মৃতপ্রায় মানবাধিকার কমিশন পুনরুজ্জীবনে হচ্ছে আইন

এম এ নোমান
প্রকাশ : ১১ অক্টোবর ২০২৫, ০৫: ৩১
আপডেট : ১১ অক্টোবর ২০২৫, ০৯: ১৫

মৃত মানবাধিকার কমিশনকে দাঁড় করাতে ২০০৯ সালের মানবাধিকার কমিশন আইন রহিত করে একটি নতুন আইন করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ‘জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অধ্যাদেশ, ২০২৫’ শিরোনামে প্রস্তাবিত আইনের খসড়ায় কমিশনকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের যেকোনো ঘটনা তদন্ত ও অনুসন্ধানের পূর্ণ এখতিয়ার দেওয়া হচ্ছে। প্রয়োজন হলে কমিশন কারাগার, হেফাজত কেন্দ্র বা সংশোধনাগারসহ যেকোনো স্থানে পরিদর্শন করতে পারবে।

প্রস্তাবিত নতুন আইনের বিষয়ে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা আমার দেশকে জানান, ২০০৯ সালে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন গঠন করা হলেও বিগত সরকারের আমলে গড়ে ওঠা আয়নাঘরসহ বিভিন্ন বাহিনীর হাতে গুম, আটক এবং নির্যাতনসহ চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তদন্ত ও অনুসন্ধানে কমিশনের অর্জন শূন্য। তাছাড়া বিদ্যমান আইনে এ ধরনের ঘটনা আমলে নেওয়ার এখতিয়ারও কমিশনের নেই। এ কারণে নতুন আইন প্রতিস্থাপন করার আবশ্যকতা দেখা দিয়েছে।

বিজ্ঞাপন

প্রস্তাবিত অধ্যাদেশে কমিশন যে ক্ষমতা পাচ্ছে

প্রস্তাবিত আইনের ১৩তম ধারায় বলা হয়েছে, ‘কমিশন স্বতঃপ্রণোদিতভাবে বা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি কিংবা তার পক্ষে অন্য কারো আবেদনের ভিত্তিতে মানবাধিকার লঙ্ঘন বা তার প্ররোচনার অভিযোগ তদন্ত করতে পারবে। কোনো জনসেবক কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘন, প্ররোচনা বা প্রতিরোধে অবহেলার অভিযোগও একইভাবে তদন্তের আওতায় আসবে’।

একই ধারার ‘গ’ উপধারায় বলা হয়েছে, ‘কমিশন জেল, সংশোধনাগার বা হেফাজত কেন্দ্রসহ আটক স্থানের পরিবেশ পরিদর্শন ও উন্নয়নের সুপারিশ করতে পারবে। পাশাপাশি মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকারদের চিকিৎসা, পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্যোগ নিতে পারবে কমিশন’।

মানবাধিকার সংরক্ষণে বাধাস্বরূপ সন্ত্রাসী কার্যক্রম বা অন্যান্য বিষয় পর্যালোচনা করে সরকারের কাছে প্রতিকারমূলক সুপারিশ পেশ করতে পারবে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দলিলের সঙ্গে দেশের আইন ও নীতিমালার সামঞ্জস্য যাচাই, প্রয়োজনীয় সংশোধন প্রস্তাব এবং নতুন চুক্তি অনুমোদন বা বাস্তবায়নে সরকারকে পরামর্শও দিতে পারবে কমিশন।

এছাড়া মানবাধিকার বিষয়ে গবেষণা, শিক্ষা ও সচেতনতা বিস্তারে ভূমিকা রাখা, এনজিও ও সুশীল সমাজের কার্যক্রম সমন্বয়, উৎসাহ প্রদান এবং মানবাধিকার সংরক্ষণ ও ‍উন্নয়নে প্রশাসনিক বা আইনগত পদক্ষেপের বিষয়ে সরকারকে পরামর্শ দেওয়া কমিশনের দায়িত্বের মধ্যে পড়বে। কমিশন মানবাধিকার লঙ্ঘন-সংক্রান্ত বিচারাধীন মামলায় আদালতে পক্ষ হিসেবেও অংশ নিতে পারবে।

কমিশনে অভিযোগ পেশ ও প্রতিকার

প্রস্তাবিত আইনের ১৫ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘মানবাধিকার লঙ্ঘন বা এর প্ররোচনায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি নিজে বা অন্য কেউ কমিশনে অভিযোগ করতে পারবেন, এতে কোনো ফি লাগবে না। অভিযোগ লিখিত, মৌখিক বা নির্ধারিত অন্য মাধ্যমে দাখিল করা যাবে এবং কমিশন রেজিস্ট্রেশন নম্বর দেবে। সাধারণভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের তারিখ থেকে ছয় মাসের মধ্যে অভিযোগ দাখিল করতে হবে; তবে যুক্তিসংগত কারণ থাকলে কমিশন বিলম্ব মওকুফ করতে পারবে’।

একই ধারার ৪ ও ৫ নম্বর উপধারায় বলা হয়েছে, ‘কমিশন অভিযোগ পেলে বা অন্যভাবে অবগত হলে তদন্ত চালাতে পারবে, যা কমিশনার, কর্মকর্তা বা তদন্ত দলের মাধ্যমে সম্পন্ন হবে। অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা যাচাইয়ের জন্য ৩০ দিনের মধ্যে অনুসন্ধান প্রতিবেদন তৈরি করতে হবে। অভিযোগ অমূলক প্রমাণিত হলে তা নথিজাত হবে; সত্যতা পাওয়া গেলে তদন্তের আদেশ দেওয়া হবে’।

৭ নম্বর উপধারায় বলা হয়েছে, ‘তদন্ত প্রতিবেদনে লঙ্ঘনের কারণ, প্রতিকার ও প্রমাণ স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকবে। প্রয়োজন মনে করলে কমিশন ৩০ দিনের মধ্যে অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দিতে পারবে। তদন্ত শেষে অভিযোগ প্রমাণিত না হলে নথিজাত হবে, আর প্রমাণিত হলে কমিশন উভয় পক্ষের উপস্থিতিতে শুনানির দিন নির্ধারণ করবে’।

১৫ নম্বর ধারার ১০ নম্বর উপধারায় বলা হয়েছে, ‘শুনানিতে অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হলে এবং বিষয়টি ফৌজদারি বা অন্য আদালতের এখতিয়ারে পড়লে কমিশন প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট আদালতে পাঠাবে এবং অভিযোগকারীকে সেখানে যাওয়ার পরামর্শ দেবে। তবে বিষয়টি কমিশনের এখতিয়ারে থাকলে কমিশন ক্ষতিপূরণ বা জরিমানার আদেশ দিতে পারবে এবং প্রয়োজনে অন্য বিভাগীয় বা প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করবে, যা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দুই মাসের মধ্যে বাস্তবায়ন করবে’।

হাসিনার আমলের ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’ কমিশন

২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় মানবাধিকার কমিশন গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয় এবং ২০০৮ সালের ৯ ডিসেম্বর কার্যক্রম শুরু করে। পরবর্তীতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০১০ সালের ১৪ জুলাই সংসদে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইনটি পাস হয়।

মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবীদের অভিযোগ, আওয়ামী লীগ সরকার দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে চেয়ারম্যান এবং সদস্য নিয়োগ দিয়ে কমিশনকে ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’-এ পরিণত করেছিল। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে গুম ও নির্যাতনের অগণিত ঘটনার পরও কমিশন নীরব থেকেছে।

২০২৪ সালে শেখ হাসিনার পতন ও পলায়নের পর কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামালউদ্দিন আহমেদসহ অন্যান্য সদস্য পদত্যাগ এবং আত্মগোপনে চলে গেলে প্রতিষ্ঠানটি পুরোপুরি অকার্যকর হয়ে পড়ে।

আইন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, শেখ হাসিনার সময়কার আইন মানবাধিকার রক্ষার জন্য নয়, বরং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাকে বৈধতা দেওয়ার জন্যই করা হয়েছিল।

মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় ব্যবস্থা নিতে না পারার আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক। আমার দেশকে তিনি বলেন, কমিশন কার্যকর না হওয়ার বড় কারণ দুর্বল আইন ও আমলানির্ভরতা। কমিশনের আইনকে শক্তিশালী করতে হবে, চেয়ারম্যান-সদস্যদের কাজের স্বাধীনতা দিতে হবে। পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত করার ক্ষমতা থাকতে হবে। পরমুখাপেক্ষী হওয়া যাবে না। তাহলেই কমিশন কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারবে।

মানবাধিকারকর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক নুর খান লিটন আমার দেশকে বলেন, বিগত সরকার কমিশনকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করেছে। সরকার দলীয় বিবেচনায় নিজেদের পছন্দের লোকদের কমিশনে চেয়ারম্যানসহ অন্যান্য পদে নিয়োগ দিয়েছিল। ফলে তারা মানবাধিকার রক্ষার চেয়ে দলীয় স্বার্থকেই প্রাধান্য দিয়ে কাজ করেছেন।

আন্তর্জাতিক এই মানবাধিকারকর্মী আরো বলেন, ১৬ বছর দেশে স্বৈরতন্ত্র চরমভাবে বলবৎ ছিল। কমিশনে যাদের চেয়ারম্যান-মেম্বার নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, তারা সরকারের আজ্ঞাবহ ছিলেন। সরকারের সামনে নতজানু হয়ে ছিলেন। তাদের মেরুদণ্ড শক্ত ছিল না। তাই এবার দেখে-শুনে-বুঝে নিয়োগ দিতে হবে।

আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল আমার দেশকে জানান, মানবাধিকার কমিশন গত ১৬ বছরে কেন ব্যর্থ হয়েছে, প্রথমত আমরা সেটি সনাক্ত করার চেষ্টা করেছি। আমরা দেখেছি, ইতিপূর্বে মানবাধিকার কমিশনে যারা দায়িত্ব পালন করেছেন, তাদের বাছাইপ্রক্রিয়া সম্পূর্ণভাবে সরকারের হাতে কেন্দ্রীভূত ছিল। এবার আমরা একটি স্বাধীন বাছাই কমিটির বিধান এনেছি, যেখানে সরকারের প্রভাবের বাইরে গিয়ে নাগরিক সমাজ কমিশনারদের বাছাই করবেন। কমিশনারদের নিয়োগে গণবিজ্ঞপ্তি, সাক্ষাৎকারের বিধান প্রবর্তন করেছি, কমিশনারদের যোগ্যতা হিসেবে তাদের মানবাধিকার নিয়ে কাজ করার রেকর্ড আছে কি না, সেগুলো দেখার কথা বলেছি। আমরা কমিশনারদের সংখ্যা ৩ থেকে ৭-এ উন্নীত করেছি।, যেখানে এক-তৃতীয়াংশ নারী এবং সংখ্যালঘু ও সুবিধাবঞ্চিতদের প্রতিনিধি রাখার বিধান করেছি।

দ্বিতীয়ত, আমরা কমিশনের ক্ষমতাকে সুসংহত করার চেষ্টা করেছি। আগের আইনে শৃঙ্খলা-বাহিনীর বিষয়ে কমিশন কোনো তদন্ত করতে পারত না। আমরা এই বিধান বাদ দিয়েছি। ফলে মানবাধিকার কমিশন যেকোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে ব্যবস্থা নিতে পারবে। পূর্বে কমিশন কেবল সুপারিশমূলক কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, আমরা এবার কমিশনকে ক্ষতিপূরণ আদায় কিংবা জরুরি যেকোনো আদেশ দেয়ার ক্ষমতা দিয়েছি, প্রয়োজনে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমা করার ক্ষমতা দিয়েছি। কমিশনের আদেশ প্রতিপালনকে বাধ্যতামূলক করেছি। পূর্বে কমিশন সরকারি ও বেসরকারি অনুদানের ওপর নির্ভরশীল ছিল। আমরা কমিশনের আর্থিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য কমিশনের ব্যয়কে রাষ্ট্রের বাধ্যতামূলক আর্থিক দায় হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছি এবং অর্থব্যয়ে কমিশনকে সর্বোচ্চ স্বাধীনতা দিয়েছি। কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেনশন, গ্র্যাচুইটি এসব সুবিধা ছিল না, ফলে কমিশনে মেধাবীরা বেশিদিন কাজ করতে চাইত না। আমরা তাদের জন্য সরকারি কর্মচারীদের সব সুযোগসুবিধা নিশ্চিত করার চেষ্টা করছি।

কমিশনের পরিচালনায় নাগরিক সমাজকে যুক্ত করার বিধান রেখেছি। নাগরিক সমাজের পরামর্শের ভিত্তিতেই আমরা এই আইন সংশোধন করেছি। এসব নতুন বিধান যুক্ত করার ফলে কমিশন এই অজুহাত দিতে পারবে না যে, তার আইনগত বা প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, ভবিষ্যতে কমিশন মানবাধিকার রক্ষায় বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত