জুলাই জাতীয় সনদের বেশ কয়েকটি ‘নোট অব ডিসেন্টের’ ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ এসব নোট অব ডিসেন্ট সরাসরি গণভোটে অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এ অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। গণভোটে ফলাফল ইতিবাচক হলে এগুলোর কার্যকারিতা হারাবে। এসব নোট অব ডিসেন্টের বেশিরভাগই সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত। যার অনেক এসেছে বিএনপির কাছ থেকে। এছাড়াও ছোট ছোট কয়েকটি দল যেসব আপত্তি জানিয়েছে তার পরিণতিও অনিশ্চিত বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ করা ‘জাতীয় জুলাই সনদ’ সই হয় গত ১৭ অক্টোবর। ৮৪টি সুপারিশ সম্বলিত ওই জুলাই সনদের ৫৮টি সিদ্ধান্ত এসেছে কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের নোট অব ডিসেন্টের মধ্য দিয়ে। এসব নোট অব ডিসেন্ট আমলে নিয়েই সনদ স্বাক্ষরিত হয়। বাকি ২৬টি প্রস্তাব চূড়ান্ত হয় সব দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে। অবশ্য সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছে, ৩০টি প্রস্তাব এসেছে কমিশন ও দলগুলোর ঐকমত্য সিদ্ধান্তে। বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত ৩২টি দলের ঐকমত্যে হলেও সংলাপে অংশ নেওয়া ৩৩টি দলের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে কোনো প্রস্তাব আসেনি। কোনো কোনো সিদ্ধান্তে সর্বনিম্ন একটি থেকে সর্বোচ্চ ৯টি দলের নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে। ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে ১৯টিতে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে বিএনপি। এর মধ্যে সংবিধান সম্পর্কিত ১২টি।
জুলাই জাতীয় সনদে নোট অব ডিসেন্টগুলো আমলে নিয়ে জুলাই সনদের চূড়ান্ত সুপারিশে বলা হয়, দলগুলো তাদের আপত্তির বিষয়গুলো নির্বাচনি ইশতেহারে উল্লেখ করে জনগণের ম্যান্ডেট পেলে সেই অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। অর্থাৎ কোনো দল জনগণের ম্যান্ডেট পেলে তারা নোট অব ডিসেন্টের ক্ষেত্রে জুলাই সনদের সুপারিশ আমলে না নিয়ে নির্বাচনি ইশতেহারে দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সংস্কার করতে পারবে।
জানা গেছে, জুলাই সনদে নোট অব ডিসেন্ট আমলে নেওয়া হলেও ঐকমত্য কমিশনের সনদ বাস্তবায়ন আদেশের সুপারিশে তা বাদ দেওয়া হয়। অবশ্য এখানে ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাবের সবগুলোকে আমলে না নিয়ে সংবিধান সম্পর্কিত ৪৮টি প্রস্তাবকে বাস্তবায়ন আদেশে অন্তর্ভুক্ত করার কথা হয়। বাকি প্রস্তাবগুলো অধ্যাদেশ জারি ও সরকারের নির্বাহী আদেশে নিষ্পন্ন সম্ভব বলে উল্লেখ করা হয়। বাস্তবায়ন আদেশের সুপারিশে নোট অব ডিসেন্টের বিষয়গুলো অগ্রাহ্য করায় রাজনৈতিক দল বিশেষ করে বিএনপির তরফ থেকে তীব্র আপত্তি তোলা হয়। অপরদিকে জামায়াতে ইসলামী দাবি করে সংসদ নির্বাচনের আগে গণভোট অনুষ্ঠানের। এনসিপির পক্ষ থেকে দাবি তোলা হয় আগে জুলাই সনদের আইনিভিত্তি প্রদানের। নিজেদের মতবিরোধ মেটাতে দলগুলোকে কিছুটা সময় দিলেও তারা সিদ্ধান্তে আসতে ব্যর্থ হলে সরকার নিজেই সিদ্ধান্ত নিয়ে গত ১৩ নভেম্বর জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন (সংবিধান সংস্কার) আদেশ-২০২৫ জারি করে। পরে ২৬ নভেম্বর জারি হয় গণভোট আধ্যাদেশ-২০২৫। গণভোট অধ্যাদেশে সংবিধান সম্পর্কিত ৪৮টি প্রস্তাবের মধ্যে ৩০টি বিবেচনায় এসেছে। এর মধ্যে ১৮টিতে রাজনৈতিক দলগুলোর আপত্তি রয়েছে। বিএনপির আপত্তি রয়েছে ৯টি সংস্কার প্রস্তাবের ক্ষেত্রে।
গণভোটের মধ্যে পড়েছে বিএনপির এমন নোট অব ডিসেন্টগুলো হলো— সংবিধান সংশোধনে উচ্চকক্ষের দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা, উচ্চকক্ষ গঠন (পিআর), একই সঙ্গে উচ্চ কক্ষ ও নিম্নকক্ষের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান তথা ন্যায়পাল নিয়োগ, সরকারি কর্ম কমিশন নিয়োগ, মহা হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক নিয়োগ এবং দুর্নীতি দমন কমিশন নিয়োগ। এর মধ্যে বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী দুদক সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নয়। সংস্কার প্রস্তাব অনুযায়ী দুদক সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার ক্ষেত্রে বিএনপির ৩টি ও উচ্চ কক্ষ গঠনের ক্ষেত্রে দুটি আপত্তি রয়েছে। এক্ষেত্রে এই ৭টিতে বিএনপির নোট অব ডিসেন্ট থাকলেও গণভোটে ইতিবাচক ফলাফল এলে নোট অব ডিসেন্ট কার্যকর হবে না। কারণ গণভোটেই এই ৭টি সংস্কার প্রস্তাবের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হয়ে যাবে।
তবে, বিএনপি চাইলে তার নোট অব ডিসেন্ট দেওয়া রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব; প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান; উচ্চকক্ষের দায়িত্ব ও ভূমিকা; সংসদে দলের বিপক্ষে ভোটদান সম্পর্কিত ৭০ অনুচ্ছেদ; জাতীয় স্বার্থ ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা প্রভাবিত করে এমন আন্তর্জাতিক চুক্তি আইনসভার অনুমোদন; আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারপতিকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ; সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগ; সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগ কমিশন সংক্রান্ত বিধান সংবিধানের অন্তর্ভুক্তকরণ; সুপ্রিম কোর্টের বিকেন্দ্রীকরণ; স্বতন্ত্র ফৌজদারি তদন্ত সার্ভিস; আইনজীবী সমিতি ও বার কাউন্সিল নির্বাচন—(আইনজীবীদের সংগঠনকে স্বীকৃতি দেওয়া যাবে না); তিনটি সরকারি কর্ম কমিশন গঠন এবং আয়কর আইন সংশোধন এই ১২টি সংস্কার প্রস্তাবের ক্ষেত্রে শর্তসাপেক্ষে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। বিএনপি নির্বাচনি ইশতেহারে এই বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে কোন ধরনের সংস্কার করতে চায় তা উল্লেখ করে নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করতে পারলে এ কাজটি তারা করতে পারবে। গণভোটে অন্তর্ভুক্ত হওয়া নোট অব ডিসেন্টগুলোই বিএনপির জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে দলটির সূত্র জানিয়েছে।
জামায়াতে ইসলামী আপত্তি জানিয়েছে এমন একটি সংস্কার প্রস্তাব গণভোটে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। অর্থাৎ গণভোটে ফল ইতিবাচক হলে দলটির এ সংক্রান্ত আপত্তি আমলে আসবে না। তবে, বিএনপির মতো জামায়াতে ইসলামী জনগণের ম্যান্ডেট পেলে বিচারকদের পদের মেয়াদ ও তাদের অপসারণ; স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের আর্থিক ব্যবস্থাপনা; সরকারি কর্মকর্তা/কর্মচারীদের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের অধীনে ন্যস্ত করা ও দুদক আইন সংশোধন সম্পর্কিত সংস্কার প্রস্তাব নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। এনসিপি নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে দুটি বিষয়ে, যার কোনোটিই গণভোটে আসেনি। অবশ্য, এনসিপি এখনো জুলাই জাতীয় সনদে সই করেনি।
এই তিন রাজনৈতিক দলের বাইরে অন্যান্য দল যেসব ক্ষেত্রে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে সেগুলোর ভবিষ্যৎও অজানা বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। তারা মনে করেন, সংস্কার প্রস্তাবে নোট অব ডিসেন্টগুলো দলগুলোর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বাস্তবায়নের মূল শর্ত হচ্ছে জনগণের ম্যান্ডেট। দলগুলো তাদের নির্বাচনি ইশতেহারে এই বিষয়গুলো উল্লেখপূর্বক জয়ী হওয়ার পরই কেবল তা বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ আমার দেশকে বলেন, গণভোট অনুষ্ঠিত হচ্ছে জুলাই সনদের ভিত্তিতে। তবে, গণভোটে যে প্রশ্নগুলো এসেছে তার কয়েকটি স্বাক্ষরিত জুলাই সনদ বহির্ভূত। সনদের ব্যত্যয় ঘটিয়ে প্রশ্ন অন্তর্ভুক্ত করে স্বাক্ষরিত জুলাই জাতীয় সনদকে অবমাননা করা হয়েছে। এভাবে কোনো কিছু আরোপিত হলে দীর্ঘ আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলোর মূল্য থাকে না।
আরোপিত কোনো আদেশ ও জবরদস্তিমূলক প্রস্তাব রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর চাপিয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকার যে বাস্তবায়ন আদেশ জারি করেছে তাতে জুলাই সনদ লঙ্ঘিত হয়েছে। রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি স্বাক্ষরিত জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে অঙ্গীকারাবদ্ধ বলে তিনি উল্লেখ করেন।
অন্য কোনো আদেশ বা আইন দিয়ে সংসদের সার্বভৌমত্বকে খর্ব করার সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সংলাপে বিএনপির পক্ষে নেতৃত্ব দেওয়া দলের স্থায়ী কমিটির এই সদস্য।
কিছু নোট অব ডিসেন্ট গণভোটের আমলে নেওয়া আবার কিছু আমলে না নেওয়া প্রশ্নে সম্প্রতি এক প্রেস ব্রিফিংয়ে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেন, জনগণের সংস্কারের আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে সরকারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয় রয়েছে। এক্ষেত্রে আমাদের সরকারেরও কিছুটা ভূমিকার বিষয় রয়েছে। কোনো রাজনৈতিক দলের জন্য আমরা অসহনীয় কোনো সিদ্ধান্ত নিইনি। বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক দল বা অন্যরা যে যার মতো করে ব্যাখ্যা করেন। তবে আমরা আমাদের মতো করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। প্রত্যেকটি শব্দের মধ্যে স্পষ্ট করা হয়েছে, কে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন তাদের ব্যাপার।
গণভোটে সবকিছুই বিবেচনা করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখানে যে ৪টি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে তা বিবেচনা করে ভোট দেবেন। এক্ষেত্রে যারা অধিকতর সম্মত তারা হ্যাঁ দেবেন, আর অধিকতর অসম্মত যারা তারা না দেবেন। উচ্চকক্ষের বিষয়টি অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের মতামতের ভিত্তিতে করা হয়েছে বলেও তিনি জানান।


খালেদা জিয়ার প্রতীক্ষায় জাপানের চেরি ফুল
ভারত আ.লীগ হাসিনা জড়িত, তাপস মূল সমন্বয়কারী
বিডিআর হত্যাকাণ্ডের আদ্যোপান্ত আমরা বের করেছি