রাজধানীর মিরপুর পল্লবীতে প্রকাশ্যে দোকানে ঢুকে পল্লবী থানা যুবদলের সদস্যসচিব গোলাম কিবরিয়া (৪৭)’কে গুলি করে হত্যার ঘটনায় স্থানীয় রাজনীতির দ্বন্দ্ব এবং আন্ডারওয়ার্ল্ডের যোগসূত্র নিয়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সূত্র বলছে, এটি ছিল একটি পূর্ব পরিকল্পিত এবং ঠান্ডা মাথার টার্গেট কিলিং।
সোমবার (১৭ নভেম্বর) সন্ধ্যায় পল্লবীর সেকশন-১২ এলাকায় একটি হার্ডওয়্যার দোকানে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যার মতো নৃশংসতা ঘটে। এই ঘটনায় নিহতের পরিবার পল্লবী থানায় মামলা করেছে এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) একজনকে আটক করে হত্যাকাণ্ডের মূল রহস্য উদঘাটনে বিস্তারিত অনুসন্ধান চালাচ্ছে। প্রাথমিকভাবে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী জানা যাচ্ছে, নিহত গোলাম কিবরিয়ার সঙ্গে সন্ত্রাসী মামুনের দ্বন্দ্ব চলছিলো। এছাড়া পল্লবী থানা যুবদলের কমিটিতে পদ পাওয়া নিয়ে নিহত কিবরিয়ার সঙ্গে স্থানীয় পর্যায়ে দ্বন্দ্ব ছিলো। এই দুটি প্রেক্ষাপটে নিহত হন গোলাম কিবরিয়া।
নৃশংসতা ও ১৮টি গুলির চিহ্ন
পুলিশ এবং সিসি ক্যামেরার ফুটেজ অনুযায়ী, গত সোমবার সন্ধ্যা পৌনে ৭টার দিকে গোলাম কিবরিয়া একটি হার্ডওয়্যারের দোকানে ঢোকার মাত্র দুই তিন সেকেন্ডের মধ্যে মোটরসাইকেলযোগে আসা মুখোশ ও হেলমেট পরা তিনজন দুর্বৃত্ত অপর দরজা দিয়ে দ্রুত দোকানে প্রবেশ করে। কোনোকিছু বুঝে ওঠার আগেই একজন দুর্বৃত্ত কিবরিয়াকে লক্ষ্য করে খুব কাছ থেকে এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। কিবরিয়ার শরীর ভেদ করে মোট ৯টি গুলি প্রবেশ করেছে বলে জানা গেছে। ঘটনাস্থল থেকে সাত রাউন্ড গুলির খোসা উদ্ধার করা হয়।
মঙ্গলবার (১৮ নভেম্বর) শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে কিবরিয়ার ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। জানা গেছে, নিহতের চোয়াল, গলা ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে মোট ১৮টি গুলির চিহ্ন দেখা গেছে। অর্থাৎ, গুলি শরীরে প্রবেশ ও প্রস্থানের ফলে এই সংখ্যক চিহ্ন সৃষ্টি হয়েছে। ডিবি প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার মো. শফিকুল ইসলাম ঘটনাটিকে “স্পষ্টতই পূর্ব পরিকল্পিত” বলে উল্লেখ করেন।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কী বলছে?
হত্যাকাণ্ডের কারণ নিয়ে প্রাথমিকভাবে অস্পষ্টতা থাকলেও, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দুটি সম্ভাব্য কারণের দিকে ইঙ্গিত করছে: এর মধ্যে রয়েছে, পূর্ব পরিচিতদের দ্বন্দ্ব ও প্রভাব বিস্তার।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মো. শফিকুল ইসলাম জানান, নিহতের পরিচিতদের মধ্যে কেউ এই ঘটনায় জড়িত থাকতে পারে। তিনি বলেন, জনপ্রিয়তা ও স্থানীয় প্রভাবসহ সবদিক বিবেচনা করে পুলিশ তদন্ত চালাচ্ছে। কিবরিয়ার স্থানীয় প্রভাব বা তার কোনো পূর্বপরিচিতের সঙ্গে আধিপত্য বা অর্থনৈতিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো দ্বন্দ্ব এই হত্যাকাণ্ডের জন্ম দিতে পারে বলে ডিবি কর্মকর্তারা ধারণা করছেন। পুলিশ সদর দপ্তরের সূত্র বলছে, দলের কমিটি গঠনের দ্বন্দ্ব, স্থানীয় ভাগাভাগি বা অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মূল কারণ বলে মনে হচ্ছে।
এছাড়া প্রাথমিক তদন্তে পল্লবী থানার এসআই রাশেদুল ইসলাম হত্যাকান্ডের রাতে গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, যুবদলের দু’পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে কিবরিয়া নিহত হয়েছেন। কিবরিয়া পল্লবী থানা যুবদলের সদস্যসচিব ছিলেন এবং রাজনীতির পাশাপাশি ছোটখাটো ব্যবসা করতেন। হত্যাকাণ্ডের পর ঘটনাস্থল থেকে পালানোর সময় জনগণের সহায়তায় জনি নামে একজনকে আটক করা হয়। ডিএমপির মুখপাত্র উপ-পুলিশ কমিশনার তালেবুর রহমান জানান, হত্যায় জড়িত বাকি দুইজনকে দ্রুত গ্রেপ্তারের পর মূল তথ্য জানা যাবে।
ফোর স্টার গ্রুপের নিয়ন্ত্রণ ও দ্বন্দ্ব:
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, নিহত কিবরিয়া পল্লবীর প্রভাবশালী নেটওয়ার্ক ‘ফোর স্টার গ্রুপ’ নিয়ন্ত্রণ করতেন। বিদেশফেরত পাতা সোহেল এই গ্রুপের নিয়ন্ত্রণ নিতে আগ্রহী ছিলেন। এ আধিপত্যের দ্বন্দ্বও হত্যাকাণ্ডের অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। একসময় কিবরিয়া ও সোহেল উভয়েই ‘কিলার মামুন’ এর ঘনিষ্ঠ চক্রের হয়ে কাজ করতেন।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র ও মামলার এজাহার থেকে চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে যে, দুবাই থেকে দেশে ফেরা শীর্ষ সন্ত্রাসী সোহেল ওরফে ‘পাতা সোহেল’ এবং তার সহযোগী মাসুম ওরফে ‘ভাগিনা মাসুম’ এই হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনা ও নির্দেশনা দিয়েছেন। নিহতের স্ত্রী সাবিহা আক্তার দিনা বাদী হয়ে পল্লবী থানায় যে মামলা দায়ের করেছেন, তাতে উল্লেখ করা হয়েছে যে পাতা সোহেল (মনির হোসেন) ও ভাগিনা মাসুম ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে হত্যার নির্দেশ দেন। কিবরিয়া সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড থেকে সরে আসায় সোহেল তার ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন।
অন্যদিকে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র জানিয়েছে, মামুন বিদেশে বসে এলাকায় মাদক ও চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ নিতে কিবরিয়াকে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। কিবরিয়া রাজি না হওয়ায় এবং তার কাছে পাওনা টাকা পরিশোধে টালবাহানা করায় মামুন এই ‘কিলিং স্কোয়াড’ পরিচালনা করেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। মামুনের বিরুদ্ধে খুন, চাঁদাবাজি ও মাদকসহ ২৭টি মামলা রয়েছে।
নিহত কিবরিয়ার স্ত্রী সাবিহা আক্তার দিনা মঙ্গলবার পল্লবী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। মামলার এজাহারে পাঁচজনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে- ১. মো. জনি ভূঁইয়া, ২. সোহেল ওরফে পাতা সোহেল, ৩. সোহাগ ওরফে কাল্লু, ৪. মাসুম ওরফে ভাগিনা মাসুম, এবং ৫. রোকন। এছাড়াও অজ্ঞাতনামা আরও ৭/৮ জনকে আসামি করা হয়েছে।
নিহতের ছোট বোন স্মৃতি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ভাইয়ের সঙ্গে কারো কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না। যাদের টাকা দিয়েছে তারা খুন করেছে, পেছনে মূলহোতা কারা আপনারা বের করবেন।’
এদিকে, যুবদল সভাপতি আব্দুল মোনায়েম মুন্না বলেন, এ হত্যাকাণ্ড নির্বাচন প্রলম্বিত করতে বা নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করতে চাওয়া পক্ষের কৌশলী কাজ হতে পারে। কিবরিয়া হত্যার পর যুবদলের নেতাদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়েছে বলেও তিনি জানান। নিহত গোলাম কিবরিয়া (৪৮) পরিবার নিয়ে মিরপুর ১২-এর রোড নম্বর ৩ এলাকায় থাকতেন।

