গ্রামীণফোনে আওয়ামী আধিপত্য

মাহমুদা ডলি
প্রকাশ : ০২ জানুয়ারি ২০২৫, ১৩: ১৫
গ্রামীণফোন লোগো, আলী আহমেদ তাহকিক ও ইশতিয়াক হোসেন চৌধুরী

ফ্যাসিবাদ সরকারের ক্যাঙারু কোর্টে ফাঁসি হয়েছে বাবার। আর সেই সূত্র ধরে চাকরি হারিয়েছেন নিরপরাধ সন্তান। ভিকটিম বাবার ফাঁসি কার্যকর আর ছেলেকেও চাকরিচ্যুত করার খবর পাশাপাশি রেখে একইসঙ্গে প্রকাশ করে চরমভাবে সামাজিক হেনস্তা করা হয়েছে গ্রামীণফোনের উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তাকে। বাবার ফাঁসি কার্যকরের পর দিনের আলো ফুটলেও সন্তানের জীবনে আসে অন্ধকার। শুধু তা-ই নয়, পুরো পরিবার সামাজিকভাবে হেনস্তার শিকার হয়েছে। আওয়ামী সরকারের জুলুম-নির্যাতনের ভয়ে পালিয়ে থেকে জীবন বাঁচাতে হয়েছে পরিবারের অন্যান্য সদস্যকেও। এমনই এক দুর্বিষহ জীবন কেটেছে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদের পরিবারকে। চাকরিচ্যুত হওয়া মুজাহিদের সেই সন্তান হলেন আলী আহমেদ তাহকিক। তাহকিককে গ্রামীণফোনের স্টেকহোল্ডার রিলেশনস ডিপার্টমেন্টের রিলেশনশিপ ম্যানেজার পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। গত ২৪ ডিসেম্বর দুপুরে দৈনিক আমার দেশ-এর কাছে এমনই অভিযোগ করেছেন তাহকিক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে অনার্সসহ মাস্টার্স এবং লন্ডনের ইউনিভার্সিটি অব সাসেক্স থেকেও তিনি পোস্ট গ্র্যাজুয়েট সম্পন্ন করেছেন। তাহকিক দৈনিক আমার দেশ-এর কাছে দেওয়া দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে অভিযোগ করেন, ‘সম্পূর্ণ রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় দেশ-বিদেশ থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করা হলেও আমার পেশাগত জীবন ধ্বংস করে দিয়েছে গ্রামীণফোনের অতিউৎসাহী উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের একটি সিন্ডিকেট। তার সাড়ে আট বছরের চাকরি কোনো নোটিস ছাড়াই এবং কোনো ধরনের অভিযোগ না থাকার পরও মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যে আগের তৈরি করা অব্যাহতি নেওয়ার কাগজে সই নিয়ে বের করে দেওয়া হয়। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর তার চাকরি পুনর্বহালের দাবিতে আবেদন করলেও ভ্রূক্ষেপ করছে না গ্রামীণফোন কর্তৃপক্ষ। বরং উল্টো তাহকিক গ্রামীণফোন থেকে স্বেচ্ছায় অব্যাহতি নিয়েছেন বলে মিথ্যা তথ্য প্রচার করা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

এ বিষয়ে জানতে চেয়ে বর্তমান গ্রামীণফোনের সিইও ইয়াসির আজমানকে কয়েক দফা ফোন করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। আমার দেশ-এর পরিচয় দিয়ে মেসেজ পাঠানোর পরও তিনি ফোন ব্যাক করেননি।

সে সময় তাহকিককে চাকরিচ্যুত করতে না চাওয়ার অপরাধে গ্রামীণফোনের করপোরেট অ্যাফেয়ার্স স্টেকহোল্ডার রিলেশনস ডিপার্টমেন্টের প্রধান ইশতিয়াক হোসেন চৌধুরীকেও ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি একইভাবে অব্যাহতি দেয় অতিউৎসাহী সিন্ডিকেট। জুলাই ছাত্র-জনতার সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর দুজনেই গ্রামীণফোনের কাছে চাকরি ফেরত চেয়ে আবেদন করেন। কিন্তু গ্রামীণফোনের ওই সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত থাকা কর্মকর্তারা তাহকিক বা ইশতিয়াক চৌধুরীর আবেদনকে গুরুত্বই দিচ্ছেন না। এমনকি তারা গণমাধ্যমের সঙ্গেও কথা বলতে চাইছেন না। ইশতিয়াক হোসেন চৌধুরী আমার দেশকে বলেন, ‘তাহকিককে জোরপূর্বক অব্যাহতি দেওয়ার বিরুদ্ধে কথা বলেছিলাম এবং আমি কোনোভাবেই তাকে এভাবে চাকরিচ্যুত করতে রাজি হইনি বলে আমাকেও তাহকিকের মতোই হুমকি দিয়ে জোর করে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এখন আবার যোগাযোগ করছি; কিন্তু চাকরিটা ফেরত পাচ্ছি না।’

তাহকিক বলেন, ‘বর্তমান বিটিআরসির কমিশনার তৎকালীন গ্রামীণফোনের চিফ করপোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার মাহমুদ হোসেন ও গ্রামীণফোনের বর্তমান সিইও ইয়াসির আজমান গ্রামীণফোনের দায়িত্ব নিয়ে পেশাদারির বাইরে গিয়ে শুধু রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় এবং ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক সুবিধার জন্য তাহকিককে চাকরি থেকে অব্যাহতি দিয়ে তা আবার সব মিডিয়ায় প্রকাশ করেছেন। বর্তমান বিটিআরসির কমিশনার মাহমুদ হোসেন, সাবেক তথ্য ও যোগাযোগমন্ত্রী মোস্তফা জব্বার, সাবেক ডাক, তার ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম, সাবেক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, গ্রামীণফোনের সে সময়কার পদস্থ কর্মকর্তা সাইফুল হাসান সিন্ডিকেটকে ব্যবহার করে ‘বেস্ট এমপ্লয়ি’ ও ‘বেস্ট পারফরমার’ হওয়ার পরও চাকরিচ্যুত করেছেন জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুজাহিদের ছেলে তাহকিককে।’

শুধু তা-ই নয়, ওই সময় সিন্ডিকেটের মধ্যে ছিলেন তাহকিকের একই ডিভিশনের আরেক কর্মকর্তা সাইফুল হাসান। সাইফুল হাসানের ভাই ওবায়দুল হাসান (আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের বিচারপতি) আলী আহসান মুজাহিদের হত্যার রায় প্রদান করেছিলেন। পরে তিনি প্রধান বিচারপতি ছিলেন। সাইফুল হাসান নিজেই ১৯টি গণমাধ্যমে তাহকিকের ছবিসহ তার বাবার ছবির সঙ্গে মিলিয়ে চাকরিচ্যুত করার সংবাদ প্রকাশ করেছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সাইফুল হাসানের বিরুদ্ধে গ্রামীণফোন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপর অত্যাচার, হুমকি-ধমকি আর পাশবিক ব্যবহারে সবাই ছিলেন অতিষ্ঠ।

এ ব্যাপারে ফোনে আমার দেশ-কে বিটিআরসি কমিশনার মাহমুদ হোসেন বলেন, ‘আমি কোনোভাবেই এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত নই। আমি জানি তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছেন ২৩-২৪ মাসের প্যাকেজ নিয়ে। তিনি ভলান্টিয়ার রিটায়ার্ড করেছেন।’

এদিকে মাহমুদ হোসেনের ব্যাপারে তাহকিক বলেন, ওই কাগজ তাদের আগেই পরিকল্পিতভাবে তৈরি করা ছিল। তারা তাহকিককে ছোট্ট রুমে ডেকে নিয়ে জোর করে কাগজে স্বাক্ষর নিয়েছেন। যদি কাগজে স্বাক্ষর না করেন, তাহলে তাকে টার্মিনেট করা হবে বলেও হুমকি দিয়েছিলেন। এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয় অস্বীকার করে মাহমুদ হোসেন বলেন, ‘এ কাজ তখনকার গ্রামীণফোন এইচআর বিভাগ করেছে। আমি কিছু করিনি।’

বর্তমান গ্রামীণফোনের সিইও ইয়াসির আজমান আওয়ামী লীগের প্রতি বিশেষ অনুরক্ত বলে জানা গেছে। তিনি সালমান রহমানেরও ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ৭ জানুয়ারির অবৈধ নির্বাচনে ভোট দিয়ে ফেসবুকে প্রমাণ, ছবিসহ পোস্ট দিয়ে তার উল্লাস প্রকাশ করার চিত্রও পাওয়া গেছে। এ ব্যাপারে অনেক চেষ্টা করেও ইয়াসির আজমানের মন্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত