‘জুলাই আন্দোলনে হাজার হাজার তরুণ গুলির মুখে দাঁড়িয়ে ফ্যাসিবাদকে বিদায় করেছে। তারা কোনো আপস করেনি। ফ্যাসিবাদ গোষ্ঠীর পতনের পর কিছু সাংবাদিক ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যে বয়ান তৈরি করে, সেই বয়ান তারাও দেয়। তাদের ভাষা বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে, তারা পতিত স্বৈরাচার গোষ্ঠীকে আবার ক্ষমতায় আনতে চায়।’
বুধবার সকালে রাজধানীর একটি হোটেলে বিশ্ব মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ আয়োজিত এক আলোচনা সভায় এ তথ্য উঠে আসে।
আলোচনা সভায় গুম কমিশনের সদস্য হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মো. ফরিদ আহমেদ শিবলী বলেন, মানবাধিকার রক্ষায় কাজ করা সংস্থাগুলো নাগরিকদের অধিকার নিশ্চিত করতে এবং বঞ্চিতদের অধিকার পুনরুদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। সত্য নথিভুক্ত হলে তা ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে। আর মিথ্যা তাৎক্ষণিক স্বস্তি দিলেও এর ক্ষতি দীর্ঘস্থায়ী।
তিনি আরও বলেন, গুমবিষয়ক তদন্ত কমিশন সতর্কতার সঙ্গে বিভিন্ন উৎস থেকে প্রমাণ যাচাই করে সত্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করছে। সত্য উদ্ঘাটনের প্রতি অঙ্গীকার থেকেই আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কারণ, সত্য ছাড়া ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রসিকিউটর সাইমুম রেজা তালুকদার বলেন, বিগত ফ্যাসিস্ট আমলে মানুষকে নানা নিপীড়ন, হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। কাউকে জঙ্গি ট্যাগ দেওয়া হয়েছে। কাউকে স্বাধীনতা বিরোধী, আগুন সন্ত্রাসী, সরকার বিরোধী বলে নির্যাতন নিপীড়ন করা হয়েছে। ওই সময় দেশের কথিত একাধিক মানবাধিকার সংস্থা চুপ ছিল। তারা প্রতিবাদ করেনি।
তিনি আরও বলেন, ছাত্রদের আন্দোলন ও প্রতিবাদ থেকেই রাজনৈতিক সচেতনতা ও গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে। বিচার ও ন্যায়বিচার ধৈর্য, স্বচ্ছতা ও সাক্ষ্যের যথাযথ প্রমাণের ওপর নির্ভরশীল। এতে স্বচ্ছ বিচার হয়।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলা দায়েরের পর আমাদের সাক্ষীদের আনা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। যারা আদালত পাড়ায় আন্দোলন করেন তাদের বলছি সাক্ষ্য দিতে। কিন্তু, অনেকেই আসেনি। আমরা একটি মানসম্মত বিচার হোক চেয়েছি।
আয়নাঘর ফেরত সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান বলেন, গুমের ঘটনাগুলো সঠিকভাবে নথিভুক্ত ও আলোচিত না হওয়ায় অনেক সত্য আড়ালে থেকে গেছে। দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা এবং ক্ষমতার অপব্যবহার গুমের মতো এমন মানবাধিকার লঙ্ঘনের পরিবেশ তৈরি করেছিল।
আলোচনায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিভিন্ন ঘটনার তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরেন অধিকারের পরিচালক তাসকিন ফাহমিনা। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে সংঘটিত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের ক্ষেত্রে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা এখনো পরিষ্কার নয়। তাদের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর ৯ আগস্ট থেকে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে অন্তত ৪০টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। যেখানে রাষ্ট্রীয় বাহিনীও জড়িত ছিল। তবে দোষীদের ব্যাপারে কী ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার, সে বিষয়ে এখনো পরিষ্কারভাবে জানা যায়নি।
তিনি আরও বলেন, তবে অন্তর্বর্তী সরকার কিছু ভালো পদক্ষেপ নিয়েছে। যেমন আইসিপিপিইডি (বিচারবহির্ভূত নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের অধিকার রক্ষার আন্তর্জাতিক চুক্তি) আইনগতভাবে গ্রহণ ও কার্যকর করা, গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশন গঠন, নির্যাতন রোধে চুক্তির বিকল্প বা অতিরিক্ত নিয়মাবলি কার্যকর করা হয়েছে। ফলে মানবাধিকারকর্মীরা জেলখানা ও সংশোধনাগার পরিদর্শন করতে পারবেন, যা অতীতে সুযোগ ছিল না।
অধিকারের পরিচালক এ এস এম নাসির উদ্দিন এলান বলেন, ভারতীয় বয়ান দিয়ে একশ্রেণির মিডিয়া ও সাংবাদিক নানা তত্ত্ব হাজির করছে। পতিত স্বৈরাচারদের তারা পুনর্বাসনের চেষ্টা করছে। কিন্তু, পৃথিবীর ইতিহাস নেই পতিত স্বৈরাচার পুনর্বাসিত হয়।
গুমের স্বজনদের ভিকটিম আমেনা খান বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার দেড় বছরও বলতে পারেনি গুম হওয়া ব্যক্তিরা কোথায়? তাদের কি মেরে ফেলা হয়েছে নাকি তারা বেঁচে আছেন। কোনো খবর এখনো পাইনি। এ সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল করেছে, গুম কমিশন করেছে। কিন্তু যারা গুম করেছে, তারা আদালতে গিয়ে গান গাইছে, স্বজনদের দেওয়া খাবার খাচ্ছে, হাতের মাসল দেখাচ্ছে। তিনি গুমকারীদের দ্রুত বিচার নিশ্চিত চান।
আলোচনা সভায় অন্যদের মধ্যে অংশগ্রহণ করেন জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের নেতা ফয়জুল হাকিম লালা, জুলই গণঅভ্যুত্থানে চোখ হারানো খান জসিম, তরুণদের মানবাধিকার সংগঠন অনুকূলের প্রতিনিধি জাহিদুল ইসলাম প্রমুখ।

