অমিত শাহের বন্ধু পরিচয়ে দাদাগিরি আ.লীগ নেতার

রাকিব হোসেন, ঢাকা দক্ষিণ
প্রকাশ : ১১ নভেম্বর ২০২৫, ১১: ০৪
আপডেট : ১১ নভেম্বর ২০২৫, ১১: ০৫

ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা শামীম রেজা গত সরকারের আমলে দাদাগিরি করতেন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর বন্ধু পরিচয়ে। ‘মুজিব কোটের ফেরিওয়ালা’হিসেবে পরিচিত শামীম রাতেও ঘুমাতেন মুজিব কোট পরে। সুযোগ সন্ধানী, ধাপ্পাবাজ ও বহুরূপী এই আওয়ামী লীগ নেতার সদর্প পদচারণা ছিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে শুরু করে সচিবালয়ের প্রতিটি দপ্তরে। বৈধ-অবৈধ নানা ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত থাকলেও সরকারের কর ফাঁকি দিয়েছেন কোটি কোটি টাকা।

তার বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের শাসনামলে ‘র’-এর এজেন্ট ও ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর বন্ধু পরিচয়ে নির্বাচনে নমিনেশন পাইয়ে দেওয়া, নিয়োগবাণিজ্য, ভূমিদস্যুতা, নিম্নমানের ভবন নির্মাণ, ফ্ল্যাট বিক্রিতে প্রতারণা, ফ্ল্যাট বিক্রির পর হস্তান্তর না করা ও ফ্ল্যাট হস্তান্তরে অতিরিক্ত টাকা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। হাসিনার নির্দেশে তিনি ধানমন্ডি, গুলশান ও উত্তরা এলাকায় জুলাই আন্দোলন দমন-পীড়নে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি ধানমন্ডি ও উত্তরা এলাকায় আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিলে অর্থের জোগান দিচ্ছেন।

বিজ্ঞাপন

তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, তিনি দীর্ঘদিন ধরে ইন্ডিয়ান ইমপোর্টার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সহসভাপতির পদ দখল করে রেখেছেন। পদটি ব্যবহার করে দেশের ব্যবসায়ীদের হয়রানি করেছেন। দখলে রেখেছেন ধানমন্ডির বহুতলবিশিষ্ট জাস্টিস আমিন আহমেদ সেন্টার ।

এছাড়া ইম্পেরিয়াল কনসালটেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড, ইম্পেরিয়াল প্রপার্টিজ লিমিটেড, ইম্পেরিয়াল ট্রেডিং কোম্পানি ও ইম্পেরিয়াল গ্রুপের কর্ণধার শামিম তার স্ত্রী নাইমা খাতুন ঋতুর নামেও সম্পদের পাহাড় গড়েছেন । ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন অভিজাত এলাকায় কমপক্ষে ২৫টি বহুতল বাণিজ্যিক ও আবাসিক ভবনের মালিক তিনি। এছাড়া তার মালিকানায় আরো বহু ভবন নির্মাণাধীন রয়েছে।

সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে তিনি ও তার স্ত্রী এসব সম্পদের মালিক হয়েছেন। তার ব্যক্তিগত ও কোম্পানির আয়কর নথিতে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। উপ-কর কমিশনার ইমদাদুল হক আমার দেশকে বলেন, ইম্পেরিয়াল গ্রুপের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যানুযায়ী সৈয়দ শামীম রেজা বিপুল পরিমাণ সম্পদের তথ্য গোপন ও রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছেন । এ ব্যাপারে তদন্ত করে তাকে আইনের আওতায় আনা হবে।

জানা গেছে, সৈয়দ শামীম রেজার গ্রামের বাড়ি ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারী থানার শেখর ইউনিয়নের সহস্রাইল গ্রামে। তার বাবার নাম অ্যাডভোকেট সৈয়দ চুন্নু । পারিবারিকভাবে সবাই আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তিনি ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা । দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আলফাডাঙ্গা, বোয়ালমারী ও মধুখালী উপজেলা নিয়ে গঠিত ফরিদপুর-১ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছিলেন। তবে এলাকা থেকে তেমন সাড়া পাননি। এর আগে তিনি ২০২০ সালে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের মৃত্যুর পর ঢাকা-১৮ আসনে উপনির্বাচনে নৌকার মনোনয়ন চেয়েছিলেন।

এলাকাবাসীর মতে, সৈয়দ শামীম রেজা ধাপ্পাবাজি করে হাজার কোটি টাকার সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। টাকার বিনিময়ে ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা হয়েছেন।

তার নিজ গ্রামের বাসিন্দা আনোয়ার জানান, শামীম এইচএসসির পর ঢাকা চলে যান । পরবর্তী সময়ে একটি ডেভেলপার কোম্পানির অ্যাকাউন্টেন্ট হিসেবে চাকরি করেন। সেখানে তার বিরুদ্ধে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে। পরে তিনি ঢাকার বনানীতে ইম্পেরিয়াল কনসালটেন্টস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড নামে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।

ফরিদপুর শেখর ইউপির চেয়ারম্যান কামাল আহমেদ আমার দেশকে বলেন, এলাকাবাসীর কাছে তিনি ওয়াদা বরখেলাপকারী, ঠক, প্রতারক হিসেবে পরিচিত। এমনকি আমার সঙ্গেও তিনি প্রতারণা করেছেন।

নাম না বলার শর্তে শামীম রেজার কয়েক ঘনিষ্ঠজন আমার দেশকে জানান, সে একজন ঠক, প্রতারক, তদবিরবাজ ও ভূমিদস্যু। সরকারি চাকরি, টেন্ডারবাণিজ্য ও ভূমিদস্যুতা ছিল তার আয়ের উৎস। মুজিব কোট ছিল তার জাদুর কাঠি। আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে মুজিব কোট পড়ে তিনি সচিবালয় থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় পর্যন্ত আনাগোনা করতেন। সম্পর্ক রাখতেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও মন্ত্রণালয়ের আমলাদের সঙ্গে। নিজেকে পরিচয় দিতেন ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর বন্ধু ও ‘র’-এর এজেন্ট হিসেবে। তার এ পরিচয়কে আরো শক্তিশালী করেছে ইন্ডিয়ান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সহসভাপতি পদ ।

এ ব্যাপারে ইন্ডিয়ান ইমপোর্টার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির ঢাকা অফিসের হেড অব অপারেশন ও অ্যাডমিন পামেলা পাল বলেন, শামীম রেজা এখনো প্রতিষ্ঠানটির সহসভাপতি হিসেবে আছেন। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হওয়ার পর তিনি আর অফিসে আসেন না ।

ধানমন্ডি থানা বিএনপির এক নেতা জানিয়েছেন, ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা শামীম রেজা ধানমন্ডির জাস্টিস আমিন আহমেদ সেন্টার ভবন নির্মাণে অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। অভিযোগ আছে, তিনি রাজউকের নিয়ম ভঙ্গ করে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার ও নকশা পরিবর্তন করেছেন এবং ঘুসের মাধ্যমে অনুমোদন নিয়েছেন। যে কারণে রাজউককে প্রতি মাসে উৎকোচ দিতে হয় পাঁচ থেকে ১০ লাখ টাকা ।

জাস্টিস আমিন আহমেদ ট্রাস্টের সঙ্গে করা বিওটি চুক্তি অনুযায়ী আয়ের ভাগ না দিয়ে তিনি তিন কোটি টাকার বেশি বকেয়া রেখেছেন। ভবনের বিল ও ট্যাক্সসহ আরো প্রায় তিন কোটি টাকা সরকারের পাওনা রয়েছে। ট্রাস্টের তহবিল সংকটে ভবনটিতে থাকা ক্লিনিক কার্যত অচল হয়ে পড়েছে।

এ ব্যাপারে সৈয়দ শামীম রেজার সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার কথা স্বীকার করেন। তার বিরুদ্ধে আনা বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি মোবাইল বন্ধ করে দেন। এরপর একাধিকবার ফোন ও হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ পাঠিয়ে কথা বলার অনুরোধ করা হলেও তিনি আর ফোন ধরেননি।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত