বর্তমানে কর্মক্ষেত্রে নারীর সংখ্যা বাড়লেও বাড়েনি তাদের নিরাপদ আবাসনের সুযোগ। ফলে পদে পদে হয়রানি ও নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে দেশের শহরকেন্দ্রিক প্রায় অর্ধকোটি কর্মজীবী নারীকে। ভুক্তভোগী এসব শ্রমজীবী নারীর আবাসন সংকট নিরসনে সরকারি সংস্থা মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের সারা দেশে রয়েছে মোট আটটি কর্মজীবী মহিলা হোস্টেল। এর মধ্যে ঢাকার নীলক্ষেত, মিরপুর, খিলগাঁওয়ে তিনটি। এগুলো রাজস্ব খাতের, বাকিগুলো স্ব-অর্থায়নে। বাকি পাঁচটি হোস্টেল সাভারের বড় আশুলিয়া, খুলনা, যশোর, রাজশাহী ও চট্টগ্রামে অবস্থিত।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে কর্মক্ষেত্রে নিয়োজিত নারীর সংখ্যা ২ কোটি ৪৫ লাখ ১০ হাজার। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারি আটটি হোস্টেলে মোট আবাসনের সুযোগ রয়েছে মাত্র ১ হাজার ৯১৩ জনের। প্রয়োজনের তুলনায় যা খুবই অপ্রতুল। আবার বেসরকারি হোস্টেলগুলোতে নিরাপত্তাহীনসহ রয়েছে নানা ধরনের ‘উটকো ঝামেলা’। সব দিক বিবেচনায় সরকারি হোস্টেলগুলোই কর্মজীবী নারীদের একটি বড় ভরসার জায়গা। এ কারণে বিপুল চাহিদা থাকলেও অনেককেই হতাশ হতে হয় আসন না পেয়ে।
এ ছাড়া নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে অনেকে বছরের পর বছর হোস্টেলের সিট দখলে রাখেন, যে কারণে বঞ্চিত হচ্ছেন অন্যরা। সূত্র জানিয়েছে, সরকারি হোস্টেলগুলোতে আবেদনকারীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সিট প্রার্থীদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা অনার্স পাস করেছেন কর্তৃপক্ষ। তবে, সাভার ও গাজীপুরের হোস্টেল ছাড়া অন্যগুলোতে আসন খুব একটা ফাঁকা থাকে না। সংশ্লিষ্টদের দাবি, নিয়মের ব্যত্যয় রোধ করা গেলে সীমিত পরিসরে হলেও হোস্টেলগুলোর আসন-সংকট সমাধান করা সম্ভব।
সরেজমিনে রাজধানীর নীলক্ষেত এলাকায় কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলে দেখা গেছে, এক ঘণ্টার ব্যবধানে ৭ থেকে ৮ জন নারী এখানে আসনের খোঁজে আসেন। তাদের মধ্যে জান্নাতুল নামের একজন জানান, ‘এত দিন মামার বাসায় ছিলেন। এখন তার নিজস্ব একটি আশ্রয় দরকার। এ কারণে এখানে আসন পেতে চেষ্টা চালাচ্ছেন তিনি।’
সুবিধাজনক অবস্থানের কারণে রাজধানীর বাবুপুরা নীলক্ষেত এলাকার কর্মজীবী নারী হোস্টেলটিতেই আবেদন পড়ে সবচেয়ে বেশি। এই হোস্টেলটির ১০ তলা দুটি ভবনে বসবাসের সুযোগ আছে মাত্র ৫২০ জন কর্মজীবীর। এর মধ্যে ৫০৩টি বোর্ডার সিট আর ১৭টি গেস্ট সিট। মিরপুরের নওয়াব ফয়জুনন্নেসা কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলে আছে ২০৪টি সিট। খিলগাঁওয়ে বেগম রোকেয়া কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলে ২১০টি সিটের মধ্যে ২০০টি সাধারণের এবং ১০টি অতিথিদের জন্য।
গাজীপুরের কালীগঞ্জে প্রীতিলতা কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলে আসন সংখ্যা ১২৪টি, সাভারের বড় আশুলিয়ায় গার্মেন্টস কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলে আসনসংখ্যা ৩৮৮টি। চান্দগাঁও আবাসিক এলাকা চট্টগ্রামের কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলে ২২১টি আসনের মধ্যে ২১৫টি বোর্ডার সিট আর ছয়টি অতিথির জন্য। রাজশাহীর বিলসিমলায় কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলে আসন ১৩২টি। এর মধ্যে ১২০টি বোর্ডার সিট আর গেস্ট সিট ১২টি। খুলনার বয়রায় কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলে আসন সংখ্যা ৭০টি। এছাড়া ট্যাঙ্ক রোড যশোরের কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলে আসন মাত্র ৪৪টি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই বছরের পর বছর নীলক্ষেত নারী হোস্টেলে থাকছেন বহু নারী। ১৪ থেকে ২২ বছর ধরে হলে আছেন প্রায় শতাধিক নারী। কর্তৃপক্ষ জানায়, এদের মধ্য থেকে সম্প্রতি হোস্টেলে দীর্ঘ সময় ধরে থাকা ২৫ জনকে হোস্টেল ছেড়ে যেতে বলা হয়েছে। তাদের মধ্যে ১৯ জন এরই মধ্যে চলে গেছেন। আর ছয়জন এখনো যাননি।
হোস্টেল সূত্র জানায়, এসব কর্মজীবী নারীর মধ্যে যিনি সবচেয়ে কম সময় থেকেছেন তার মেয়াদ ১৪ বছর ৫ মাস। আর যিনি সবচেয়ে বেশি তার ২২ বছর ধরে থাকার নজির রয়েছে।
হোস্টেল সুপার ছামিনা হাফিজ আমার দেশকে বলেন, এখানে একজন নারী তিন বছর টানা থাকতে পারেন তারপর সিট ছেড়ে দেওয়ার নিয়ম। তবে ডিজি সাহেবের কাছে আবেদন করে আরো এক বছর থাকার সুযোগ রয়েছে। এরপর আমরা হোস্টেল ছাড়ার নোটিস দেই। কিন্তু এরপরই শুরু হয় নানা টালবাহানা। অনেক সময় এ নিয়ে আন্দোলন করে তারা নোটিস স্থগিত করেন। আবার কখনো আদালতে গিয়ে অসহায়ত্ব দেখিয়ে স্টে অর্ডার নিয়ে আসেন। তাই সিট খালি হওয়ার সংখ্যা অনেক কম। এ ছাড়া এমন অনেকেই থাকেন যারা কর্মজীবী নন; বরং ভুয়া নিয়োগপত্র দেখিয়ে তারা দিনের পর দিন হোস্টেলে থাকছেন।
ছামিনা হাফিজ আরো বলেন, বার বার অনুরোধ করেও তাদের হোস্টেল ছাড়াতে পারছি না। এত দীর্ঘ সময় ধরে কীভাবে তারা একই হোস্টেলে থাকেনÑ জানতে চাইলে হোস্টেল সুপার বলেন, মানবিক দিক বিবেচনায় কর্তৃপক্ষ যেন তাদের আরো কিছু সময় হোস্টেলে থাকার সুযোগ দেন বলে এখনো দাবি করে যাচ্ছেন তারা। অথচ তারা নিয়ম মেনে চলে গেলে হোস্টেলে নতুন কর্মজীবী নারীরা থাকার সুযোগ পেতেন।
জানতে চাইলে সর্বোচ্চ সময় ধরে হোস্টেলে থাকা কর্মজীবী নারী সামিনা আক্তার বলেন, আমরা হোস্টেলের নীতিমালা মানিনি এটা হয়তো ঠিক। তবে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়েই তো এতদিন থেকেছি। কর্তৃপক্ষ চাইলে এখনো মানবিক কারণে আমাদের আরো কিছু সময় হোস্টেলে থাকার সুযোগ করে দিতে পারে। তাছাড়া আমরা তো সব ধরনের আইন মেনেই এখানে থাকছি।

