আকাশচুম্বী স্বপ্নসহ উচ্চশিক্ষা নিতে এসেছিলেন মিজানুর রহমান পলাশ। ভর্তি হয়েছিলেন দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (হাবিপ্রবি) ফুড অ্যান্ড প্রসেসিং ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে। সে স্বপ্ন আর বাস্তবায়ন হয়নি, ২০২২ সালের ১৯ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন ব্লু-মুন ছাত্রাবাস থেকে তার ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার হয়।
২০১৮ শিক্ষাবর্ষের মেধাবী এই শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছিলেন বলে পুলিশ দাবি করার পর নানান প্রশ্ন ওঠে। হত্যার পর লাশ ঝুলিয়ে রাখার দাবি করে পরিবার। অন্যদিকে ঘটনাটিকে আত্মহত্যা প্রমাণে উঠেপড়ে লাগে হাবিপ্রবি প্রশাসন ও বিভিন্ন সংস্থা।
পলাশের লাশ উদ্ধারের পর প্রাথমিক প্রতিবেদনে সেটিকে আত্মহত্যা বলে লিপিবব্ধ করে পুলিশ। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও একই ভাষায় কথা বলে। কিন্তু ঘটনার পর থেকেই নিহতের পরিবারের সদস্যরা বলছেন, সেটি ছিল পরিকল্পিত হত্যা। খুনের পর লাশ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল বলে তাদের দাবি। পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় মামলা করতে গেলেও সেটি গ্রহণে গড়িমসি করে দিনাজপুর কোতোয়ালি থানা পুলিশ। এছাড়া মামলা না করার জন্য স্থানীয় সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে একাধিকবার তাদের হুমকিও দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, মামলার এজাহার না লেখার জন্য থানার আশপাশের সব কম্পিউটারের দোকান মালিকদের নির্দেশ দেন তৎকালীন ওসি মোজাফফর হোসেন। পরে দিনাজপুর আদালতে মামলা করেন নিহতের মা হাছিনা পারভীন।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, হাবিপ্রবিসংলগ্ন ব্লু-মুন ছাত্রাবাসের মালিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা রেজাউল ইসলামকে এক নম্বর আসামি করে হত্যা মামলা করেন নিহতের মা। অপর আসামিরা হলেন- বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও নিহতের বন্ধু এবং একই মেসের সদস্য মো. আলিদ, সম্রাট, প্লাবন, দিয়ান, তৌফিক, তানভীর, মিহাদ, সীমান্ত। এছাড়া অজ্ঞাত পরিচয় আরো ১৫-২০ জনকে আসামি করা হয়।
এজাহারে উল্লেখ করা হয়, পলাশের সঙ্গে ল্যাবের কাজ নিয়ে তার বন্ধু আলিদ ও সম্রাটের বিবাদ হয়েছিল। ওই দুজন একাধিকবার হুমকি দিয়েছিল যে, তাদের সঙ্গে কোনো ঝামেলায় না জড়াতে এবং জড়ালে তার পরিণতি ভয়াবহ হবে। ঘটনার দিন পলাশ তার মায়ের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলার সময় এসব জানিয়েছিলেন।
এরপর পলাশ তার বান্ধবী আমেনা খাতুনের (আন্নী) সঙ্গে রাত সাড়ে ১০টার দিকে মোবাইল ফোনে কথা বলেন। ওই সময় পলাশের ঘর থেকে অস্বাভাবিক শব্দ শুনতে পাওয়া যায় ফোনের অপর প্রান্তে। মনে হচ্ছিল ওই সময় কক্ষটিতে অনেক লোক একসঙ্গে প্রবেশ করছিল। তখন ফোনের সংযোগটিও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এরপর একাধিকবার কল দিলেও অপর প্রান্ত থেকে বারবার লাইনটি কেটে দেওয়া হয়। এ খবর তার বান্ধবী কিছুক্ষণের মধ্যেই পলাশের মাকে জানালে তারাও ফোনে একাধিকবার কল দেন কিন্তু রিসিভ করা হয়নি।
একই রাত ১২টায় গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কর্মকর্তা পরিচয়ে একজন ফোন করে পরিবারের সদস্যদের দ্রুত দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যেতে বলেন। সেখানে গিয়ে পলাশের লাশ পাওয়া যায়। ওই সময় তাদের বলা হয়, পলাশ আত্মহত্যা করেছেন।
নিহতের মামা নূরে আলম সিদ্দিকী বলেন, শুরুতে পুলিশ সুরতহাল রিপোর্টে সত্য আড়ালের চেষ্টা করে। পুলিশ পা মাটিতে লাগানো এবং হাত বাঁধা থাকার বিষয়গুলো লিখতে অস্বীকৃতি জানায়। এতে পুলিশের সঙ্গে পরিবারের সদস্যদের বাগ্বিতণ্ডা শুরু হয়। পরে পুলিশ সুরতহাল রিপোর্টে বিষয়গুলো যুক্ত করে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, পলাশ তার বিভাগের সেরা ছাত্র ছিলেন। তাকে একটি গবেষণা কর্মসূচির প্রধান করা হয়েছিল। বিষয়টি ভালোভাবে নেননি তার সহপাঠী আলিদ ও সম্রাট। তারা ঈর্ষা করতে থাকেন। এমনকি তারা বিষয়টি নিয়ে ল্যাবের শিক্ষক অধ্যাপক ড. কামরুল হাসানের সঙ্গেও বিতণ্ডায় জড়ান। একপর্যায়ে দুই সহপাঠী পলাশকে উত্তম শিক্ষা দেওয়ার হুমকিও দেন। এরই জেরে তারা পলাশকে হত্যার পরিকল্পনা করেন।
এ বিষয়ে অধ্যাপক কামরুলের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি কোনো মন্তব্য করতে রাজি নই। আসামিরা আমার ছাত্র, যে মারা গেছে সেও আমার ছাত্র। উভয়ের প্রতি আমার সহমর্মিতা আছে।’ একপর্যায়ে তার সঙ্গে পলাশের কাজ করার তথ্য স্বীকার করে প্রতিবেদনটি প্রকাশ না করার অনুরোধ জানান এই শিক্ষক।
পলাশের লাশ উদ্ধার হওয়ার পর তার সনদ তোলার জন্য পরিবারের সদস্যরা বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলে হাবিপ্রবি প্রশাসন তার ভর্তি বাতিল করে সার্টিফিকেট তুলতে বলে। এতে আপত্তি জানিয়ে উচ্চবাচ্চ করলে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সনদ ফেরত দেওয়া হয়।
মামলার অন্যতম আসামি সম্রাট ছাত্রলীগের (বর্তমানে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ) সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মাসুদ রানা মিঠুর অনুসারী ছিলেন তিনি। তার বিরুদ্ধে সিট বাণিজ্য, হল দখল, মাদক কারবার, প্রভাব বিস্তার ও চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগ আছে।
ঘটনার দিন নিহতের সঙ্গে তার পরিবারের ভিডিও কলে কথা হয় রাত ৮টায়। পরে পরিবারের কাছে পলাশের এক বন্ধু ফোন করেন রাত ১০টায়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে রাত ১২টায়। তবে স্থানীয় কয়েক ব্যক্তি বলেন, তারা রাত ৯টার কিছু পর মেসে শোরগোল টের পান এবং সে সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কয়েক শিক্ষক-কর্মকর্তাকেও তারা সেখানে দেখেন।
পলাশের লাশ উদ্ধারের মুহূর্তের কয়েকটি ছবি আমার দেশ-এর কাছে সংরক্ষিত আছে। সেগুলোয় দেখা যায়, নিহতের দেহটি ঝুলন্ত অবস্থায় থাকলেও পা মাটিতে লেগে ছিল। এক হাত টেবিলের ওপর কম্পিউটারের ক্যাবল দিয়ে বাঁধা ছিল। এছাড়া গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করা ব্যক্তিকে সাধারণত জিহ্বায় কামড় দেওয়া অবস্থায় দেখা যায় কিন্তু পলাশের ক্ষেত্রে এমন কোনো আলামত মেলেনি। তাছাড়া পলাশের পাঁজর এবং পিঠে আঘাতের চিহ্ন ছিল, সেখানে রক্তও জমাট বেঁধেছিল। নিহতের বাম হাতের কনুই স্থানচ্যুত অবস্থায় দেখা যায়।
নিহতের পরিবারের সদস্যরা বলেন, ব্লু-মুন ছাত্রাবাসের যে কক্ষে পলাশ ছিল, সেখান থেকে দরজা ভেঙে লাশটি উদ্ধার করার কথা সহপাঠীরা তার মা ও বোনকে জানালেও ঘটনাস্থলে গিয়ে এমন কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। একই সঙ্গে সিসিটিভির ফুটেজ নিয়ে বিড়ম্বনা দেখা দেয়। পরিবারের পক্ষ থেকে বাড়ির মালিক রেজাউলের কাছে ফুটেজ চাইলে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি পুলিশ প্রশাসনকে দেখিয়ে দেন। তবে পুলিশের আলামত জব্দ তালিকায় সিসিটিভি ফুটেজের কথা উল্লেখ নেই।
ঘটনার মাসখানেক পর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জাবীর নূরকে পার্শ্ববর্তী মোহনপুর রাবার ড্যাম এলাকা থেকে বস্তাবন্দি অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। তিনি পলাশের পরিবারকে ঘটনার বিষয়ে কিছু তথ্য দিতে চেয়েছিলেন। এর পরই তার ওই পরিণতি হয়। পরে তিনি আর কখনো পলাশের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি।
এ বিষয়ে জানতে জাবীর নূরের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘আমার পরিবারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কথা বলা নিষেধ আছে।’ এর পর লাইনটি কেটে দেন। এছাড়া পলাশের একাধিক সহপাঠীর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা এ বিষয়ে মুখ খুলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
পলাশের প্রেমিকা আমেনা খাতুনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে সাংবাদিক পরিচয় পেয়েই লাইনটি কেটে দেন। পরে একাধিকবার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।
এদিকে তৎকালীন একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা চাকরি হারানোর ভয়ে নাম প্রকাশ না করে পলাশের পরিবারকে বলেছেন, তাদের হাত-পা বাঁধা। উপর মহলের চাপের কারণে সঠিক তদন্ত করা সম্ভব হচ্ছে না।
এ ব্যাপারে বাড়ির মালিক রেজাউল বলেন, ‘আমাকে তৎকালীন প্রক্টর সবকিছু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মাধ্যমে হস্তান্তর করতে বলেন। আমি সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে হস্তান্তর করেছিলাম।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রক্টর অধ্যাপক ড. মামুনুর রশিদ বলেন, ‘আমরা যথারীতি পুলিশের কাছে সিসিটিভি ফুটেজ দিয়েছি।’
মামলার অন্যতম আসামি সম্রাট বলেন, ‘আমাদের হয়রানি করতেই এ ধরনের মামলা করা হয়েছে। এখানে রঙ মিশিয়ে এগুলো প্রচার করা হচ্ছে। আমরা এগুলো থেকে মুক্তি চাই। আমি কোনো ধরনের হত্যার হুমকি দিইনি। বরং পলাশের থেকে আমি ল্যাবের অনেক কাজ শিখেছি।’
পলাশের অপর বন্ধু মাসুদ বলেন, ‘আমি পলাশকে চিনি না।’ একই সঙ্গে তিনি প্রতিবেদককে পাল্টা প্রশ্নে তার ফোন নম্বর কীভাবে পাওয়া গেছে, তা জানতে চান। এরপর লাইনটি কেটে দেন।
নিহতের মা হাছিনা পারভীন বলেন, ‘আমার ছেলেকে হত্যা করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। আমি এ হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও জড়িতদের বিচার চাই।’
তিনি আরো বলেন, ঘটনার রাত থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় ও পুলিশ প্রশাসন দ্রুত লাশ দাফনের জন্য চাপ দিতে থাকে। এমনকি ক্যাম্পাসেও জানাজা করতে দেয়নি। এছাড়া অন্য সব আলামতে এটা যে হত্যাকাণ্ড, তা প্রমাণ হয়েছে।
মামলার সর্বশেষ অগ্রগতি নিয়ে সিআইডির তদন্তকারী কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান বলেন, তদন্ত চলমান। শিগগির প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।


হাবিপ্রবিসাসের অফিস ভাঙচুরের বিচার দাবিতে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম