বাংলাদেশের বিদ্যমান সংবিধান প্রধানমন্ত্রীকে স্বৈরশাসকে পরিণত করেছে বলে উল্লেখ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। রাষ্ট্রপতিকে আলঙ্কারিক পদ উল্লেখ করে কমিশন তার প্রতিবেদনে বলেছে, প্রধানমন্ত্রীর হাতে ক্ষমতার এত ব্যাপক কেন্দ্রীকরণ তাকে স্বৈরশাসকে পরিণত করেছে। ১৯৭২ সালে শেখ মুজিবুর রহমান নিজ হাতে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা কাটছাঁট করে প্রধানমন্ত্রীর হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করেছে বলে কমিশনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
অধ্যাপক আলী রীয়াজের নেতৃত্বাধীন সংবিধান সংস্কার কমিশন গত ১৫ জানুয়ারি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়। ওই দিনই প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ প্রকাশ করা হয়। গত ৮ ফেব্রুয়ারি কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওয়েবসাইটে আপলোড করা হয়। প্রতিবেদনে সংবিধান বিশেষজ্ঞ একাধিক লেখক, আইনজীবীর বিভিন্ন ধরনের লেখা ও বইয়ের উদাহরণও তুলে ধরা হয়।
কমিশন তার সুপারিশে সংবিধান সহজবোধ্য করতে বিদ্যমান সাধু ভাষার পরিবর্তে চলিত ভাষায় এবং প্রমিত বাংলা বানানে লেখার বিষয়টি বিবেচনার আনার কথা বলেছে। এতে বলা হয়, সংবিধানের ভাষা সহজ করা সংবিধানের আকার ছোট করার বিষয়ে অংশীজন মতামত দিয়েছেন। কমিশন মনে করে, ভবিষ্যতে এ বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হবে।
বিদ্যমান সংবিধান জবাবদিহিমূলক ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে সাংঘর্ষিক উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৭২ সালের সংবিধান গণক্ষমতাকে পাকাপোক্ত না করে ঔপনিবেশিক প্রশাসনিক রাষ্ট্র কাঠামোকেই অক্ষুণ্ণ রাখা হয়েছে।
ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদের এক লেখা উদ্ধৃত করে প্রতিবেদনে বলা হয়, রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার ব্যবস্থায় যেমন রাষ্ট্রপতির হাতে ক্ষমতা এককেন্দ্রীকরণ ঘটে, ঠিক তেমনি এই ক্ষেত্রে ক্ষমতা এককেন্দ্রীকৃত হয়ে গেছে প্রধানমন্ত্রীর হাতে। সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা এককেন্দ্রীকরণ ঘটানোর ও মৌলিক অধিকার হরণের ব্যবস্থাদি সংবিধানে রয়ে গেছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক মঈনুল ইসলামের ‘সংবিধানের যে ভুল সংশোধন না করলে রাষ্ট্র সংস্কার অসম্ভব’ লেখার বিষয়টি তুলে ধরে সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়Ñসংবিধানের আরেকটি মারাত্মক ত্রুটি হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীকে ‘নির্বাচিত একনায়কের’ ক্ষমতা দিয়ে সর্বশক্তিমান করে ফেলার ব্যবস্থা করা। ১৯৭২ সালে যখন সংবিধানটি প্রণয়ন করা হয়, তখন প্রধানমন্ত্রীর আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। খসড়া সংবিধান শেখ মুজিবের কাছে পেশ করা হলে তিনি নিজের হাতে কেটেছেঁটে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাকে রাষ্ট্রপতির তুলনায় একচ্ছত্র করার ব্যবস্থা করেছিলেন। ফলে রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতাহীন বানিয়ে ফেলা হয়েছিল।
কমিশন তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন, বিদ্যমান সংবিধানে আইনসভা, নির্বাহী বিভাগ ও অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিচার বিভাগসহ রাষ্ট্রের সব অঙ্গের ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর কাছে কেন্দ্রীভূত করা হয়েছে। এই কেন্দ্রীকরণ রাজনৈতিক ব্যবস্থার ভেতরে যেমন সম্প্রতি নষ্ট করেছে, তেমনি ধ্বংস করেছে ভারসাম্য। রাষ্ট্রের সব কর্তৃত্ব প্রধানমন্ত্রীর হাতে ন্যস্ত। ৭০ অনুচ্ছেদে সংসদ নেতা হিসেবে তার ইচ্ছা অনুযায়ী, দলীয় সদস্যদের ভোট দেওয়ার নির্দেশ দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। প্রতীকী নেতা হিসেবে প্রায় প্রতিটি কাজ রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ মোতাবেক করতে হয়।
বিদ্যমান ব্যবস্থায় কেবল প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ ও সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি নিয়োগে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ না করে নিজে নিয়োগ দিতে পারেন। হাইকোর্ট ও অধস্তন বিচারক প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ মোতাবেক করতে হয়।
তবে কমিশন তার প্রতিবেদনে দাবি করেছে, সংবিধানে উল্লেখ থাকলেও রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়া প্রধান বিচারপতি নিয়োগের বাস্তবিক কোনো তাৎপর্য নেই। কেননা সাধারণত প্রধানমন্ত্রীর পছন্দসই ও বিশ্বস্ত দলীয় প্রার্থীই রাষ্ট্রপতি হন। সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় প্রধান বিচারপতি নিয়োগে রাষ্ট্রপতি কখনো প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ উপেক্ষা করেননি বলেও প্রতিবেদনে দাবি করা হয়।
সংস্কার কমিশন রাষ্ট্রপতির কিছু সুনির্দিষ্ট দায়িত্বের সুপারিশ করছে। সুপারিশে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক, মহাহিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং আইন দ্বারা নির্ধারিত অন্য কোনো পদে রাষ্ট্রপতি একক ক্ষমতা বলে নিয়োগ দেবেন বলে সুপারিশ করেছেন। এই বিশেষ কার্যাবলি কিংবা সংবিধানে উল্লিখিত বিষয় ছাড়া অন্য সব বিষয়ে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে কাজ করবেন বলে সুপারিশ করেছে।
এদিকে কমিশন জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন বন্ধে সংস্কার কমিশন আপিল বিভাগের বিচারকের মধ্য থেকে মেয়াদের ভিত্তিতে জ্যেষ্ঠতম বিচারককে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগের সুপারিশ করেছে।
আইনসভার নিম্নকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সমর্থনে প্রধানমন্ত্রী মনোনীত হবেন বলে সংস্কার কমিশন সুপারিশ করেছে। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বিদ্যমান সংবিধানে ৭ (খ) বিধান যুক্ত করে সংবিধানের এক-তৃতীয়াংশের বেশি বিধান ‘সংশোধন-অযোগ্য’ ঘোষণা করার যে বিধান করেছিল, সংস্কার কমিশন সেটাকে ‘সাংবিধানিক হাতকড়া’ হিসেবে উল্লেখ করে ওই অনুচ্ছেদ বাতিলের সুপারিশ করেছে।
বর্তমান যুগে সমাজতন্ত্র অনেকটাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে উল্লেখ করে সমাজতন্ত্র বাদ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। অধস্তন আদালতের পরিবর্তে স্থানীয় আদালত করার সুপারিশ করেছে। ‘অধস্তন আদালত’ অভিব্যক্তিটি আদালতগুলোর মর্যাদা ও মূল্যবোধের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ উল্লেখ করে এ সুপারিশ করা হয়।
এদিকে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) নির্বাচন কমিশনের প্রধানসহ অন্যান্য কমিশনার; অ্যাটর্নি জেনারেল; সরকারি কর্ম কমিশনের প্রধানসহ অন্যান্য কমিশনার; দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রধানসহ অন্যান্য কমিশনার; মানবাধিকার কমিশনের প্রধানসহ অন্যান্য কমিশনার; প্রধান স্থানীয় সরকার কমিশনারসহ অন্যান্য কমিশনার; প্রতিরক্ষা বাহিনীগুলোর প্রধান এবং আইন দ্বারা নির্ধারিত অন্য কোনো পদে নিয়োগের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাবেন বলে সুপারিশ করেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সংবিধান সংস্কার কমিশনের সদস্য ইমরান সিদ্দিকী আমার দেশকে বলেন, বিদ্যমান সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীকে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দিয়েছে। এই ক্ষমতা তাকে স্বৈরশাসকে পরিণত করেছে। শেখ মুজিবুর রহমান নিজ হাতে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা একচ্ছত্র করেছিলেন।
ইমরান সিদ্দিকী জানান, কমিশন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ভারসাম্য আনার জন্য বেশ কিছু সুপারিশ করেছে। বিচারক নিয়োগের ক্ষমতা পুরোটাই রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত করার কথা বলেছেন। অবশ্য এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির বিশেষ কিছু করণীয় থাকবে না। কারণ তারা সুপারিশে বলেছে আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারকদের প্রধান বিচারপতি নিয়োগের সুপারিশ করেছেন। এ ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের কোনো সুযোগ থাকবে না। এ ছাড়া অন্যান্য সাংবিধানিক পদে নিয়োগে জন্য এনসিসি রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করবে।

