গত ১০ নভেম্বর, দিল্লির লাল কেল্লার কাছে একটি গাড়িতে বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। ঘটনাটির পর থেকে ভারত-শাসিত কাশ্মীরের সামাজিক-রাজনৈতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক দৃশ্যপটে বিপর্যয়কর পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর পরপরই কাশ্মীর এবং কাশ্মীরের বাইরে বসবাস করা অর্থাৎ ভারতের সকল কাশ্মীরিকে সন্দেহভাজন ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করছে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী। সেই সাথে কখনো কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত না থেকেও শাস্তি ভোগ করতে বাধ্য হচ্ছেন অনেক কাশ্মীরবাসী।
শ্রীনগরের দক্ষিণে পুলওয়ামা এবং দিল্লি হামলায় প্রধান অভিযুক্ত করে উমর নবির বাড়ি ভেঙে ফেলে ভারতীয় বাহিনী। এমন শাস্তি দেওয়ার ঘটনা ভারতের হিন্দুত্ববাদী শাসনামলের মানবাধিকার লঙ্ঘনের স্পষ্ট চিত্র তুলে ধরে।
উমর নবি এমন কোনো অশিক্ষিত ব্যক্তি ছিলেন না, তিনি কোনো অজ্ঞাত, অপ্রাসঙ্গিক কিংবা অসহায় যুবকও ছিলেন না; বরং তিনি সমাজের সবচেয়ে সম্মানিত শ্রেণির একটি অংশ ছিলেন; তিনি ছিলেন একজন ডাক্তার, একজন নিরাময়কারী অথবা বলতে পারেন একজন জীবন রক্ষাকারী।
এমন শাস্তি প্রয়োগ ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের দেশীয় কিংবা আন্তর্জাতিক আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন। যেখানে আইনে রয়েছে- ‘কোনো কাঠামো ভাঙার জন্য পূর্ব বিচারিক অনুমোদনের প্রয়োজন’ এবং জেনেভা কনভেনশনের আন্তর্জাতিক আইন, অনুচ্ছেদ ৩৩ নম্বরে বলা হয়েছে- ‘অপরাধের অভিযুক্তের পরিবারকে শাস্তি দেওয়া নিষিদ্ধ।’
তবে, ভারত সরকার কর্তৃক কাশ্মীরের জনগণের ওপর সম্মিলিত শাস্তি প্রয়োগ নতুন কোনো কৌশল নয়।
২০২৫ সালের মে মাসের সংকটের সময়ও, কেবল সন্দেহের ভিত্তিতে, তদন্ত ছাড়াই বেশ কয়েকজন কাশ্মীরির বাড়িঘর ভেঙে ফেলা হয়েছিল, যদিও তারা পেহেলগাম হামলার সাথে জড়িত ছিল না।
এছাড়াও পেহেলগাম সন্ত্রাসী হামলার পর ২ হাজার ৮০০ জনেরও বেশি কাশ্মীরিকে আটক করা হয়েছিল। ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কৌশলই হচ্ছে অঞ্চলের জনগণকে দমন করা।
ভারত সরকার কাশ্মীরের জনগণের বিরুদ্ধে নজরদারি অভিযান আরো তীব্র করেছে। বিশেষত, জিপিএস ডিভাইসের মাধ্যমে আটক ব্যক্তিদের ওপর নজরদারি করা হয়। এছাড়াও ডিজিটাল নজরদারি, বায়োমেট্রিক তথ্য সংগ্রহ এবং মোবাইল ফোন নজরদারি-ব্যক্তি হস্তক্ষেপের একটি হাতিয়ার হয়ে উঠেছে, যা স্বাধীনতা এবং গোপনীয়তার মৌলিক অধিকারকে ক্ষুণ্ন করে।
কাশ্মীরবাসীর ওপর এমন চর্চা আইসিসিপিআর-এর ধারা ১৭ লঙ্ঘন করে, যেখানে বলা হয়েছে-‘ব্যক্তিগত গোপনীয়তা, পরিবার, বাড়ি বা চিঠিপত্রের ক্ষেত্রে বেআইনি হস্তক্ষেপ নিষিদ্ধ।’
ভারত জুড়ে, কাশ্মীরের ছাত্র এবং ডাক্তাররা কর্তৃপক্ষের দ্বারা ব্যাপক হয়রানি ও আটকের শিকার হয়েছেন। এমন বৈষম্যমূলক পদক্ষেপ গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে, বিশেষত যেখানে জীবন রক্ষাকারী নিরাপত্তা বাহিনীর পেশাটিকে সন্ত্রাসবাদ বা উচ্চপদস্থ পেশাজীবীদের কাজকে জঙ্গিবাদের সঙ্গে যুক্ত করে।
বিজেপি পেশাদারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে হিন্দু জাতীয়তাবাদের রাজনৈতিক মতাদর্শকে প্রবেশ করাচ্ছে। এমনই একটি দাবি তুলে, এসএমভিডি নামে পরিচিত শ্রী মাতা বৈষ্ণ দেবী বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেখানে ৪২ জন মুসলিম ছাত্রের ডাক্তারি ভর্তি বাতিলের দাবি জানায় বিজেপি।
শিক্ষা ও পেশাগত ক্ষেত্রে কাশ্মীরি তরুণদের এমন লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করায়, তাদের মানসিক ও নৈতিক অবস্থার ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে। যার ফলে তারা এখন সব সময় এক ধরনের ভয়ের পরিবেশে আটকে থাকে।
শিক্ষা একটি পবিত্র জায়গা, কিন্তু বর্তমানে শিক্ষাকে ভারতের চলমান ঘৃণার রাজনীতির একটি হাতিয়ারে পরিণত করার স্পষ্ট পরিকল্পনা লক্ষণীয়। বলা যায়, ভারত ধর্ম-ভিত্তিক ছাত্র ভর্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
ভিন্নমত পোষণকারী কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করার প্রয়াসের আরেকটি উদাহরণ হচ্ছে- স্বাধীন সংবাদমাধ্যমে হস্তক্ষেপ। আর এর ষোলোকলা পূর্ণ করতে ভারতের বাহিনী কাশ্মীর টাইমসের অফিসে অভিযান চালিয়েছে। কাশ্মীর টাইমস তাদের অফিসে অভিযানের নিন্দা জানিয়েছে এবং তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে।
হিন্দু দক্ষিণপন্থি এজেন্ডা
প্রশ্ন হলো: ভারত সরকার কি কাশ্মীরিদের কাছ থেকে সত্য শুনতে ভয় পাচ্ছে, নাকি নির্মিত আখ্যানের নিয়ন্ত্রণ হারাতে ভয় পাচ্ছে?
হিন্দু দক্ষিণপন্থি বিজেপির নেতৃত্বে, ভারত-শাসিত কাশ্মীরে গণমাধ্যমের ওপর দমন কেবল একটি হাতিয়ারই নয়, বরং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির রাজনৈতিক ও হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডাকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে একটি সক্রিয় ভূমিকায় পরিণত হয়ে উঠেছে।
হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক এজেন্ডাকে সমর্থন করার জন্য, পরিস্থিতিকে অতিরঞ্জিত করার জন্য মিথ্যা বর্ণনা এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-ভিত্তিক ভিডিও প্রচারের জন্য ব্যাপকভাবে পরিচিত ভারতীয় গণমাধ্যম। তাদের বিভ্রান্তিকর প্রচারণার অংশ হিসেবে মুসলমানদের, বিশেষ করে কাশ্মীরিদের সন্ত্রাসী হিসেবে চিত্রিত করে এবং কাশ্মীরের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সন্ত্রাসবাদ হিসেবে উপস্থাপন করে ভারতের মিডিয়া।
২০১৯ সাল থেকে, কাশ্মীর বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা বাতিলের পর, ভারত সরকার এখানে দমন-পীড়ন বহুলাংশে বৃদ্ধি করেছে। সন্দেহের ভিত্তিতে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে, বেআইনি কার্যকলাপ (প্রতিরোধ) আইন ( ইউএপিএ) এবং জননিরাপত্তা আইন (পিএসএ) এর মতো কঠোর আইনের অধীনে ভিন্নমত পোষণকারীদের অপরাধী বানিয়ে তাদের দমন করা হচ্ছে। ২০১৯ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে কাশ্মীরের অনেক বাড়িঘর ধ্বংস করেছে ভারতীয় বাহিনী।
কর্ডন-এন্ড-তল্লাশি (ঘেরাও ও অনুসন্ধান অভিযান) অভিযানের সময়, ভারতীয় সেনাদের বিরুদ্ধে কাশ্মীরি মহিলাদের নির্যাতন ও যৌন হয়রানির অভিযোগ আনা হয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের (ইউএনএইচআরসি)-ও উচিত ভারতের এমন ডিজিটাল নজরদারি ব্যবস্থার তদন্ত করা এবং এই অঞ্চলে মানবতা রক্ষার জন্য সংস্কারের সুপারিশ করা।
কয়েক দশক ধরেই, ভারত-শাসিত কাশ্মীরের জনগণ একটি নিয়মতান্ত্রিক নিপীড়নের সম্মুখীন হচ্ছেন- যা বাস্তব সামরিকীকরণের বাইরেও বিস্তৃত।
কাশ্মীরের অশ্রু
কাশ্মীরের জনগণ সম্পূর্ণ এবং সর্বাত্মক নিপীড়ন ব্যবস্থা শিকার। যে ব্যবস্থায়- ১০ হাজারের বেশি গুম, হেফাজতে নির্যাতনে ৮ হাজার হত্যা, উদ্দেশ্যপ্রণেদিত উপায়ে জাতিগত ভারসাম্য পরিবর্তন, ৩,৫০,০০০ এরও বেশি অ-কাশ্মীরিদের স্থায়ীকরণ, রাজনৈতিক, প্রাতিষ্ঠানিক নজরদারি, নির্বিচারে আটকের অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে। এছাড়াও হয়রানি, বেআইনিভাবে বাড়ি ভাঙচুর, মিডিয়ার কণ্ঠরোধ, অমানবিক আচরণ, ঘৃণামূলক বক্তব্য এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে সহিংসতার প্ররোচনা বৃদ্ধি পেয়েছে।
যখন দেশের কর্তৃপক্ষ প্রতিটি ভিন্নমত দমন করে, অঞ্চলের মানুষের সামাজিক-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয় কেড়ে নেয়, এমনকি তাদের বই নিষিদ্ধ করে, ধর্ম দ্বারা নিষিদ্ধ মদের দোকান খুলে, অশ্লীল ফ্যাশন শো করে এবং তাদের ভূমিকে এমনভাবে সামরিকীকরণ করে- যার কারণে এটি বিশ্বের সবচেয়ে ভারী সামরিকীকরণ অঞ্চলে পরিণত হয়। তখন এর দখলদার বাহিনীকে কোনো জবাবদিহিতা ছাড়াই স্পষ্টতই দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের অনুমতি দেয়।
এই অঞ্চলের সমস্ত মানুষ যখন নৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক কিংবা মানসিকভাবে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় থাকে, তখন এই ধরনের কর্তৃপক্ষ জনগণের জন্য, বিশেষ করে তরুণদের জন্য কী পরিস্থিতি তৈরি করে? এই অঞ্চলের জনগণের জন্য ন্যায়বিচারের কি কোনো পথ অবশিষ্ট আছে?
এমন বিপর্যস্ত কাঠামোতে, অত্যাচার কেবল বাহ্যিক রূপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না বরং তখন এটি মন, কর্মক্ষেত্র, ঘর এবং এমনকি দৈনন্দিন জীবনের সবচেয়ে ব্যক্তিগত কোণে বিষের মতো প্রবেশ করে।
ভারত-শাসিত কাশ্মীরে এমন পদ্ধতিগত দমন-পীড়ন মানুষের আশা নষ্ট করে দিচ্ছে, এর পাশাপাশি ব্যাপক ভয়ের পরিবেশ তৈরি করছে, যা প্রায়শই মানুষকে অবাঞ্ছিত সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো মানবাধিকার সংস্থাগুলোর অসংখ্য প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, এই অঞ্চলের জঘন্যতম মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা। যেখানে মৌলিক অধিকারের দাবিতে নির্বিচারে আটক, বাড়িঘর ভেঙে ফেলা এবং ভিন্নমত দমন করা হয়, যার ফলে জনগণ ন্যায়বিচার খোঁজার কোনো উপায় পায় না।
এই পরিস্থিতিতে নিপীড়নের চাপ অদৃশ্য হয় না; এটি রূপান্তরিত হয়। যেখানে রাষ্ট্র এবং তার কর্তৃপক্ষ এই রূপান্তরের পরিণতির জন্য সরাসরি দায়ী।
টিআরটি ওয়ার্ল্ডে প্রকাশিত সাবা গুলহাম নবির নিবন্ধটি অনুবাদ করেছেন মো. মাহফুজুর রহমান।

