ঢাকার কেরানীগঞ্জে মাদরাসায় বিস্ফোরণের ঘটনায় অভিযুক্ত আল আমিনের উত্থান হয় আওয়ামী শাসনামলে। ২০১৭ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে ঢাকার বিভিন্ন থানায় সাতটি মামলা হয়। এর মধ্যে চারটি জঙ্গিসংক্রান্ত। এছাড়া আল আমিনের স্ত্রী আছিয়ার বিরুদ্ধেও জঙ্গিসংক্রান্ত একটি মামলা থাকার তথ্য পাওয়া গেছে।
এদিকে, গত শুক্রবার ওই মাদরাসায় বিস্ফোরণের ঘটনায় আল আমিনসহ সাতজনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেছে পুলিশ। এ ঘটনায় ইতোমধ্যে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী শাসনামলে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের দমনপীড়নের জন্য তৎকালীন সরকার বোমারু আল আমিন শেখ ও শাহিন ওরফে আবু বক্কর সিদ্দিককে তৈরি করে। নেপথ্যে ছিলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ফজলে নূর তাপস।
সূত্রটি বলছে, আল আমিন ২০১৭ ও ২০২০ সালে দুবার গ্রেপ্তার হয়েছিল। তাপসের সহযোগিতায় গ্রেপ্তারের কিছুদিনের মধ্যে জামিনে মুক্ত হয় সে। পরে ২০২২ সালে হাসনাবাদ এলাকায় আস্তানা গড়ে তোলে। সেখান থেকেই ঢাকার বিভিন্ন অঞ্চলে অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিল সে। আসন্ন সংসদ নির্বাচনে অরাজকতা সৃষ্টির জন্য মাদরাসার ভবনটিতে বোমা তৈরির ধাতব পদার্থ মজুত করা হয়েছিল ।
এলাকাবাসী জানান, বিস্ফোরণে উড়ে যাওয়া ভবনে মাদরাসার সাইনবোর্ড থাকায় তারা কোনোদিন সন্দেহের চোখে দেখেননি।
গতকাল সকালে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, বিস্ফোরণে ভবনের দেয়াল উড়ে ৪৫ মিটার দূরে পড়ে আছে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে ভবনের আসবাবপত্র। ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের বাইরে উম্মুল কুরা ইন্টারন্যাশনাল মাদরাসা নামক সাইনবোর্ড থাকলেও ভবনের ভেতরে একটি রুমে চারটি বেঞ্চ ছাড়া কিছু দেখা যায়নি।
স্থানীয়রা বলছেন, ২৫-৩০টি শিশু তিনবেলা এসে এখানে আরবি পড়ত, যাদের বয়স ১০-১১ বছরের মধ্যে। এর বাইরে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা হিসেবে এ ভবনে কোনো কার্যক্রম ছিল না।
বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের মালিক পারভিন বেগম জানান, তিনি তিন সন্তানের মা। অনেক আগে স্বামী মারা যাওয়ায় স্বজনদের সহযোগিতায় দুই সন্তানকে লেবানন পাঠিয়েছেন। মেয়ে সোহানা আক্তার মুনিয়াকে নিয়ে গেন্ডারিয়ায় ভাড়া বাসায় থাকেন। ছেলেদের পাঠানো টাকা এবং স্বজনদের সহযোগিতায় তিনি পাঁচতলা ফাউন্ডেশন দিয়ে ভবনের নির্মাণকাজ শুরু করেন। ২০২২ সালের প্রথম দিকে একতলা নির্মাণ করার পর অর্থের অভাবে নির্মাণকাজ থেমে যায়। পরে ওই বছর হারুনুর রশিদ নামে এক ব্যক্তি তার কাছে বাসাভাড়া নেওয়ার জন্য আসেন। তিনি প্রথমে ভাড়া দিতে রাজি হননি। পরে হারুনুর রশিদ তাকে বলেন, এখানে আমার বোন ও ভগ্নিপতি থাকবে এবং শিশুদের আরবি শিক্ষা দেবে। এতে আপনাদের সওয়াব হবে।
পারভিন বেগম আরো জানান, সওয়াবের আশায় মাত্র ১০ হাজার টাকা ভাড়ায় তাদের রুম দেওয়া হয়। তাদের কাছ থেকে এক মাসের ভাড়া অগ্রিম নেওয়া হয়। ওই সময় হারুনুর রশিদের জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে মৌখিক চুক্তিতে ভাড়া দেন।
জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, হারুনুর রশিদের পিতার নাম ইউনুস মোল্লা এবং মায়ের নাম মিসেস কুলসুম। ঠিকানা ঢাকার দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ফরিদাবাদ এলাকার আলমবাগ।
পারভিন বেগম বলেন, ২০২২ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রতি মাসে দুই-তিনবার ভাড়ার জন্য আসি। ভাড়া নিয়ে হয়রানির শিকার হয়েছি। ভাড়ার জন্য বসে থাকতে হতো। খুচরা টাকার নোটে ভাড়া দিতেন। মাদরাসায় ছাত্র নেই, অনেক কষ্টে আছিÑএসব কথা বলে ভাড়া নিয়ে হয়রানি করতেন। প্রতি মাসের ২০ থেকে ২৫ তারিখে ভাড়া দিতেন। সর্বশেষ গত ২৩ ডিসেম্বর ভাড়ার জন্য এসেছিলাম। তখন ভবনের ভেতরে কোথাও পুলিশ কর্তৃক উদ্ধারকৃত ধাতব পদার্থের ড্রাম দেখতে পাইনি।
তিনি বলেন, ভাড়া নেওয়ার পর আল আমিন এখানে থাকত না । মাঝেমধ্যে এসে দেখা করে যেত। ভাড়া নেওয়ার সময় হারুনুর রশিদ পরিচয় দেন আল আমিন তার ভগ্নিপতি, সে সিএনজি চালায়।
ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের পূর্ব পাশে রয়েছে মোহাম্মদ হোসেনের চারতলা বিল্ডিং। মোহাম্মদ হোসেনের স্ত্রী তাসলিমা জানান, বিস্ফোরণের ঘটনায় তারা ভয়ে আতঙ্কিত। তাদের ভবনেরও ক্ষতি হয়েছে। তাদের ভবনের নিচতলার দেয়াল ফেটে গেছে। জানালার থাই গ্লাস ও আসবাবপত্রের ক্ষতি হয়েছে।
স্থানীয় শোয়েব মোল্লা রনি বলেন, সামনে জাতীয় নির্বাচন। এ সময়ে এমন ঘটনা আমাদের মধ্যে ভয় বাড়িয়ে দিয়েছে। এত রাসায়নিক কী উদ্দেশ্যে এখানে রাখা হয়েছিল, তা দ্রুত তদন্ত করে বের করা উচিত।
তিনি আরো বলেন, নির্বাচনের আগে বা নির্বাচনে মানুষকে ভয়ভীতি দেখানোর জন্য অথবা অরাজকতা সৃষ্টির জন্য এ ধাতব পদার্থ মজুত করা হতে পারে।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) তরিকুল ইসলাম আমার দেশকে বলেন, পলাতক আসামি শেখ আল আমিন তার স্ত্রীর বড় ভাই হারুনের মাধ্যমে ওই ভবনের চার রুম ভাড়া নিয়ে একটি রুমে নিজেরা বসবাস করত এবং অপর তিন রুমে উম্মাল কুরা ইন্টারন্যাশনাল মাদরাসা নামে একটি প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে আরবি পড়াত। গত শুক্রবার ওই মাদরাসার মধ্যে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। এতে আসামি আল আমিনের রুম ও পাশের রুমের চারদিকের দেয়াল, ছাদের কিছু অংশ বিধ্বস্ত হয়। ওই ঘটনায় তার ছেলে উমায়ের (১০) ও আব্দুর রহমান (২) আহত হয়। আল আমিন তার আহত দুই সন্তানকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসা নেওয়ার পর দ্রুত পালিয়ে যায়। এরপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে বিভিন্ন আলামত সংগ্রহ করেন।
অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা
এ ঘটনায় পলাতক শেখ আল আমিনসহ সাতজনের নাম উল্লেখ করে ও অজ্ঞাতনামা আরো পাঁচ-ছয়জনকে আসামি করে মামলা করেছে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা পুলিশ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এজাহারভুক্ত সাতজনের মধ্যে ছয়জনকে আটক করেছে। আটকরা হলোÑশাহিন ওরফে আবু বকর ওরফে মুসা ওরফে ডিবা সুলতান (৩২), আমিনুর ওরফে দর্জি আমিন (৫০), শাফিয়ার রহমান ফকির (৩৬), আছিয়া বেগম (২৮), ইয়াসমিন আক্তার (২১) এবং আসমানী খাতুন ওরফে আসমা (৩২)। মামলার বাদী দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার এসআই রফিকুল ইসলাম লিটন।
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ওসি সাইফুল ইসলাম জানান, আটক আসামিদের মধ্যে পুরুষ তিনজনের ১০ দিন এবং মহিলাদের পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন করে আদালতে পাঠানো হয়। আদালত পুরুষদের সাতদিন করে এবং নারীদের তিনদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করে।
আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

