জুলাই করেছে, তা বিফল হতে পারে না। আরেক জুলাই সেসব ইশারাসহ হাজির।
বছর ঘুরে আরেক জুলাই এসে হাজির। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হওয়ার পর ‘জুলাই’ শুধু মাস নয়; এটি এখন একটি চিহ্নে পরিণত হয়েছে, যার মধ্য দিয়ে আমরা ন্যায়-অন্যায়, গণতান্ত্রিকতা, ফ্যাসিবাদ ইত্যাদির ব্যাপারে সিদ্ধান্তে আসতে পারি। হঠাৎ মনে হলো কি, এক তীব্র অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়েই না গত বছরের এ মাসটি আমরা পার করেছি! ফ্যাসিবাদী ও অবৈধ আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ বিস্ফোরণের অপেক্ষায় ছিল। অবশেষে কোটা সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটল।
শুরু থেকেই এ আন্দোলনের প্রতি আমাদের সমর্থন ছিল। তবে ১৪ জুলাই গণহত্যাকারী পলাতক শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলে গালি দেওয়ার পর আন্দোলন আর কোটায় সীমাবদ্ধ থাকেনি। ১৬ জুলাই আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে শহীদ হওয়ার পর সারা দেশে আন্দোলন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। তারপর দিন, অর্থাৎ, ১৭ জুলাইয় আবু সাঈদের সর্বশেষ ফেসবুক পোস্ট আমার নজরে আসে। তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছিলাম ‘অভ্যুত্থান চাইলেই অভ্যুত্থান হয় না; আবার যদি হতে থাকে, তাহলে শত আপত্তি দিয়েও তা ঠেকানো যায় না। ১৬ জুলাই আবু সাঈদের শহীদির মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতি গণঅভ্যুত্থান পর্বে ঢুকে গেছে। একে আর পেছনে ফেরানো যাবে না।’
মূলত আবু সাঈদ শহিদ হওয়ার ঘটনা সারা দেশের শিক্ষার্থী সমাজসহ জনসাধারণকে তুমুলভাবে নাড়া দেয়। এদিকে আন্দোলনকারী নেতৃত্ব বাংলা ব্লকেড, কমপ্লিট শাটডাউন ইত্যাদি সফল কর্মসূচি ঘোষণা করছিল; অন্যদিকে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকার সব রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে কারফিউ জারির মাধ্যমে বাংলাদেশকে লাশের কারবালায় পরিণত করেছিল।
আমার বিবেচনায় ১৬ থেকে ২০ জুলাই বাংলাদেশে প্রথম পর্বের গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়ে গিয়েছিল। সে সময় ফেসবুকে লিখেছিলাম- ‘১৬-২০ জুলাইয়ের বাংলাদেশ কাঁপানো পাঁচ দিনের অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের রাজনীতি নতুন ঐতিহাসিক পর্বে প্রবেশ করল। গণরাজনৈতিক ধারার জন্য এ সময়টা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।’
কিন্তু আবু সাঈদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি গণঅভ্যুত্থান পর্বে ঢুকে গেছে— এতটা নিশ্চিত করে বলতে পেরেছিলাম কীভাবে? নিরস্ত্র আবু সাঈদ পুলিশের গুলির সামনে নিজের বুক পেতে দিয়েছিলেন। সাঈদ তার সর্বশেষ ফেসবুক পোস্টে উনসত্তরের পাকিস্তানি সামরিক স্বৈরশাসক আইয়ুববিরোধী ছাত্র-শ্রমিক-জনতার গণঅভ্যুত্থানের বীর শহীদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রক্টর অধ্যাপক শামসুজ্জোহাকে স্মরণ করেছিলেন। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা যেন ছাত্রদের গুলি করতে না পারে, সে জন্য অধ্যাপক জোহা ছাত্রদের ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন এবং বুকের তাজা রক্ত দিয়ে ছাত্রদের রক্ষা করেছিলেন।
সাঈদের ওই ফেসবুক স্ট্যাটাস আমার মধ্যে তীব্র এক অনুভূতি তৈরি করে। কীভাবে ইতিহাস হানা দেয়, বর্তমানে তা যেন প্রত্যক্ষ করলাম! উনসত্তর এসে মিলে গেল চব্বিশে, রাজশাহী থেকে রংপুর হয়ে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ল বিদ্রোহের আগুন।
আসলে জুলাইয়ের শেষ পনেরো দিন কেটেছে চরম উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তায়। ১৯ জুলাই পল্টন থেকে প্রেসক্লাব অভিমুখী আমাদের মিছিলে গুলি চালায় পুলিশ। এরপর আমরা সাময়িক সময়ের জন্য হাইড আউটে যেতে বাধ্য হই। শুরু হয় ইন্টারনেট ব্ল্যাক আউট। একদিকে রাজপথে প্রতিবাদ, মিছিল সমাবেশ করছিলাম; অন্যদিকে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে সক্রিয়ও ছিলাম। আবু সাঈদ শহীদ হওয়ার পরই আমরা গণঅভ্যুত্থানের আঁচ টের পেয়েছিলাম। বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থান হওয়া উচিত—এ ব্যাপারে আমার কখনো কোনো সংশয় ছিল না। কিন্তু ১৬ জুলাইয়ের পর থেকে তা আর ঔচিত্যের পর্যায়ে ছিল না; বাঁচার দাবিতে পরিণত হয়েছিল। ১৬-৩১ জুলাই বিভিন্ন ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে থিসিস আকারে আমি বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ কখনো ডায়েরিতে, কখনো ফেসবুকে টুকরা টুকরা পোস্টের মাধ্যমে, কখনো হোয়াটসঅ্যাপ চ্যানেলে টুকে রাখছিলাম ‘জুলাই থিসিস’র ৪ নম্বর পয়েন্টে লিখেছিলাম, ‘শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে লাশের কারবালায় পরিণত করেছেন। হেলিকপ্টার থেকে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি, হাই রাইজ বিল্ডিং থেকে স্নাইপার দিয়ে গুলি—এর আগে কখনোই বাংলাদেশে কোনো আন্দোলন দমনে দেখা যায়নি। একটা সরকার স্বৈরাচারী হতে পারে। বাংলাদেশের মানুষের স্বৈরাচারী সরকারের অভিজ্ঞতা বহু পুরোনো। কিন্তু জুলাই অভ্যুত্থান যেভাবে দমন করা হচ্ছে, তা নজিরবিহীন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশ কোনো হানাদার সরকারের অধীনে পরাধীন হয়ে আছে। এ যেন আরেক মুক্তির সংগ্রাম। একমাত্র কাশ্মীর ও পশ্চিমতীরের সঙ্গে এ পরিস্থিতি তুলনীয়। কার/কাদের নির্দেশে শেখ হাসিনা এই পথ ধরলেন, তা সময়ই বলে দেবে।… আওয়ামী লীগ দিল্লির দখলদারত্বের স্থানীয় এজেন্টের ভূমিকা পালন করছে।’
আন্দোলন দমনে হাসিনারা যতগুলো যুক্তি ব্যবহার করেছে, তার সবগুলোই দিল্লি-ইসরাইলি ব্লকের আন্দোলন দমনের কৌশলের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। সেই প্রেক্ষাপটে লিখেছিলাম, ‘পুরো মডেলটা হচ্ছে ইসরাইলি কাউন্টার ইন্সার্জেন্সি ও কাউন্টার টেররিজমের মডেল। দিল্লি ইসরাইলের কাছ থেকে স্রেফ অস্ত্র ও যন্ত্রপাতিই কেনে না; সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে নিরাপত্তার মতাদর্শ এবং পদ্ধতিও রপ্ত করে। কাশ্মীরসহ ইন্ডিয়ার নানা জায়গায় এই মডেল অলরেডি পরীক্ষিত। এবার আমাদের এখানে প্রয়োগ করা হলো। আওয়ামী লীগ সরকার এবার পুরো বয়ানটাকে জঙ্গিবাদের দিকে নিয়ে গেছে। ইসরাইলের প্রশিক্ষণে ইন্ডিয়ার পুলিশের ক্রমাগত সামরিকায়ন ঘটেছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ইন্ডিয়ার সামরিক প্রশিক্ষণ আদান-প্রদানের নানা সমঝোতা ও চুক্তি বিদ্যমান।’
বাংলাদেশের ইতিহাসে একসঙ্গে এত বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী ও তরুণ গ্রেপ্তার, তুলে নিয়ে যাওয়া এবং হতাহতের শিকার হওয়ার নজির নেই। পুলিশের গুলিতে নিহত হলে অন্তত লাশটা যেন পরিবারের কাছে যায়, তাই পকেটে এক চিরকুটসমেত প্রতিদিন রাস্তায় নামতাম। ৩ আগস্ট লাখো জনতার উপস্থিতিতে নাহিদ ইসলাম অভিনব এক দফা ঘোষণা করলেন : ‘ফ্যাসিবাদের পতন এবং ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ।’ তা ছিল-‘এক দফা এক দাবি, অমুক তুই কবে যাবি’-এর তুলনায় আলাদা। তরুণদের অভ্যুত্থান-পরবর্তী রাজনীতি বুঝতে হলে এই এক দফার গভীর অনুধাবন প্রয়োজন।
৪ আগস্ট আরেক ছাত্রনেতা আসিফ সারা দেশের জনগণকে পরের দিন (৫ আগস্ট) ঢাকায় আসতে আহ্বান জানালেন। ‘ছাড়তে হবে ক্ষমতা, ঢাকায় আসো জনতা…’ এই কাব্যিক আহ্বানে সাড়া দিয়ে ৫ আগস্ট বাংলাদেশে ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে। ৪ আগস্ট রাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছিলাম : ‘ডিয়ার ঢাকা! হু উইল ফল টুমোরো? ইউ অর মাস মার্ডারার হাসিনা? প্লিজ ডিসাইড!’
হাসিনা টিকে যাওয়া মানে ছিল ঢাকার পতন, ঢাকাবাসীসহ সারা দেশের মানুষের পতন। আর গণঅভ্যুত্থানের নগরী ঢাকার দাঁড়িয়ে যাওয়া মানে ছিল হাসিনার পতন।
আমাদের গড়ে তুলেছে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান। আমরা এই গণঅভ্যুত্থানের রুহানি সন্তান। আবার এটাও ঠিক, আমাদের বিগত কয়েক বছরের লাগাতার বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতায় আওয়ামী বয়ান কারখানা ধসে পড়েছিল। সেই অর্থে এই অভ্যুত্থানও অনেকটা আমাদের সৃষ্টি। এ দেশের জনগণের ঐতিহাসিক এক অর্জন। তবে এই অভ্যুত্থানকে সফল করতে এখনো অনেক কাজ বাকি। ইতোমধ্যেই পুরোনো ফ্যাসিবাদী ক্ষমতা নিজেকে সংহত করতে সক্ষম হয়েছে। গণক্ষমতার সাময়িক পশ্চাদপসরণ ঘটেছে। ইতিহাস সাক্ষী যে গণক্ষমতার উদ্বোধন জুলাই করেছে, তা বিফল হতে পারে না। আরেক জুলাই সেসব ইশারাসহ হাজির।
সকালে ফোনটা হাতে নিয়ে আমি যে খবরটা পড়লাম, সেটা আমি আগেই কিছুটা আন্দাজ করেছিলাম—‘যুদ্ধবিরতির আলোচনা ভেস্তে গেছে অথবা যাচ্ছে
৮ ঘণ্টা আগেবিচারহীনতার সংস্কৃতি আমাদের সমাজে এতটাই জেঁকে বসেছে যে, তা একটি দীর্ঘস্থায়ী ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে
৮ ঘণ্টা আগেইরানের পরমাণু কর্মসূচির বিরুদ্ধে পশ্চিমারা যতটাই সরব, ইসরাইলের পরমাণু কর্মসূচির বিরুদ্ধে ততটাই নীরব।
৮ ঘণ্টা আগেআন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বিএনপির অবস্থান আরো স্পষ্ট ও পরিণত করতে ‘ব্যালান্সড ফরেইন পলিসি’ ধারণাকে গুরুত্ব দিতে হবে।
৮ ঘণ্টা আগে