বিডিআর হত্যাকাণ্ডে ‘জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা’ রয়েছে বলে নিজেদের দায় এড়াতে চেষ্টা করেছিলেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা। ইতিহাসের জঘন্যতম এই হত্যাকাণ্ডের পর তারা সব দায় ইসলামপন্থিদের ওপর চাপানোর চেষ্টাও করেছিলেন।
পিলখানায় সংঘটিত বিদ্রোহের ঘটনা তদন্তের জন্য গঠিত জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন গত ৩০ নভেম্বর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার কাছে তাদের প্রতিবেদন জমা দেন। তাতে উঠে এসেছে এসব তথ্য।
প্রতিবেদনে বলা হয়, তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী কর্নেল ফারুক খান দাবি করেছিলেন যে বিডিআর হত্যাকাণ্ডে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।
এর আগে সেনা তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল যে বিডিআরের বিদ্রোহী জওয়ানরা আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সাথে হত্যাকাণ্ডের পূর্বে যোগাযোগ করেছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের তৎকালীন মুখপাত্র এবং স্থানীয় সরকার বিষয়ক মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সেনা তদন্ত প্রতিবেদনের তীব্র সমালোচনা করেন এবং ওই প্রতিবেদনকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
তিনি বিডিআর হত্যাকাণ্ডে যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতাবিরোধীরা জড়িত ছিল উল্লেখ করে তদন্ত ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টা চালান। তিনি বলেন, ‘সত্যকে আড়াল করতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এটি করা হয়েছে। এর মূল লক্ষ্য আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে জড়িত করা। রিপোর্টে মন হচ্ছে বিডিআর ঘটনা নিয়ে ধোঁয়াশা ছড়িয়ে আওয়ামী লীগ, প্রকারান্তরে সরকারকে জড়ানোর অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে’।
সৈয়দ আশরাফ সেনা তদন্ত প্রতিবেদনের সমালোচনা করে বলেছিলেন, ‘রিপোর্টে অনেক কিছুই স্থান পায়নি। বিডিআর ঘটনার পিছনে কী মোটিভ ছিল তা রিপোর্টে আসেনি। ঘটনার সঙ্গে যুদ্ধাপরাধী বা স্বাধীনতাবিরোধীরা জড়িত ছিল কি-না তার উল্লেখ নেই। ঐ সময় পিলখানায় সেনা অভিযান চালালে কি পরিমাণ হতাহত হতে পারতো, সাধারণ মানুষের কি অবস্থা হত তারও উল্লেখ নেই’।
বিডিআর হত্যাকাণ্ডের পরে মতিয়া চৌধুরী পিলখানা হত্যাকাণ্ডের দায় ইসলামী জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর উপর চাপিয়ে তদন্ত ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টা চালান। তিনি একটি অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের বলেন, ‘ঘটনার সময় অনেকের মুখে ভিন্ন তিন রংয়ের রুমাল দেখা গেছে, যা দেশের একটি জঙ্গি সংগঠনের পরিচিতি চিহ্ন’।
বিডিআর হত্যাকাণ্ড বিষয়ে সেনা তদন্ত প্রতিবেদনের সমালোচনা করে মতিয়া চৌধুরী তখন বলেছিলেন, ‘তারা এত কিছু বিশ্লেষণ করল কিন্তু অ্যাশ, ইয়েলো এবং অরেঞ্জ রেড কালারের রুমাল কিভাবে এলো তা বিশ্লেষণ করল না। ওই খানে যে তিন রংয়ের রুমাল ব্যবহার হয়েছে তা বাংলাদেশে যেসব জঙ্গিগোষ্ঠী রয়েছে তাদের মধ্যে একটি সংগঠনের তিনটি স্তরের পরিচিতি চিহ্ন’।
পিলখানার ঘটনায় ১০ সদস্য বিশিষ্ট একটি জাতীয় তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছিল। এর সভাপতি ছিলেন আনিস-উজ-জামান খান। সেই কমিটির কাছেও এক সাক্ষী অনুমানভিত্তিক মন্তব্যের মাধ্যমে সন্ত্রাসী ও মৌলবাদী সংগঠনের উপর এর দায় চাপানোর চেষ্টা করেছিলেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিডিআর হত্যাকাণ্ড পরবর্তী সময়ে অনেক সেনা অফিসারকে সেনাবাহিনী ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে। যেসব অফিসার সৎ, দেশপ্রেমিক ছিলেন, যারাই বিডিআর হত্যাকাণ্ড নিয়ে সরব ছিলেন তাদের সবাইকে সেনাবাহিনী থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল।
আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মধ্যে ইসলামী জঙ্গিবাদ বিদ্যমান এই ধারণা প্রতিষ্ঠা করা। সেই উদ্দেশ্যে সেই সময় পাঁচজন সেনা কর্মকর্তাকে ইউনিফর্ম পরিহিত অবস্থায় গুম করা হয়।
তাদেরকে তথাকথিত একটি জঙ্গি মামলায় অন্তর্ভুক্ত করে এমন একটি দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করা হয়, যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ কখনও তাদের বিরুদ্ধে নিজের কণ্ঠ উঁচু করতে সাহস না পায় এবং বিনা দ্বিধায় বড় বড় রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, আমলা বা বিশিষ্ট নাগরিককে যে কোনো সময় গুম বা খুন করতে পারে।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে এই ঘটনার মাধ্যমে সম্পূর্ণরূপে ভীত ও নিষ্ক্রিয় করে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল।

