ক্ষমা চাইলেন রাবি শিক্ষক, বিচার দাবি শিক্ষার্থীদের

রাবি প্রতিনিধি
প্রকাশ : ২৮ অক্টোবর ২০২৫, ১৩: ৩৯
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক আ আল মামুন। ছবি : সংগৃহীত

হিজাব নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক আ আল মামুনের বিতর্কিত মন্তব্যের জেরে ক্যাম্পাসে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। গতকাল সোমবার রাতে তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। এরই মধ্যে ক্ষমা চেয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট করেছেন তিনি। তা সত্ত্বেও তার শাস্তি দাবি করেছেন শিক্ষার্থীরা।

মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে এক ফেসবুক পোস্টে অধ্যাপক আ আল মামুন লিখেছেন, ‘আমি এক-এগারোর সরকারের বিরুদ্ধে মিছিল করে জেল খেটেছি। ২০১৩ সাল থেকে নানাভাবে ক্যাম্পাসে ও ক্যাম্পাসের বাইরে জুলুম-অত্যাচারের ক্রিটিক করেছি ২০২৪ পর্যন্ত, ফেসবুকে এবং বইপত্রে। সে সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। জুলাই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে শিক্ষার্থীদের পাশে ছিলাম। শিক্ষক হিসেবে আন্দোলনকারীদের আগলে রেখেছিলাম। স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পতনমুহূর্তে স্বপ্ন দেখেছিলাম সম্পূর্ণ নতুন এক বাংলাদেশের। কিন্তু এরপরে বহু ঘটনা ঘটেছে, যেমন চেয়েছিলাম, বাংলাদেশ সেদিকে হাঁটেনি। ব্যাপক হতাশা কাজ করে আমার মধ্যে।’

বিজ্ঞাপন

তিনি লিখেছেন, ‘হতাশাগ্রস্ত আমি ঝোঁকের বশে এমন কিছু লিখি, যা লিখা উচিত হয়নি। তা আমি লিখতে চাইওনি। মিস রিডিং হবে বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে আমি পোস্টটি সরিয়ে নিই। পোশাক বিষয়ে আমার ভাবনা পরিষ্কার- পোশাকের কারণে আমি কাউকে বড় বা ছোট করে দেখি না। “হিজাব” ডিফেন্ড করার মতো অনেক পোস্ট পাবেন আমার। এ শিক্ষা আমার “সন্ত্রাসবিরোধী অনন্ত যুদ্ধ”র ক্রিটিক করতে গিয়েই হয়েছে। ফলে আপনারা যা ভাবছেন, সে রকম কোনো উপহাস বা তাচ্ছিল্য আমি করি না। এক মুহূর্তে পোস্ট করে পারসোনালাইজ করেছিলাম, এ নিয়ে আরো ভাবনা-চিন্তা করার জন্য। কিন্তু সেই মুহূর্তেই কেউ এ পোস্ট স্ক্রিনশট নিয়ে ছড়িয়ে দেয়। খেয়াল করলে দেখবেন, ওই পোস্টে কোনো লাইক, কমেন্ট, শেয়ার কিছু নাই, কোনো ইন্টারকশন নাই!’

এই শিক্ষক আরো লিখেন, ‘তারপরও কেউ আঘাত পেয়ে থাকলে, আমি দুঃখিত। আমি সব সময়ই শিক্ষার্থীদের জন্য শুভ কামনা করি। আশা করি, বিভ্রান্তিকর উত্তেজনা এবার প্রশমিত হবে। আমি চাই না, আমাকে কেন্দ্র করে যে উত্তেজনা ছড়িয়েছে, তার প্রেক্ষিতে আমার বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থী কোনো প্রকার অসুবিধার সম্মুখীন হোক বা অন্যান্য বিভাগের শিক্ষার্থীদের সাথে কলহে জড়াক! শুভ কামনা সবার জন্য।’

এদিকে শিক্ষক আল মামুনের বিচারের দাবিতে মঙ্গলবার সকাল ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (রাকসু) প্রতিনিধিরা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মাঈন উদ্দীন খান ও গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক মোজাম্মেল হোসেন বকুলের কাছে স্মারকলিপিটি দেয়া হয়।

RU-Complain

স্মারকলিপিতে তারা লিখেছেন, ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক আ আল মামুন তার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত একাধিক পোস্টে রাকসু নির্বাচনে হল সংসদে বিজয়ী নারী প্রতিনিধিদের ব্যক্তিগত পোশাক, নারীর ধর্মীয় পরিচয় এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতা সম্পর্কে অবমাননাকর ও বিদ্বেষপ্রবণ মন্তব্য করেছেন। পাশাপাশি তিনি আগের পোস্টগুলোতে ‘বোরকা’, ‘কাঠমোল্লা’, ‘মদ’, ‘সেক্সুয়াল রেভল্যুশন’ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করে উস্কানিমূলক কনটেন্ট দিয়েছেন। এক পোস্টে টু-কোয়ার্টার ও মদের বোতল হাতে নিয়ে ক্লাসে আসতে একটি ছাত্র সংগঠন ও সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, যা স্পষ্টতই উস্কানিমূলক এবং শিক্ষাঙ্গনের নৈতিক মান ও পেশাগত দায়িত্ববোধের গুরুতর লঙ্ঘন।

রাকসু প্রতিনিধিরা বলছেন, একজন শিক্ষক হিসেবে আ আল মামুনের এই মন্তব্য শুধুই ব্যক্তিগত মতামত নয়; এটি শিক্ষাঙ্গনের মর্যাদা, ছাত্র-ছাত্রীদের নিরাপত্তা, আত্মবিশ্বাস এবং শিক্ষকের দায়িত্ববোধকে চ্যালেঞ্জ করছে।

তিনি নারীর ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, ধর্মীয় অনুশাসন ও পোশাককে ব্যঙ্গ করে যে মনোভাব প্রকাশ করেছেন, তা হিজাবফোবিয়া এবং নারীবিদ্বেষী মনোভাবে উৎসাহ জোগায়; যা কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অনুরুপ নয়।

রাকসুর দৃঢ় অবস্থান হলো ‘নারীর পোশাকের স্বাধীনতা, হিজাব ও নিকাব কোনো অপরাধ নয় এবং তা পশ্চাৎপদতার চিহ্নও নয়; বরং এটি একজন নারীর নিজস্ব পরিচয়, বিশ্বাস, আত্মমর্যাদা ও শালীনতার প্রতিফলন।’

কোনো ব্যক্তির ধর্মীয় বিশ্বাস বা পোশাককে ব্যঙ্গ করা একজন শিক্ষক বা নাগরিকের নৈতিক অধিকার নয়। এ ধরনের মন্তব্য ধর্মীয় বিদ্বেষ উসকে দেওয়া এবং শিক্ষকের শপথভঙ্গের সমতুল্য।

এ সময় তারা কয়েকটি দাবি জানান। দাবিগুলো হলো : ড. আ আল মামুনকে জনসম্মুখে তার এই অবমাননাকর ও বিদ্বেষমূলক মন্তব্যের জন্য প্রকাশ্যে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে; ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করা হোক এবং তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী শিক্ষকতার শপথ, কর্মসংস্কৃতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালা লঙ্ঘনের অপরাধে যথাযোগ্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক; রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যেন এই ধরনের বিদ্বেষপূর্ণ ও উসকানিমূলক মানসিকতার বিরুদ্ধে স্পষ্ট ও দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে, তার সার্বিক নীতি ও নির্দেশনা অবিলম্বে ঘোষণা করা হোক; ভবিষ্যতে যেন কোনো শিক্ষক বা কর্মরত ব্যক্তি শিক্ষার্থীর ধর্মীয় পরিচয়, পোশাক বা ব্যক্তিগত বিশ্বাস নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্য করতে না পারেন, এই উদ্দেশ্যে সতর্কতামূলক ও দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক; বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে সহিষ্ণুতা, সাম্য ও ধর্মীয় স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জোরদার করার লক্ষ্যে যথোপযুক্ত সেমিনার/ওরিয়েন্টেশন/কর্মসূচি গ্রহণ করা হোক।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত