আমার দেশ জনপ্রিয় বাংলা নিউজ পেপার

বিশাল সংবর্ধনায় আজ ফিরছেন তারেক রহমান

জাহিদুল ইসলাম

বিশাল সংবর্ধনায় আজ ফিরছেন তারেক রহমান
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে সংবর্ধনা দিতে রাজধানীর ৩০০ ফিট এলাকায় তৈরি মঞ্চ ঘিরে বুধবার নেতাকর্মীর ভিড়। ছবি: আমার দেশ

প্রায় দেড় যুগের নির্বাসিত জীবন শেষে আজ বৃহস্পতিবার দেশের মাটিতে পা রাখছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। রাজনৈতিক অঙ্গনে বহুল আলোচিত এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে ঘিরে দলটির কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সর্বস্তরের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে বইছে উচ্ছ্বাসের জোয়ার।

দিনটিকে ঐতিহাসিক ও স্মরণীয় করে রাখতে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে বিএনপি। ‘প্রাণপ্রিয় নেতাকে’ এক নজর দেখতে, তাকে স্বাগত জানাতে শুধু ঢাকা নয়, সারা দেশ থেকেই রাজধানীমুখী হচ্ছেন লাখো মানুষ। অভ্যর্থনা কমিটির প্রত্যাশাÑ গণসংবর্ধনায় ৫০ লাখ মানুষের সমাগম হবে। যেখানে দলীয় নেতাকর্মীর বাইরে সাধারণ মানুষেরও অংশগ্রহণ থাকবে।

বিজ্ঞাপন

গতকাল বুধবার থেকেই ঢাকামুখী হচ্ছেন বিভিন্ন জেলার নেতাকর্মীরা। প্রতিটি বিভাগ থেকে তিন থেকে চার লাখ এবং প্রতিটি জেলা থেকে অন্তত ৩০ থেকে ৪০ হাজার নেতাকর্মী ঢাকায় জড়ো করার পরিকল্পনা রয়েছে তৃণমূলের। বিমানবন্দর এলাকাসহ গোটা ঢাকা জনসমুদ্রে পরিণত করার টার্গেট রয়েছে বিএনপির।

লাখ লাখ নেতাকর্মী ঢাকায়

তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে ঘিরে দেশের প্রতিটি জেলা থেকে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠন—ছাত্রদল, যুবদল, কৃষকদল, শ্রমিক দল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের লাখ লাখ নেতাকর্মী ঢাকায় আসছেন। বাস, ট্রেন, মিনিবাস, মাইক্রোবাস ও প্রাইভেটকারে করে অনেকেই ইতোমধ্যে রাজধানীতে পৌঁছেছেন। কয়েকটি জেলায় এ উপলক্ষে আনন্দ মিছিলও হয়েছে।

দলীয় সূত্র জানায়, তারেক রহমান গতকাল বুধবার মধ্যরাতে লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দর থেকে বাংলাদেশ বিমানের একটি নিয়মিত বাণিজ্যিক ফ্লাইটে স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমান, মেয়ে জাইমা রহমানসহ পরিবারের পাঁচ সদস্যকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন। স্বদেশ প্রত্যাবর্তন কমিটির আহ্বায়ক ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ জানান, সিলেটে যাত্রাবিরতির পর বিমানটি বেলা ১১টা ২০ মিনিটে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করার কথা রয়েছে।

বিমানবন্দরে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যরা তাকে অভ্যর্থনা জানাবেন। এরপর রজনীগন্ধা লাউঞ্জে সংক্ষিপ্ত অবস্থান ও জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় শেষে তিনি সড়কপথে এভারকেয়ার হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা হবেন। পথে জুলাই ৩৬ এক্সপ্রেসওয়ে (৩০০ ফুট সড়ক) এলাকায় আয়োজিত সংক্ষিপ্ত গণসংবর্ধনায় তিনি অংশ নিয়ে দেশবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা ও মহান আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করবেন।

এরপর তিনি এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তার মা, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে দেখতে যাবেন। সেখান মায়ের চিকিৎসার জন্য গঠিত মেডিকেল বোর্ডের চিকিৎসকের সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলবেন এবং মায়ের স্বাস্থ্যের খোঁজ নেবেন। মায়ের সঙ্গে কিছু সময় কাটিয়ে তিনি গুলশানের বাসভবনের উদ্দেশে রওনা হবেন। সেখানে তিনি ফিরোজা নাকি ১৯৬ নম্বর নিজ বাসভবনে উঠবেন—এ বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।

২৬ ও ২৭ ডিসেম্বর কর্মসূচি চূড়ান্ত

তারেক রহমানের দেশে ফেরার পরের দুদিনের কর্মসূচি চূড়ান্ত করেছে বিএনপি। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ জানান, শুক্রবার জুমার পর রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে বাবা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কবর জিয়ারত করবেন তারেক রহমান। এরপর সড়কপথে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে গিয়ে বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন।

পরদিন শনিবার তিনি ভোটার নিবন্ধনের জন্য রাজধানীর আগারগাঁও নির্বাচন ভবনে যাবেন। নিবন্ধন শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মাজারে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শহীদ শরীফ ওসমান হাদির কবর জিয়ারত করবেন। এরপর তিনি জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্র (পঙ্গু হাসপাতাল) গিয়ে জুলাই অভ্যুত্থানে আহতদের খোঁজ নেবেন। এর পরবর্তী দিনের কর্মসূচি পরে জানানো হবে বলে জানান সালাহউদ্দিন আহমেদ।

জনভোগান্তির জন্য অগ্রিম দুঃখ প্রকাশ

তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে নেওয়া অনিবার্য ও ন্যূনতম কর্মসূচির কারণে জনসাধারণের অসুবিধার জন্য বিএনপির পক্ষ থেকে আগাম দুঃখ প্রকাশ করেন সালাহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, জনভোগান্তি কমাতে ছুটির দিনগুলোতেই কর্মসূচি রাখা হয়েছে। তারেক রহমান এমন কোনো কর্মসূচিকে সমর্থন করেন না, যা সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের কারণ হয়।

তিনি আরো জানান, ‘৩০০ ফুট সড়কে’ আয়োজিত অনুষ্ঠানটি কোনো জনসভা নয়, সংবর্ধনা অনুষ্ঠানও নয়। এটি কেবল দেশবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও দেশনেত্রীসহ সবার কল্যাণ কামনায় দোয়ার আয়োজন। সেখানে তারেক রহমান ছাড়া আর কোনো বক্তা থাকবেন না। আমরা এই আয়োজনের কলেবর যত ছোটই রাখতে চাই না কেন, ১৭ বছর ধরে অপেক্ষমাণ দেশের সব প্রান্ত থেকে আসা নেতাকর্মী-সমর্থকদের বাঁধভাঙা স্রোত নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা আমাদের নেই।

দলীয় নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষই নিরাপত্তার মূল ভিত্তি

বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) একেএম শামছুল ইসলাম বলেন, দলের নিজস্ব নিরাপত্তাব্যবস্থাই সর্বোচ্চভাবে কাজে লাগানো হবে। তিনি বলেন, আমাদের দলগত নিরাপত্তাব্যবস্থার একটি ক্ষুদ্র অংশ হচ্ছে চেয়ারপারসন সিকিউরিটি ফোর্স (সিএসএফ)। এর বাইরে আমাদের দলীয় নেতাকর্মী এবং সর্বোপরি দেশের সাধারণ মানুষই আমাদের নিরাপত্তার মূল ভিত্তি।

তিনি আরো বলেন, সরকার থেকেও সর্বোচ্চ সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে। এ লক্ষ্যে বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থাকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে দলীয় নিরাপত্তাব্যবস্থাকে সমন্বিত করে সম্ভাব্য সব ধরনের হুমকি মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানান তিনি।

রেড, ইয়েলো ও হোয়াইট জোনে বিশেষ নিরাপত্তা

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, তারেক রহমানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রেড, ইয়েলো ও হোয়াইটÑতিনটি জোনে ভাগ করে নিরাপত্তা পরিকল্পনা করা হয়েছে। এ বিষয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশনায় একাধিক বৈঠক হয়েছে, যেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট ও সিএসএফ অংশ নেয়।

বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, রেড ও ইয়েলো জোনের বাইরের এলাকা হোয়াইট জোন হিসেবে বিবেচিত হবে, যেখানে নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের চলাচল থাকবে। তারেক রহমানের আগমনের দিন পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রায় দুই হাজার সদস্য নিরাপত্তার দায়িত্বে মোতায়েন থাকতে পারে।

এদিকে নিরাপত্তা জোরদারে বিএনপি একটি বুলেটপ্রুফ গাড়ি কিনেছে, যা ইতোমধ্যে দেশে পৌঁছেছে। পাশাপাশি বিদেশ থেকে আমদানি করা টয়োটা ল্যান্ডক্রুজার প্রাডো এলসি ২৫০ মডেলের একটি গাড়ি বাংলাদেশে নিবন্ধিত হয়েছে। আরেকটি বুলেটপ্রুফ গাড়িও ঢাকায় এসে পৌঁছেছে বলে জানা গেছে।

বিমানবন্দর ও এভারকেয়ার হসপিটালে ড্রোন নিষেধাজ্ঞা

জনশৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে গতকাল থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত রাজধানীর এভারকেয়ার হসপিটাল এবং সংলগ্ন এলাকায় যেকোনো ধরনের ড্রোন ওড়ানো নিষিদ্ধ করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। এর আগে গত ১৮ ডিসেম্বর থেকে আগামী ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিমানবন্দর এলাকায় ড্রোন উড্ডয়ন নিষিদ্ধ করেছে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ।

সিলেট বিমানবন্দরে ভিড় না করার নির্দেশ

লন্ডন থেকে ঢাকাগামী তারেক রহমানকে বহনকারী বিমানটি সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাত্রাবিরতি করবে। এ সময় সেখানে ভিড় না করার নির্দেশ দিয়েছে বিএনপি। দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, সিলেট জেলার কোনো নেতাকর্মী যেন বিমানবন্দরে উপস্থিত না হন। ঢাকায় পৌঁছানোর পর আয়োজিত অনুষ্ঠানে তারেক রহমান দেশবাসীর উদ্দেশে বক্তব্য দেবেন।

তারেক রহমানকে সংবর্ধনা দিতে রাজধানীর ৩০০ ফিট সড়কে বিশাল মঞ্চ নির্মাণ করেছে বিএনপি। বিশ্বরোড থেকে পূর্বাচলমুখী সড়কের একটি অংশজুড়ে নির্মিত মঞ্চটি ৪৮ ফুট দীর্ঘ, ৩৬ ফুট প্রশস্ত এবং সড়ক থেকে আট ফুট উঁচু। এ উপলক্ষে বিমানবন্দর থেকে আবদুল্লাহপুর, বনানী, মহাখালী, যমুনা ফিউচার পার্ক হয়ে কাঞ্চন ব্রিজ পর্যন্ত প্রায় ৯০০ মাইক স্থাপন করা হচ্ছে। পুরো এলাকা সিসি ক্যামেরার আওতায় থাকবে।

সমাবেশস্থলে নেতাকর্মীদের ঢল

গত সোমবার মঞ্চ নির্মাণ শুরু হওয়ার পর থেকেই সমাবেশস্থলে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা বিএনপি নেতাকর্মীদের ভিড় বাড়ছে। কেউ ফেসবুক লাইভ করছেন, কেউ স্লোগানে মুখর করে তুলছেন এলাকা।

গাজীপুর জেলা যুবদলের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য এমএ রাজ্জাক চৌধুরী বলেন, ১৭ বছর পর আমাদের নেতা দেশে ফিরছেন, এটা আমাদের জন্য আনন্দের।

রাঙামাটির বাঘাইছড়ি পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক রহমত উল্লাহ খাজা বলেন, দীর্ঘদিন বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তাকে দেশে ফিরতে দেওয়া হয়নি। আজ সে বাধা ভেঙে তিনি ফিরছেন।

এদিকে, কুড়িল থেকে মঞ্চ এলাকা পর্যন্ত রাস্তার দুপাশে তারেক রহমানকে স্বাগত জানিয়ে ব্যানার-ফেস্টুন টাঙানো হয়েছে। মঞ্চের দুপাশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য বিশেষ তাঁবু স্থাপন করা হয়েছে।

যে কারণে লন্ডনে তারেক রহমান

এক-এগারোর জরুরি সরকারের সময় ২০০৭ সালের ৭ মার্চ তারেক রহমানকে গ্রেপ্তার করার পর রিমান্ডে নিয়ে অমানবিক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। ভয়াবহ ওই নির্যাতনের ফলে তার ‍শারীরিক অবস্থা অত্যন্ত নাজুক হয়ে পড়েছিল। তখন হুইলচেয়ার ও স্ট্রেচারই ছিল চলাফেরার উপকরণ। প্রিজন সেলের টয়লেটে পড়ে গিয়ে তখন মাথায়ও প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছিলেন।

এরপর ২০০৮ সালে চিকিৎসার জন্য লন্ডন যান। সেখানে বিভিন্ন হাসপাতালে তাকে দীর্ঘদিন চিকিৎসা করাতে হয়েছে। মেরুদণ্ডে একাধিক অস্ত্রোপচারের পাশাপাশি তাকে দীর্ঘমেয়াদি থেরাপি দিতে হয়েছে। লন্ডনে পৌঁছার পরই তিনি বিশেষায়িত ফিজিওথেরাপি এবং নিউরোলজিক্যাল চিকিৎসা নেন। এতে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন তিনি।

প্রায় ১৭ বছর লন্ডনে প্রবাস জীবন কাটিয়ে ব্রিটিশ গণতন্ত্র, গণমাধ্যম এবং সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে গভীর অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন তারেক রহমান। তার বিভিন্ন সভা ও সাক্ষাৎকারে এ অভিজ্ঞতা প্রতিফলিত হয়েছে। লন্ডনে অবস্থানকালে ব্রিটিশ সংবাদপত্র ও সংবাদমাধ্যমের কার্যক্রম নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন তিনি।

Google News Icon

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন