ভোটাররা সরাসরি প্রশ্ন করতে পারবেন প্রার্থীদের

গাজী শাহনেওয়াজ
প্রকাশ : ০৯ নভেম্বর ২০২৫, ০৬: ২১

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রথমবারের মতো ভোটাররা তাদের নির্বাচনি এলাকার প্রার্থীদের সরাসরি প্রশ্ন করতে পারবেন, এমন একটি প্রযুক্তি চালু হচ্ছে। এই উদ্যোগের ফলে প্রার্থী ও ভোটার উভয়ের মধ্যে জবাবদিহিতার নতুন ক্ষেত্র তৈরি হবে।

সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের অধীন বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (বিসিসি) তৈরি করছে নির্বাচনি অ্যাপ ‘ভোটের সাথী’, যা এ যোগাযোগের সমন্বয় করবে। নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) ইতোমধ্যে অ্যাপটির বাস্তবায়নে সহায়তার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস অ্যাপটি নির্বাচনে ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছেন এবং এর জন্য সরকারের কোনো অতিরিক্ত ব্যয় হবে না।

বিজ্ঞাপন

রাজনীতিবিদ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। তাদের মতে, এটি একটি ব্যতিক্রমী পদক্ষেপ, যা নির্বাচনের আগে ও পরে প্রার্থীদের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করবে। ভোটারদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের সুযোগ থাকায় নির্বাচনি অঙ্গীকার বাস্তবায়নের বিষয়েও প্রার্থীরা সচেতন থাকবেন।

আইসিটি বিভাগ জানিয়েছে, এ অ্যাপ ভোটার ও প্রার্থীর মধ্যে প্রযুক্তিভিত্তিক সেতুবন্ধ তৈরি করবে এবং একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনে যোগ্য প্রার্থী বাছাইয়ে সহায়ক হবে।

নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ আমার দেশকে জানান, প্রধান উপদেষ্টার সম্মতিতে আইসিটি বিভাগ অ্যাপটি তৈরি করছে। কিছু তথ্য চেয়ে আপনাদের চিঠি দেওয়া হয়েছে, এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দৈনিক কয়েকশ চিঠি তার দপ্তরে আসে; ওই চিঠিটাও হয়তো এসেছিল।

এ প্রসঙ্গে বিজিডি ই-গভ সার্ট প্রকল্পের ম্যানেজার অপারেশন ও ভোটের অ্যাপ প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) হোসেন বিন আমিন আমার দেশকে বলেন, আমরা নির্বাচনি অ্যাপ তৈরি করছি। অ্যাপটির কার্যকারিতা বৃদ্ধির জন্য কিছু তথ্য চেয়ে কমিশনকে চিঠি দিয়েছি। এখনও জবাব পাইনি। এটি ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে ব্যবহার করা হবে। এর মাধ্যমে ভোটার ও প্রার্থীর মধ্যে তথ্য আদান-প্রদান ও জন-সম্পৃক্ততা তৈরি হবে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান আমার দেশকে বলেন, নির্বাচনি অ্যাপস যারাই তৈরি করুক, ইসি কিংবা আইসিটি বিভাগ দুপক্ষেরই একে-অপরের সহযোগিতা দরকার। এটা সুচিন্তিত ও ভালো উদ্যোগ। আগে রাজনৈতিক দলগুলো কেন্দ্রীয়ভাবে একটা নির্বাচনি মেনিফেস্টো দিয়ে নির্বাচনের সব কার্যক্রম শেষ করত, যা শুধু দলীয় কর্মী ও প্রার্থীর নির্বাচনি প্রচারের মাধ্যমে সীমাবদ্ধ ছিল। ফলে আগে ভোটাররা প্রার্থীদের সম্পর্কে যথাযথ মূল্যায়ন করতে পারত না। ভালো প্রার্থীদেরও সঠিক মূল্যায়ন হতো না। এখন প্রার্থীরা ভোটারদের কথা ভাবছেন কি না ও জনকল্যাণের কথা ভাবছেন কি না, সরাসরি প্রশ্ন করার মাধ্যমে প্রার্থী ও তার অবস্থান সম্পর্কে জানতে পারবেন। এর মাধ্যমে ভোটের পরিস্থিতির তুলনামূলক চিত্র সম্পর্কে অবগত হবেন ভোটাররা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগকে ত্রয়োদশ নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রার্থী ও সাধারণ ভোটারদের তথ্যসম্বলিত অনলাইন সিস্টেম চালুর জন্য প্রথমে মৌখিকভাবে নির্দেশনা দেন প্রধান উপদেষ্টা। নির্দেশনার আলোকে ইলেকশন অ্যাপসের (ভোটের সাথী) অনলাইন সংস্করণ ও মোবাইল অ্যাপসের কাঠামো তৈরি করা হয়। অ্যাপসের ফিচার প্রধান উপদেষ্টাকে দেখালে তা তিনি গ্রহণ করেন।

এর মধ্যে ছয় ধরনের ফিচার থাকবে, সেগুলো হচ্ছেÑ প্রার্থীর সব তথ্য (হলফনামা, আয়কর তথ্য, রাজনৈতিক তথ্য, শিক্ষাগত তথ্য, ইশতেহার) ভোটারের জন্য প্রদর্শন করার ব্যবস্থা থাকবে। একই সঙ্গে ভোটার প্রার্থীকে সরাসরি প্রশ্ন করতে পারবেন। নিজ ভোটকেন্দ্রের তথ্য জানতে পারবেন। প্রার্থী ভোটারদের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন। ভোট চলাকালীন অনিয়মের তথ্য রিপোর্ট করা যাবে। ফ্যাক্ট-চেকিং ও মনিটরিং সংস্থা প্রার্থীর তথ্য যাচাই করতে পারবে। পাশাপাশি ব্যবহারকারীদের জন্য থাকবে পৃথক ড্যাশবোর্ড; সেখানে ভোটের অনিয়ম ও প্রার্থীর কার কী প্রতিশ্রুতি তা সন্নিবেশ করতে পারবে।

এদিকে অ্যাপটি সফলভাবে পরিচালনার জন্য ইসির কাছ থেকে কিছু তথ্য চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছে সংশ্লিষ্ট বিভাগ। এর মূল লক্ষ্য, প্রযুক্তির সিস্টেম প্রস্তুতকরণ ও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নে ইসি ও আইসিটির মধ্যে সহযোগিতা ও সমন্বয় করা। একই সঙ্গে কমিশনের সরবরাহ করা তথ্য-উপাত্তের সুরক্ষা যথাযথভাবে প্রতিপালনে দুটি সংস্থার মধ্যে আস্থার সম্পর্ক স্থাপন করা।

অ্যাপটির জন্য নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে প্রার্থীদের সম্পদ বিবরণী, হলফনামা, আসনভিত্তিক তালিকা, ভোটার তথ্য এবং এনআইডি সংক্রান্ত ডেটা চাওয়া হয়েছে, যা নিরাপদ উপায়ে সংযুক্ত করা হবে।

এর আগে নির্বাচন কমিশনের তৈরি করা অ্যাপটি ঠিকমতো কাজ করেনি বলে অভিযোগে জানা যায়। অ্যাপটি সম্পর্কে ব্যবহারকারীর মতামত ইতিবাচক ছিল না। যার পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান উপদেষ্টার পরামর্শক্রমে আইসিটি বিভাগ ভোটার ও প্রার্থীর মধ্যে জবাবদিহিতা নিশ্চিতে অ্যাপটি প্রণয়নে সহায়তা করছে। প্রাপ্ত তথ্যমতে, অ্যাপসটির পরীক্ষামূলক যাচাই-বাছাই শেষে আইসিটি বিভাগ মেধাস্বত্ব, সোর্সকোড প্রভৃতি ইসিকে হস্তান্তর করবে। তবে কারিগরি সহায়তা দেবে আইসিটি বিভাগ।

নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. আব্দুল আলীম আমার দেশকে বলেন, এ অ্যাপ ডিজিটাল যুগে প্রার্থী ও ভোটারের সরাসরি সংযোগ বাড়াবে। এতে মাঠপর্যায়ে সংঘাত কমবে এবং ভোটাররা ঘরে বসেই প্রার্থীদের সম্পর্কে জানতে পারবেন। প্রয়োজনে প্রশ্ন করেও নিজের সংশয় দূর করা যাবে। নির্বাচনের পরও অ্যাপটি চালু থাকলে জনসেবার ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে।

এদিকে, নির্বাচন কমিশনের ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে, আইসিটি বিভাগের পাঠানো চিঠির পর কমিশনের সিনিয়র সচিবের কাছে এ বিষয়ে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করা হচ্ছে। সেখানে তথ্য সরবরাহে কিছু বাস্তব সমস্যা তুলে ধরা হয়েছে।

বলা হয়েছে, ইসি সচিবালয়ের ডাটাগুলো অত্যন্ত সংবেদনশীল। তাই শুধুমাত্র নিজস্ব কর্মকর্তারাই হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার ও নেটওয়ার্ক ব্যবহারের অনুমতি পান। নিরাপত্তার কারণে কোনো বাইরের প্রতিষ্ঠান বা ভেন্ডরকে এসব অ্যাক্সেস দেওয়া ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। বিশেষ করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার অনুপস্থিতিতে ভালনারেবিলিটি অ্যাসেসমেন্ট অ্যান্ড পেনিট্রেশন টেস্টিং (ভিএপিটি) পরিচালনা করলে তা নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়াতে পারে।

প্রস্তাবে বলা হয়েছে, প্রয়োজনে অ্যানিকানেক্ট সফটওয়্যার ব্যবহার করে ভিপিএনের মাধ্যমে সীমিত সময়ের জন্য অ্যাকসেস দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। তবে এতে ইউজার পাসওয়ার্ড দিয়ে যে কেউ যে কোনো স্থান থেকে সার্ভারে প্রবেশ করতে পারবে, ফলে বিস্তারিত লগইন রেকর্ড পাওয়া যাবে না।

আরো উল্লেখ করা হয়, মাঠপর্যায়ের কার্যালয়ে সর্বদা গ্রামীণফোন ও টেলিটকের ভিপিএন ব্যবহৃত হচ্ছে। এ ভিপিএনে বিটিসিএল ব্যবহার করা নিরাপদ এবং থ্রিএমবিপিএস পর্যন্ত ব্যান্ডউইথ পাওয়া যায়। তাই নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার অনুপস্থিতিতে ভিপিএনের মাধ্যমে হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার ও নেটওয়ার্কের একসেস দেওয়া হবে কি না সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রয়োজন।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত