বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী ৮০ শতাংশ মানুষ। এর মধ্যে ৪২ শতাংশ ‘খুবই আশাবাদী’। তবে দেশের সমস্যাগুলো নিয়ে তাদের উদ্বেগও রয়েছে। এর মধ্যে দুর্নীতিকে দেশের প্রধান সমস্যা বলে মনে করছেন নাগরিকরা। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের (আইআরআই) সর্বশেষ জরিপে এমন তথ্য উঠে এসেছে। জরিপে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, গণতন্ত্র, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও দুর্নীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে নাগরিকদের মূল্যায়ন স্থান পেয়েছে।
চলতি বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে ১২ অক্টোবর পর্যন্ত দেশের আটটি বিভাগে এ জরিপ পরিচালনা করে আইআরআইয়ের প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইনসাইটস ইন সার্ভে রিসার্চ। ‘ন্যাশনাল সার্ভে অব বাংলাদেশ, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ২০২৫’ শিরোনামে গত সোমবার সংস্থাটির ওয়েবসাইটে ফল প্রকাশ করা হয়।
পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা গেছে, জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৫৩ শতাংশ মনে করেন দেশ সঠিক পথে এগোচ্ছে, যেখানে ৪২ শতাংশ ভিন্নমত দিয়েছেন। উন্নতির কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করেছেন অর্থনৈতিক অগ্রগতি, আইনশৃঙ্খলার উন্নতি ও খাদ্য নিরাপত্তা। অন্যদিকে যারা মনে করেন দেশ ভুল পথে যাচ্ছে, তারা প্রধান কারণ হিসেবে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধিকে দায়ী করেছেন। তবে এসব সত্ত্বেও দেশ নিয়ে আশাবাদী তারা। কিন্তু এ আশাবাদের পথে অন্তরায় দুর্নীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, আইনশৃঙ্খলার সমস্যা, বেকারত্ব ইত্যাদি।
জরিপের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশের ২১ শতাংশ নাগরিক দুর্নীতিকে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন আর ১৮ শতাংশের কাছে বড় সমস্যা দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা। দেশের নাগরিকদের বড় এটি অংশের মত, চাকরি পেতে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতির শিকার হতে হয়। ৩০ শতাংশ মানুষের ভাবনা এমনই। অন্যদিকে ১৮ শতাংশ নাগরিক মনে করেন সরকারি জাতীয় চুক্তিগুলোয় দুর্নীতি হয়।
দেশের দুর্নীতি বন্ধ না হওয়ার পেছনে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণকে দায়ী করেছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী। তিনি বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) অন্যান্য দেশের মতো নির্বাহীর নিয়ন্ত্রণ থেকে বের করে আনতে হবে। তা না হলে রাজনীতিবিদদের দুর্নীতি দমনে তারা ভূমিকা রাখতে পারবে না। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এ সুপারিশ দিয়েছে। কিন্তু দুদককে স্বাধীন করার বিষয়টি অন্তর্বর্তী সরকারই বাদ দিচ্ছে বলে মনে হয়।
এদিকে, আইআরআইয়ের জরিপে অংশ নেওয়া ৪৮ শতাংশ মানুষ আগামী বছর দেশের অর্থনীতি আরো ভালো হবে বলে মনে করেন। মাত্র ১৮ শতাংশ মনে করেন, অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপের দিকে যাবে। ৭২ শতাংশ অংশগ্রহণকারী বলেছেন, দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রয়েছে।
জরিপের পরিসংখ্যান অনুযায়ী রাজনৈতিক দলের মধ্যে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলকে (বিএনপি) পছন্দ করেন ৫১ শতাংশ মানুষ। অন্যদিকে ৫৩ শতাংশ মানুষ জামায়াতে ইসলামীকে পছন্দ করেন বলে জানিয়েছেন। বিএনপিকে অপছন্দ করেন ৪৩ শতাংশ এবং জামায়াতে ইসলামীকে ৪০ শতাংশ। এছাড়া জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ও কার্যক্রম নিষিদ্ধ দল আওয়ামী লীগকে যথাক্রমে ৩৮, ৩৩ ও ২৫ শতাংশ মানুষ পছন্দ করেন।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দেবেন কি না- জানতে চাইলে ৬৬ শতাংশ অংশগ্রহণকারী জানিয়েছেন, তারা অবশ্যই ভোট দেবেন। ভোট দেওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে জানিয়েছেন আরো ২৩ শতাংশ মানুষ। অন্যদিকে, মাত্র ৯ শতাংশ মানুষ জানিয়েছেন তারা সম্ভবত ভোট দেবেন না।
আগামী সপ্তাহে ভোট হলে কোন দলকে ভোট দেবেন- এমন প্রশ্নে ৩০ শতাংশ অংশগ্রহণকারী বিএনপির কথা বলেছেন, যেখানে ২৬ শতাংশ মানুষ জামায়াতে ইসলামীকে ভোট দেবেন বলে জরিপে উঠে এসেছে। অন্যদিকে এনসিপিকে ৬ শতাংশ, জাতীয় পার্টিকে ৫ এবং ইসলামী আন্দোলনকে ৪ শতাংশ মানুষ ভোট দেওয়ার কথা জানিয়েছেন। অন্য দলগুলোর ভোট রয়েছে ১১ শতাংশ। ৭ শতাংশ ভোটার জানিয়েছেন, তারা কাকে ভোট দেবেন সে বিষয়ে এখনো নিশ্চিত নন। এ প্রশ্নের উত্তর দিতে অস্বীকার করেন ১১ শতাংশ ভোটার।
তবে আগামী নির্বাচনে ইসলামী দলগুলো বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ জোটবদ্ধ নির্বাচন করলে সেটি বিএনপির জন্য চ্যালেঞ্জ হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। এ পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেও দুই দলের ভোট বিএনপির সমান। সেক্ষেত্রে অন্য যেসব দল ও সাধারণ ভোটার আছে, তারা মূল ব্যবধান গড়ে দেবে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিএনপি-জামায়াতের জনসমর্থন প্রায় কাছাকাছি পর্যায়ে রয়েছে। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন বাড়তে দেখা যাচ্ছে। এর কারণ হিসেবে দুই দলের মধ্যে দুর্নীতি করা না করার বিষয়টি রয়েছে বলে মনে করেন ড. দিলারা চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘জামায়াতের একটা সুনাম আছে, তারা দুর্নীতিবাজ নয়। মানুষ বলছে, বিএনপি-আওয়ামী লীগ- দুটিই দেখলাম, এবার জামায়াতকে দেখব। জামায়াত সরকার গঠন করতে পারবে কি না আমি জানি না। তবে একটি ভালোসংখ্যক আসন নিয়ে তারা সংসদে যাবে বলে মনে হয়। সেটা একদিক দিয়ে ভালো, সংসদে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল আসবে।
বিএনপির আগামীর রাজনীতি নিয়ে ড. দিলারা চৌধুরী বলেন, যদি খালেদা জিয়ার কিছু হয় আর তারেক জিয়া আসতে না পারেন আমার মনে হয় নির্বাচনটা তাহলে পিছিয়ে যাবে।’
এদিকে জরিপের ফলাফল অনুযায়ী, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর দেশের বেশিরভাগ মানুষের আস্থা ও সন্তুষ্টি রয়েছে। জরিপে অংশ নেওয়া ৬৯ শতাংশ মানুষ ড. ইউনূসকে সমর্থন করেছেন, আর ৭০ শতাংশ বর্তমান সরকারের কার্যক্রমে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। যেখানে ২৬ শতাংশ মানুষ এর বিরোধিতা করেছেন এবং বাকি চার শতাংশ মানুষ কোনো মতামত দেননি।
জরিপের তথ্যে আরো দেখা গেছে, ৬৯ শতাংশ অংশগ্রহণকারী মানুষ জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত করাকে তারা সমর্থন করেন। এ ছাড়া দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ মনে করেন ভবিষ্যতের নির্বাচন সুষ্ঠু হবে। জরিপে অংশ নেওয়া প্রায় ৫২ শতাংশ জানিয়েছেন, তারা দেশে নতুন রাজনৈতিক দল দেখতে চান। যেখানে ৪৩ শতাংশ বর্তমান দলগুলোর ওপর সন্তুষ্টি ব্যক্ত করেছেন।
অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২৮ শতাংশ মানুষ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজনকে বর্তমান সরকারের সবচেয়ে বড় সংস্কার বলে মনে করেন। আর ৭৪ শতাংশ মনে করে বর্তমান সরকার সুন্দরভাবে সংস্কার কাজ শেষ করতে পারবে।
জরিপের তথ্য অনুযায়ী, পলিটিক্যাল এলিট ও জনগণের মধ্যে বিশাল দূরত্ব দেখছেন ৮৮ শতাংশ মানুষ। ৯ শতাংশ মানুষ মনে করছেন এর বিপরীত। অন্যদিকে ধর্ম ও জাতীয়তার ভিত্তিতে বৈষম্য রয়েছে বলে দাবি জানিয়েছেন ৩৪ শতাংশ মানুষ। ৬১ শতাংশের দাবি এর চেয়ে ভিন্ন। জরিপে গণমাধ্যমের ওপর আস্থা রয়েছে ৬০ শতাংশ মানুষের।
জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশের ওপর সবচেয়ে বেশি (৬৩ শতাংশ) ইতিবাচক প্রভাব আছে রাশিয়ার। আর সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাব (৬০ শতাংশ) রয়েছে ভারতের। সেনাবাহিনীর কাজে আস্থা রয়েছে ৭৯ শতাংশ মানুষের।
এ ছাড়া সমযোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও নারীদের কর্মক্ষেত্রে নিয়োগের পক্ষে মত দিয়েছেন মাত্র ১৬ শতাংশ মানুষ। আর পুরুষদের নিয়োগের পক্ষে মত ৬২ শতাংশের। তবে ২০ শতাংশ মনে করেন এক্ষেত্রে বৈষম্য করা ঠিক নয়।
আইআরআইয়ের পরিসংখ্যানমতে, স্বাধীনভাবে রাজনৈতিক মতপ্রকাশ করতে পারেন বলে মনে করেন ৬৩ শতাংশ মানুষ। ৩৫ শতাংশ তা মনে করেন না। ৯০ শতাংশ মানুষ মনে করেন দেশে সবার সমান অধিকার রয়েছে। গত এক বছরে রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব বেড়েছে বলে মনে করেন ৫০ শতাংশ অংশগ্রহণকারী। তবে ২৬ শতাংশের দাবি, অবস্থা অপরিবর্তিত রয়েছে।
দেশের পূর্ববর্তী নির্বাচনগুলো অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি বলে মনে করেন ৬৭ শতাংশ অংশগ্রহণকারী। ৩০ শতাংশের দাবি এর বিপরীত। আওয়ামী লীগের পতন হওয়া আন্দোলনের পক্ষে সমর্থন দিয়েছেন ৭০ শতাংশ নাগরিক, এর বিরোধিতা করেন ২৩ শতাংশ। অন্তর্বর্তী সরকারকে বৈধ বলে মনে করেন ৬৪ শতাংশ মানুষ।
এদিকে জরিপের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম আমার দেশকে বলেন, দেশ নিয়ে একটা বড়সংখ্যক মানুষ আশাবাদী, তবে যুবক ও তরুণদের দৃষ্টিভঙ্গিও মূল্যায়ন করতে হবে। তাদের মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ মনে করছে, দেশ ভুল পথে যাচ্ছে। এ জন্য দুর্নীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, বেকারত্ব ও দ্রব্যমূল্যের বিষয়টি অন্তর্বর্তী সরকারকে বিবেচনায় নিতে হবে। আওয়ামী লীগ আমলে দেশের ভঙ্গুর দশার বিষয়ে ইঙ্গিত দিয়ে তিনি বলেন, এ অবস্থা থেকে উত্তরণ সহজসাধ্য কাজ নয়। অন্তর্বর্তী সরকার সে কাজটা করতে চেষ্টা করছে। তবে এ কাজে সরকারকে আরো বেশি মনোযোগী হতে হবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি সমর্থনের বিষয়ে ড. মঈনুল ইসলাম বলেন, যেই সময়ে জরিপ চালানো হয়েছে সেই সময়টাতে মানুষ সঠিকভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে কি না সেটি নিশ্চিত নয়। কারণ তখন নির্বাচনের সময়সীমা স্পষ্ট ছিল না। এ ছাড়া অনেকেই তাদের প্রার্থী চয়েস করতে পারেননি। তবে এখন করলে এটার সঙ্গে জরিপের পার্থক্য হবে।

