ঢাকা মহানগরীতে মশার দাপট এখন নাগরিক সংকটে রূপ নিয়েছে। সেই সঙ্গে আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়েছে অতীতের যে কোনো সময়কে। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন রোগীরা। এর মধ্যে আবার কিউলেক্সের চোখ রাঙানিতে তটস্থ রাজধানীবাসী। ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে দেশে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে।
চলতি বছর এ পর্যন্ত একদিনে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ মৃত্যু এটি। এ সময় নতুন করে আরো ১৫৯ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১২৪ জন আক্রান্ত হয়েছেন বরিশাল বিভাগে।
গতকাল শুক্রবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোলরুম থেকে পাঠানো ডেঙ্গুবিষয়ক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ২৪ ঘণ্টায় বরিশাল বিভাগে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়াও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে একজনের মৃত্যু হয়েছে। সব মিলিয়ে চলতি বছরে এ যাবৎ ডেঙ্গুতে ২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে।
এর মধ্যে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেশি বলে জানা গেছে। ২৪ ঘণ্টায় দক্ষিণ সিটিতে ১২ জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
অধিদপ্তর আরো জানায়, চলতি বছরের গত পাঁচ মাসে (এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত) সরকারি হিসাবে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন পাঁচ হাজার ৫৭০ জন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ধরন পাল্টে দেশে স্থায়ী হয়ে গেছে এডিস মশা। কিউলেক্স মশার প্রজননও বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা এতে শঙ্কিত হয়ে জরুরি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দিয়েছেন। একই সঙ্গে সরকারকে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমাতে এখনই জোরালো পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান তারা।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এডিস ও কিউলেক্স মশা। গত কয়েক মাস ধরে মশার কামড়ে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন বাসিন্দারা। বিশেষ করে দিনে এডিস ও সন্ধ্যার পরপরই কিউলেক্স মশার যন্ত্রণায় ঘরে-বাইরে অতিষ্ঠ মানুষ। এক সময় রাজধানীতে নির্দিষ্ট সময়ে মশার উপদ্রব বেশি থাকলেও এখন তা বছরজুড়েই এবং ২৪ ঘণ্টাই দেখা যাচ্ছে। দিন যত গড়াচ্ছে, মশার যন্ত্রণা নিয়ে নগরীতে আতঙ্ক তত বাড়ছে।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিভিন্ন এলাকায় প্রধান সড়ক থেকে শুরু করে অলিগলি থেকে সম্পূর্ণভাবে বর্জ্য অপসারণ না হওয়ায় ঈদের পরপরই মশার উৎপাত বেড়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অবহেলাকেই মশা বাড়ার জন্য দায়ী করছেন এলাকাবাসী।
সরেজমিন দেখা যায়, নগরীর মশার উৎপাতপ্রবণ এলাকাগুলোর মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ সিটি করপোরেশেনের বিল ও জলাশয়গুলো-ডেমরা, সারুলিয়া, পাইটি, ডিএনডি বাঁধ, শনির আখড়া, মাতুয়াইল, শ্যামপুর, রায়েরবাগ, পুরান ঢাকা, যাত্রাবাড়ী, জুরাইন, মীরহাজীরবাগ।
ছোট খালযুক্ত এলাকার মধ্যে কমলাপুর, মান্ডা, মুগদাপাড়া, পুরান ঢাকার কিছু এলাকা, মিরপুর, গাবতলী, মোহাম্মদপুর, শ্যামলী, আদাবর, আফতাবনগর রামপুরাসহ আরো কিছু এলাকা। হাতিঝিল এলাকার আওতায় থাকা রামপুরা, মগবাজার, তেজগাঁও এলাকা ও মহানগর প্রজেক্ট এলাকার বাসিন্দারা মশার অত্যাচারে অতিষ্ঠ।
মগবাজারের চেয়ারম্যান গলির ব্যবসায়ী সোহেল, খিলগাঁওয়ের মো. আদিল, শনির আখড়ার অধ্যাপক আবু সাইয়েদ, মাতুয়াইলের শফিকুর রহমান, ডেমরার মতিউর রহমান শিকদার, শ্যামলীর সাইফুল ইসলাম, মোহাম্মদপুরের গৃহিণী মুন্নি বেগম, কৃষি মার্কেট এলাকার তাসমীমা কাশেম, পুরান ঢাকার নবাবগঞ্জ এলাকার কবিতা আক্তার, সাবু চৌধুরী, মীরপুর মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের বাসিন্দা রেবা আক্তারসহ অনেকে আমার দেশকে এডিস ও কিউলেক্স মশার উৎপাতের বিষয়টি জানান। তারা বলেন, মশা হঠাৎ এত বেড়েছে যে, রাতদিন সমানে কামড়াচ্ছে। মশার অত্যাচারে স্বাভাবিকভাবে বসবাস করা যাচ্ছে না। বিশেষ করে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় আমরা আতঙ্কে রয়েছি। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে শিগগিরই কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানান তারা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত এক হাজার ১৬১ জন ও মৃত্যু ১০ জন, ফেব্রুয়ারিতে আক্রান্ত এক হাজার ৫৩৫ জন ও মৃত্যু ১৩ জন, মার্চ মাসে আক্রান্ত এক হাজার ৮৭১ জন ও মৃত্যু ১৩ জন, এপ্রিল মাসে আক্রান্ত দুই হাজার ৫৭২ জন ও মৃত্যু ২০ জন, মে মাসে আক্রান্ত চার হাজার ৩৪৫ জন ও মৃত্যু ২৩ জন। চলতি জুন মাসে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে। কিন্তু আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, স্বাস্ত্য অদিপ্তরের এ পরিসংখ্যানের মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ডেঙ্গু রোগীর সেংখ্যা বেশি বলে জানিয়েছে অধিদপ্তর।
বিশেষজ্ঞ যা বলেছেন
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার আমার দেশকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, মশা বৃদ্ধি পাওয়ায় নগরবাসীর কষ্ট সহজেই অনুমান করা যায়। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে দুই সিটি করপোরেশনের উচিত ডেঙ্গুর মতো কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণেও পদক্ষেপ নেওয়া। যেহেতু ডেঙ্গু বাড়ছে আর সেটা শুধু দুই সিটি করপোরেশনেরই নয়, সারা দেশেই বেড়েছে। তাই ডেঙ্গুর প্রকোপ কমানোর জন্য সরকারকে এই মুর্হূতে জোরালো পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
তিনি বলেন, আমাদের সঙ্গে সিটি করপোরেশনের সমঝোতা স্মারকে বেশ কয়েকটি শর্ত ছিল, যার অধিকাংশই পূরণ হয়নি। শুধু একটি শর্ত তারা পালন করছে, সেটি হলো ডিএনসিসির পাঁচটি জোনে শুধু গবেষণা করা। অর্থাৎ ওয়ার্ডগুলোয় মশার লার্ভা কেমন আছে, কোনটাতে বেশি, কোনটাতে কম, কোন ওয়ার্ডে বেশি ওষুধ ছিটাতে হবে বা কোন ধরনের ওধুষ ছিটাতে হবে-কেবল এসব নিয়ে কাজ হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, প্রতি সপ্তাহে আমরা ডিএনসিসিতে এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন পাঠাচ্ছি। তবে তারা কাজ করছে কি না তা জানি না।
দুই সিটি করপোরেশনের যত উদ্যোগ
এডিস মশার বিস্তার রোধে প্রতিদিন দ্বিগুণ হারে কীটনাশক প্রয়োগ, অঞ্চলভিত্তিক ডেঙ্গু মনিটরিং টিম গঠন ও জনবল ঘাটতি পূরণে উদ্যোগসহ জনগুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে দক্ষিণ সিটি। গত বুধবার করপোরেশন এলাকায় এডিস মশার বিস্তার রোধে করণীয় নির্ধারণ ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও করোনা প্রতিরোধে একটি জরুরি সভায় এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
প্রশাসক মো. শাহজাহান মিয়ার সভাপতিত্বে রাজধানীর ওয়াসা ভবনের সম্মেলন কক্ষে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় এডিস মশার বিস্তার রোধকে বর্তমানে সর্বোচ্চ গুরত্বপূর্ণ এজেন্ডা নির্ধারণ করে বিস্তারিত আলোচনা হয়। সভায় এডিস মশার বিস্তার রোধে তাৎক্ষণিক ফলাফল লাভে ১৪ জুন থেকে ডিএসসিসি এলাকায় অ্যাডাল্টিসাইডিং কার্যক্রমে (ফগার মেশিন দ্বারা পরিচালিত) বর্তমানে ব্যবহৃত ৩০ লিটার কীটনাশকের পরিবর্তে দ্বিগুণ পরিমাণ অর্থাৎ ৬০ লিটার কীটনাশক প্রতিদিন ব্যবহারের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
অন্যদিকে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে নগরবাসীকে সচেতন করতে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করছে উত্তর সিটি করপোরেশন। সে লক্ষ্যে ওষুধ ছিটানোর পাশাপাশি সচেতনতামূলক বার্তা প্রচারের জন্য হ্যান্ডমাইক ও মেগাফোন ব্যবহার করবে সংস্থাটি।

