অভ্যন্তরীণ কোন্দলে দলের শীর্ষ নেতারা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হওয়ায় নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়েছে বরিশাল জেলা ও মহানগর বিএনপি। কেউ মানছেন না কাউকে। যে যার মতো নিজস্ব বলয় তৈরি করে নগরীতে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছেন। এতে নেতাকর্মীদের মধ্যে একে অপরের প্রতি বাড়ছে ক্ষোভ, হিংসা আর বিদ্বেষ।
গত ৩০ বছরে এমন করুণ হাল কখনোই দেখেনি বরিশাল জেলা ও মহানগর বিএনপির নেতাকর্মীরা। এই দুরবস্থার অবসান চান দলের ত্যাগী নেতাকর্মীরা। এ ক্ষেত্রে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন তারা।
বিএনপির নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, দীর্ঘ ১৭ বছর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বাইরে থাকায় নেতাকর্মীরা বিভিন্ন সময় হামলা মামলায় জর্জরিত হওয়ায় অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে জেলা ও মহানগর বিএনপির সাংগঠনিক কার্যক্রম। ফলে দীর্ঘদিন কোনো কমিটিও গঠন করা যায়নি। ভারপ্রাপ্ত কিংবা আহ্বায়ক কমিটি দিয়েই চলছিল বিএনপির দলীয় কার্যক্রম।
তবে ৫ আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরপরই সক্রিয় হয়ে ওঠেন নেতাকর্মীরা। এতদিন যারা মাঠে ছিলেন না কিংবা দলীয় কোনো কর্মসূচিতে অংশ নেননি এখন তারাই বিএনপি কিংবা এর অঙ্গ সংগঠনের বড় নেতা বনে গেছেন। তাদের দাপটে অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন দলের ত্যাগী নেতাকর্মীরাও। জেলা ও মহানগরে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব রূপ নিয়েছে চরম বিশৃঙ্খলায়।
সূত্র জানায়, দীর্ঘ ৩০ বছর বরিশাল বিএনপির নেতৃত্বে ছিলেন সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মজিবর রহমান সরোয়ার। এ সময় সরোয়ার অনুসারী একটি বৃহৎ নেতাকর্মী-সমর্থক গোষ্ঠী তৈরি হয়। ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ বিএনপির জাতীয় কাউন্সিলে সরোয়ার কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব হলে বরিশালে বিএনপির রাজনীতিতে ক্রমান্বয়ে কোণঠাসা হয়ে পড়েন তিনি। ২০২১ ও ২০২৪ সালে বরিশাল মহানগর বিএনপির দুটি আহ্বায়ক কমিটি হলেও তাতে সরোয়ারের অনুসারীদের বাদ দেওয়া হয়।
সূত্র মতে, বর্তমানে বরিশাল মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন মনিরুজ্জামান খান ফারুক, ১ নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক আফরোজা খানম নাসরিন ও সদস্য সচিব জিয়াউদ্দিন সিকদার। এর মধ্যে মনিরুজ্জামান ফারুক ও জিয়াউদ্দিন সিকদার মহানগর বিএনপির একাংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
পাশাপাশি মহানগর বিএনপির ১ নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক আফরোজা খানম নাসরিন বিএনপি নেতা হক মাস্টার ও লিটুসহ ছাত্রদল-যুবদলের কিছু নেতাদের নিয়ে আরেক অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
একইভাবে মহানগর বিএনপির সাবেক সদস্য সচিব মীর জাহিদুল কবির জাহিদ কিছু নেতাকর্মীদের নিয়ে আরেক অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এ ছাড়া বিএনপি যেসব নেতার বর্তমান মহানগর কমিটিতে জায়গা হয়নি পদবঞ্চিত এসব নেতার নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য অ্যাডভোকেট মজিবর রহমান সরোয়ার।
মহানগর বিএনপির নেতাদের চতুর্মুখী কর্মকাণ্ডে হযবরল ও নৈরাজ্যকর অবস্থা বিরাজ করছে মহানগর বিএনপিতে। এদিকে শুধু মহানগর বিএনপিই নয়, দক্ষিণ জেলা বিএনপির কমিটি নিয়েও বিরোধে জড়িয়ে পড়ছেন নেতাকর্মীরা।
সূত্র জানায়, বরিশাল জেলা দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির নেতৃত্বে রয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য ও কমিটির আহ্বায়ক আবুল হোসেন খান এবং সদস্য সচিব আবুল কালাম শাহীন।
আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাতসহ বিভিন্ন অভিযোগ এনে তাদের বিপক্ষে পাল্টা বলয় তৈরি করেছেন দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় নেতা অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম খান রাজন। তিনি নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে আবুল হোসেনের নানা অপকর্ম তুলে ধরেছেন। ফলে দক্ষিণ জেলা বিএনপিতে এখন টালমাটাল অবস্থা।
এদিকে দলীয় নেতারা জানিয়েছেন, বরিশাল জেলা ও মহানগর বিএনপিতে গ্রুপিং ভাঙতে কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতে বরিশাল ও ঢাকায় একাধিক বৈঠক হয়েছে। তবে উভয় পক্ষই তাদের দাবির বিষয়ে অনড় থাকায় প্রতিটি বৈঠকই ভেস্তে গেছে।
এ বিষয়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির অন্যতম সদস্য ও বরিশাল সদর-৫ আসনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী আবু নাছের মোহাম্মদ রহমতুল্লাহ আমার দেশকে বলেন, নেতৃত্বে প্রতিযোগিতা থাকা ভালো কিন্তু নোংরামি করে পরস্পরের বিরুদ্ধে কাদা ছোড়াছুড়ি করা দলের জন্য মঙ্গলজনক নয়।
সার্বিক বিষয়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির বরিশাল বিভাগের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আকন কুদ্দুসুর রহমান বলেন, বিএনপি একটি বড় রাজনৈতিক দল। এখানে অভ্যন্তরীণ বিরোধ, প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবে। কিন্তু বরিশাল মহানগর কমিটিতে যা হচ্ছে, তা মেনে নেওয়া যায় না। বিষয়টি নিয়ে হাইকমান্ড অবগত। তারা বিষয়টি দেখবেন।
বরিশাল জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম খান রাজন আমার দেশকে বলেন, এতদিন যারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাত করে রাজনীতি করেছেন, এখন তারা অর্থের বিনিময়ে আওয়ামী লীগকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন। আওয়ামী লীগের লোকজনকে নিজের কর্মী বানাচ্ছেন।
বরিশাল মহানগর বিএনপির সাবেক সদস্য সচিব মীর জাহিদুল কবির জাহিদ জানান, ছাত্রদল, যুবদল ও বিএনপির ত্যাগী নেতাকর্মীরা বর্তমান কমিটির কার্যক্রমে হতাশ ও ক্ষুব্ধ। তিনি বলেন, বর্তমানে ত্যাগী নেতাদের অবমূল্যায়ন করে হাইব্রিড ও অনুপ্রবেশকারীদের নানাভাবে পদ-পদবি দেওয়া হচ্ছে। ফলে মহানগর বিএনপিতে নেতৃত্ব সংকট দেখা দিয়েছে। সেজন্য সাবেক ও বর্তমান ত্যাগী নেতারা ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন।
এ বিষয়ে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট মজিবর রহমান সরোয়ার আমার দেশকে বলেন, আমরা লক্ষ্য করছি বরিশাল জেলা ও মহানগর বিএনপির নেতারা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়েছেন। এতে করে দলের ক্ষতি হচ্ছে। কিন্তু দলের স্বার্থে ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই।

