আমার দেশ-এ প্রতিবেদন

কোরবানি বন্ধের নির্দেশদাতা শাবাব আহমেদকে ঢাকায় তলব

বশীর আহমেদ
প্রকাশ : ২৩ মে ২০২৫, ০৯: ০১
শাবাব আহমেদ

বিজেপির হিন্দুত্ববাদী বয়ান তুলে ধরে কলকাতায় বাংলাদেশ মিশনে কোরবানি বন্ধের নির্দেশদাতা সেই বিতর্কিত কূটনীতিক শাবাব বিন আহমেদের কলকাতা মিশন প্রধান (ডেপুটি হাইকমিশনার) হিসেবে দেওয়া বদলি আদেশ বাতিল করে তাকে অবিলম্বে ঢাকায় ফেরার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ নীতিনির্ধারকদের সিদ্ধান্তে প্রশাসন অনুবিভাগ থেকে জারি করা এক অফিস আদেশে এই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আমার দেশকে জানিয়েছেন।

এর আগে শাবাব বিন আহমেদের কোরবানি বন্ধের নির্দেশ নিয়ে গত ১৯ মে দৈনিক আমার দেশ-এ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পর সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে বিভিন্ন মহলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। অবশেষে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই বিতর্কিত কূটনীতিকের বিরুদ্ধে শক্ত পদক্ষেপ নিল।

শাবাব বিন আহমেদ কলকাতা মিশনে কোরবানি বন্ধের নির্দেশের পক্ষে তার হিন্দুত্ববাদী বয়ান তুলে ধরে আমার দেশকে বলেছিলেন, হোস্ট কান্ট্রির (ভারত) আস্থা অর্জন জরুরি। তাদের রীতিনীতির প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে। আমরা কোরবানিতে যেটা জবাই করি, তারা সেটাকে পূজা করেÑ বিষয়টি আমাদের মাথায় রাখতে হবে।

গতকাল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন অনুবিভাগের পরিচালক নওরিদ শারমিন স্বাক্ষরিত অফিস আদেশে বর্তমানে হেগে কর্মরত শাবাব বিন আহমেদকে ঢাকায় ফেরার নির্দেশ দিয়ে বলা হয়- বাংলাদেশ দূতাবাস, দ্য হেগ-এ আপনার বর্তমান দায়িত্বভার ত্যাগ করে অনতিবিলম্বে সদর দপ্তর ঢাকায় প্রত্যর্পণের জন্য অনুরোধ করা যাচ্ছে। আদেশে আরো বলা হয়, গত ২১ নভেম্বর ২০২৪ তারিখে আপনার অনুকূলে জারিকৃত বাংলাদেশ উপ-হাইকমিশন, কলকাতায় উপ-হাইকমিশনার পদে আপনার বদলির আদেশ বাতিল করা হলো।

এ ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন সিনিয়র কূটনীতিক আমার দেশকে বলেন, আমরা বিষয়টি সিরিয়াসলি নিয়েছি। শাবাবের ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তাকে জবাবদিহির মুখোমুখি হতে হবে। তিনি আরো জানান, ইতোমধ্যে কলকাতা মিশনে কোরবানি অব্যাহত রাখার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

উল্লেখ্য, কলকাতায় বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনে ঐতিহ্যগতভাবে চলে আসা কোরবানি দেওয়ার প্রথা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিলেন শাবাব বিন আহমেদ। কলকাতা মিশনে যোগদানের আগেই কোরবানি বন্ধের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেন তিনি। তার এই পদক্ষেপে কলকাতা মিশনে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া এই পদক্ষেপ কার্যকর হলে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতি হওয়ার পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গে এটা একটি রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হতে পারে বলে আশঙ্কা ছিল কূটনীতিকদের।

ভারতে দায়িত্ব পালন করেছেন এমন একজন কূটনীতিক এই ধরনের পদক্ষেপের ব্যাপারে আমার দেশকে বলেছিলেন, কলকাতার নতুন মিশনপ্রধান এখনো যোগ দেননি। তার আগেই তিনি এ ধরনের স্পর্শকাতর ইস্যুতে পদক্ষেপ নিচ্ছেন, যা রীতিমতো বিস্ময়কর। তার বক্তব্য আর আরএসএসের বক্তব্যের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। দেশের জন্য এটা বড় ধরনের বিপদ ডেকে আনতে পারে।

তিনি বলেন, কলকাতা মিশনে কোরবানির রেওয়াজ দীর্ঘদিনের। ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে কলকাতা মিশনে কোরবানি হয়ে আসছে। প্রতি বছরই পাঁচ থেকে সাতটি গরু এবং ছাগল কোরবানি করা হয়। এই কোরবানির গোশতের একটি বড় অংশ বিভিন্ন এতিমখানায় পাঠানো হয়। তাছাড়া মিশনের চারপাশে বসবাসকারী মানুষের প্রায় ৯০ ভাগই মুসলিম। এই মুসলিমরাও প্রতি বছর বাংলাদেশ মিশন থেকে গোশত পেয়ে থাকে। এভাবেই আমাদের কলকাতা মিশনের কোরবানি ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে।

কলকাতা মিশনের কোরবানির বিষয়টি ধর্মীয় ঐতিহ্যের পাশাপাশি এর একটি সামাজিক এবং রাজনৈতিক তাৎপর্য রয়েছে বলে মন্তব্য করে ওই কূটনীতিক বলেন, কলকাতা মিশনের কোরবানিকে বিগত এবং বর্তমান মমতা সরকার ইতিবাচক হিসেবে দেখে। তারা এটাকে উদাহরণ হিসেবে দেখাতে চায়, পশ্চিমবঙ্গে সব ধর্মের মানুষের সমান ধর্মীয় স্বাধীনতা রয়েছে। আগামী বছর পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন। তাই কলকাতা মিশনে কোরবানি বন্ধ হলে এটা একটি রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হবে। বিজেপি-আরএসএস এটাকে তাদের পক্ষে ব্যবহারের চেষ্টা করবে। মমতা সরকার এটাকে মোটেই ভালোভাবে নেবে না। তাই ইস্যুটি বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।

কলকাতার নতুন মিশনপ্রধানের কোরবানির বিষয়ে নেওয়া পদক্ষেপ সম্পর্কে কলকাতা মিশনে কর্মরত একাধিক কর্মকর্তা আমার দেশকে বলেন, নতুন মিশনপ্রধান এখন হেগে মিনিস্টার (রাজনৈতিক) হিসেবে কর্মরত আছেন। আগামী জুন মাসের মধ্যে তার দায়িত্ব নেওয়ার কথা। কিন্তু তিনি দায়িত্ব নেওয়ার আগেই কয়েক মাস ধরে মিশনে কোরবানি বন্ধের ব্যাপারে তৎপর হন। তিনি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কোরবানি বন্ধের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেন। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা তাকে মিশনের কোরবানির বিষয়টি নিয়ে এর স্পর্শকাতরতার কথা বারবার তুলে ধরে এ ধরনের পদক্ষেপ নিতে অপারগতা জানান। কিন্তু তিনি কোনো কিছুতেই কর্ণপাত করেননি। একপর্যায়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা নতুন মিশনপ্রধানকে জানান, আপনি দায়িত্ব গ্রহণের পর আপনার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবেন। আমাদের পক্ষে কোরবানি বন্ধ করা সম্ভব নয়।

নতুন মিশনপ্রধানকে প্রয়োজনে কোরবানির শেষে দায়িত্ব নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়। কিন্তু তিনি সেই অনুরোধ ‍উপেক্ষা করে মিশনের কর্মকর্তাদের গত সপ্তাহে সাফ জানিয়ে দেন, তিনি আগামী ২ জুন দায়িত্ব নেবেন এবং কোরবানির সব ধরনের প্রস্তুতি বন্ধ করতে বলেন। কলকাতা মিশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, নতুন মিশনপ্রধানের এই সিদ্ধান্তে মিশনের ভেতরে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। তার এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে কেউই একমত নন। এ ছাড়া বিষয়টি এখন মিশনের বাইরেও জানাজানি হয়েছে। কলকাতার অনেক সাংবাদিক এবং বুদ্ধিজীবী ফোন করছেন। তারা সবাই হিন্দু সম্প্রদায়ের। তারা বলছেন, বাংলাদেশ যেন কোনোভাবেই কোরবানি বন্ধের সিদ্ধান্ত না নেয়। কারণ এর একটি সুদূরপ্রসারি প্রভাব পড়বে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে।

বিষয়টি নিয়ে আমার দেশ-এর পক্ষ থেকে শাবাব বিন আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি তখন বলেন, কলকাতা ছাড়া আর কোনো মিশনে কোরবানি হয় না। আমি এর আগে আরো পাঁচটি মিশনে দায়িত্ব পালন করেছি। কোথাও কোরবানি করা হয় না। আমরা দেশের জন্য কাজ করি। আমরা যেখানে কাজ করব, সেখানকার পরিবেশ পরিস্থিতির কথা আমাদের মাথায় রাখা দরকার।

তিনি বলেন, আমাদের স্বাগতিক দেশের রীতিনীতি মেনে চলা উচিত। কূটনীতিক হিসেবে হোস্ট কান্ট্রির আস্থা অর্জন করা জরুরি। তিনি আরো বলেন, আমাদের কলকাতা মিশনের নিরাপত্তায় ২৫ জনের মতো নিরাপত্তাকর্মী থাকে। তারা তো গরু পূজা করে। একবার ভেবে দেখেছেন, তারা যাকে পূজা করে, যখন আমরা সেটাকে জবাই করি, তাদের মনের অবস্থা কী হয়?

শাবাব বিন আহমেদের এই বক্তব্যে রীতিমতো বিস্ময় তৈরি হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন সিনিয়র কূটনীতিক এ ব্যাপারে আমার দেশকে বলেছিলেন, আমি বিস্মিত। এ ধরনের বক্তব্য তার দেওয়ার কথা নয়। কোরবানি বন্ধ হবে কি নাÑ সেই সিদ্ধান্ত তো হেডকোয়ার্টার অথবা হাইকমিশনারের কাছ থেকে আসতে হবে। ডেপুটি হাইকমিশনার কীভাবে এ ধরনের স্পর্শকাতর ইস্যুতে সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন, যিনি এখনো দায়িত্বই গ্রহণ করেননি। এটি সত্যিই রহস্যজনক? এখানে অন্যকিছু থাকতে পারে। তিনি আরো বলেন, এর আগে এই কূটনীতিক বাংলাদেশের দিল্লি হাইকমিশনে কাজ করেছেন। সে সময় হয়তো তিনি ভারতে ক্ষমতাসীন দল বিজেপির আদর্শে দীক্ষিত হয়েছেন।

বিষয়:

ভারত
এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত