আগে শুধু বর্ষা মৌসুমে মশার উপদ্রব বাড়লেও এখন বছরজুড়েই মশায় অতিষ্ঠ নগরবাসী। ‘ডেঙ্গুর মৌসুম মে মাস’ শুরুর আগেই রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন প্রায় ৫০ জন রোগী হাসপাতালে যাচ্ছেন। বর্ষার আগে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় মশার উপদ্রব বাড়লেও নেই সিটি করপোরেশনের তৎপরতা। কিছু জায়গায় ওষুধ ছিটানো হলেও এটিকে লোক দেখানো বলে অভিযোগ নগরবাসীর।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, বছরের শুরু থেকে চলতি এপ্রিল মাস পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ২ হাজার ৫০০ জন। আর মৃত্যুর সংখ্যাটাও ২০ ছুঁই ছুঁই। যদিও এতে যুক্ত নেই বেশিরভাগ বেসরকারি হাসপাতালের তথ্য। আর ২০২৪ সালে ডেঙ্গুতে ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় মারা গেছে সাড়ে ৩০০-এর বেশি মানুষ। এর মধ্যে ২৩৯ রোগীর মৃত্যু হয়েছে দক্ষিণ সিটির হাসপাতালগুলোতে। আর উত্তর সিটিতে মারা গেছে ১০৪ জন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ডেঙ্গু রোগের মৌসুম ধরা হয় মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ডেঙ্গু বছরব্যাপী হচ্ছে। এর মধ্যে আক্রান্তের হার সবচেয়ে বেশি থাকে জুলাই-আগস্ট মাসে। কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, বর্ষা আসার আগেই মশা নিধনে কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে মশাবাহিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বেন নগরবাসী।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে মশা নিধনের জন্য দুই সিটির বাজেট ছিল ১৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ৪০ কোটি ও উত্তর সিটিতে ১১০ কোটি টাকা। রাজধানীবাসীর দাবি প্রতি বছর বিশাল অংকের বাজেট হয়, খরচও হয়; কিন্তু তাদের যন্ত্রণা লাঘব হয় না। মশাবাহিত রোগের প্রার্দুভাবও কমে না; বরং প্রত্যেক মৌসুমে মহামারি আকারে মশাবাহিত রোগগুলোর প্রকোপ বেড়ে যাচ্ছে।
সরেজমিনে জানা গেছে, দিন কিংবা রাত নেই, ঘুমাতে হলে মশারির বিকল্প নেই। মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ জনজীবন। বাসা-বাড়ি থেকে অফিস আদালতÑ সব জায়গায় মশা বেড়েছে মাত্রাতিরিক্ত। বিশেষ করে রাজধানীর মোহাম্মদপুর, শ্যামলী, মিরপুর, উত্তরা, খিলগাঁও, মহাখালী, গুলশান, বাড্ডা, শাহজাদপুর, নদ্দা, নতুনবাজার, কড়াইল, রামপুরা, আফতাবনগর, মুগদা, মানিকনগর, সায়েদাবাদ, মীরহাজারীবাগ, জুরাইন, শাঁখারীবাজার, শনিরআখড়া, দনিয়া, মাতুয়াইল, ডেমরা ৭০ নম্বর ওয়ার্ড, পাইটি এলাকাগুলোতে লেক, খাল ও জলাশয় থাকায় মশার প্রজননস্থল তৈরি হয়েছে। এ কারণে এসব এলাকায় মশার উপদ্রব বেশি বলে জানিয়েছেন বাসিন্দারা।
নগরবাসীর অভিযোগ, কল্যাণপুর, গুলশান, বনানী, বারিধারার মতো যেসব এলাকায় লেক ও জলাধর আছে সেগুলো ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। এ ছাড়া রাজধানীর মগবাজার এলাকায় মশার উপদ্রব অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। এর কারণ হিসেবে তারা দোষারোপ করছেন হাতিরঝিল লেকটিকে। নিয়মিত পরিষ্কার না করায় জলাশয়টি এখন মশার প্রজননস্থল। ওষুধ ছিটালেও তা কাজে আসছে না। তবে মশার উৎপাত কমাতে সম্প্রতি রাজউকের উদ্যোগে কিছু হাঁস ছাড়া হয়েছে।
রাজধানীর শনিরআখড়ার পলাশপুর এলাকার বাসিন্দা অধ্যাপক আবু সাইদ বলেন, ‘মশার উৎপাতে জীবন অতিষ্ঠ। গত এক বছর ধরে সিটি করপোরেশনকে ফোন দিলেও কাজ হয়নি। পরে সচিবালয়ের ঊর্ধ্বতন কারও সঙ্গে যোগাযোগ করার পরে জানুয়ারি মাসে একবার মশার ওষুধ দিয়ে যায়। কিন্তু এরপরে আর আসেনি।’
মানিকনগরের পারুল বেগম বলেন, ‘গত এক মাস ধরে দিনে-রাতে সমান মশা। কামড় দিলে ফুলে ওঠে ও চুলকায়। বাচ্চাদের দিনেও মশারির মধ্যে রাখতে হয়। সিটি করপোরেশনের লোকজনকে ওষুধ ছিটাতে গত এক সপ্তাহে দেখিনি।’
ডিএনসিসি প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ সম্প্রতি একাধিক গণশুনানিতে জানিয়েছেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে মশা নিয়ন্ত্রণ জরুরি, কিন্তু বাড়ি-ঘরে মশা নিধন কঠিন। কারণ ৯০ শতাংশ বাড়ির পাশে ময়লা পাওয়া যাবে। বাড়ির মালিকরা ঠিকমতো পরিষ্কার করেন না। লার্ভা মারার জন্য যে ওষুধ দিতে হচ্ছে, নিরাপত্তার কথা বলে সিটি করপোরেশনের লোকজনকেও ঢুকতে দেন না।
ডেঙ্গু রোধে এডিস মশার প্রজননস্থল নিয়ন্ত্রণ ছাড়া কোনো কার্যকর সমাধান সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ ও অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার। তিনি বলেন, মূল ব্যর্থতা হলো মনিটরিংয়ে। কোনো কাজ বা প্রজেক্ট যদি সঠিকভাবে মনিটরিং না করা হয়, তবে তার ফল ভালো আসে না। মাঠে যারা মশককর্মী কাজ করে তারা ঠিকমতো কাজ করছে কি না সেটা যদি মনিটরিং করা না হয় তবে মশা নিয়ন্ত্রণ হবে না।
ডেঙ্গু মশার উপদ্রব কমানোর পরামর্শ দিয়ে ড. কবিরুল বাশার বলেন, বাংলাদেশের তাপমাত্রা সারা বছরই এডিস মশার প্রজননের জন্য উপযোগী। যদি শীতকালে কোথাও পানি জমা থাকে তাহলে সে সময়ও আমরা মাঠপর্যায়ে ডেঙ্গু দেখতে পাই। তাই ডেঙ্গুর প্রজনন রোধে পানি জমে থাকা বন্ধ করতে হবে। পানি জমে থাকলে শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষাÑ যে কোনো সময়ই ডেঙ্গু হবে। এ বছর শীত মৌসুম ডিসেম্বরেও ডেঙ্গুর প্রকোপ থাকবে বলেও মনে করেন তিনি।

