চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) কাউন্সিলর ছিলেন জাবেদ নজরুল ইসলাম। এর চেয়েও বড় পরিচয় তিনি মহানগর আওয়ামী লীগের সদস্য ও ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের সভাপতি। জুলাই বিপ্লবের সময় দলীয় দায়িত্ব পালন করেছেন অক্ষরে অক্ষরে। তিনি নিজে সরাসরি হামলায় অংশ নেওয়ার পাশাপাশি পলাতক মন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ও সাবেক মেয়র আ জ ম নাছিরের নির্দেশে তার সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে চালিয়েছেন হত্যাযজ্ঞ। এ অভিযোগে তার নামে হত্যা মামলাও হয়। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তিনি পালিয়ে যান। তবে ধরে রেখেছেন চসিকের অবৈধ ঠিকাদারি।
আওয়ামী লীগ নেতা জাবেদ কাউন্সিলরের দায়িত্ব পালনকালে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে নেন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ঠিকাদারি। তার প্রতিষ্ঠান পাওয়ার জাবেদ সোর্সের সঙ্গে চুক্তিটি করেছিলেন তৎকালীন মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম চৌধুরী। জাবেদ পালিয়ে যাওয়ার পর তার কার্যক্রমও বন্ধ হয়ে যায়। প্রকল্পটি চালিয়ে নিতে গত ২৩ মার্চ চুক্তিটি বাতিল করেন বর্তমান মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন। এ আদেশের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিট করলে তা স্থগিত করে হাইকোর্ট। এতে ঝুলে আছে অন্তত পাঁচটি ওয়ার্ডের ‘ডোর টু ডোর’ ময়লা ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের কার্যক্রম।
অভিযোগ উঠেছে, কাজ না করেও মাঝেমধ্যে ভুয়া ভাউচারে বিল উত্তোলন করছেন আওয়ামী লীগ নেতা জাবেদের ছেলে। শুধু তাই নয়, ইতোমধ্যে উচ্চ আদালতে রিট করে চসিকের পাঁচটি ওয়ার্ডে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত ডোর টু ডোর প্রকল্পের কাজ শুরু করা যাচ্ছে না। কেবল ডাস্টবিনে ফেলা ময়লা দুয়েকদিন পরপর সংগ্রহ করছেন পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা।
চসিক সূত্রে জানা গেছে, চুক্তিটি বাতিলের পরদিন গত ২৪ মার্চ নতুন নীতিমালার মাধ্যমে চালু হওয়া ডোর টু ডোর প্রকল্পের জন্য নতুন প্রতিষ্ঠানের আবেদন চেয়ে স্থানীয় একটি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয় চসিক। এর পরপর ৯ এপ্রিল উচ্চ আদালতে রিট করেন জাবেদ। এতে ছয় মাসের জন্য চসিকের কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা দেয় হাইকোর্ট।
চসিক কর্মকর্তারা জানান, জুলাই হত্যা মামলার আসামি হয়েও প্রভাব ধরে রেখেছেন জাবেদ। তাছাড়া তার বিরুদ্ধে চুক্তির শর্ত ভঙ্গেরও অভিযোগ আছে। তিনি রিটে চেয়েছেন মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত অর্থাৎ পাঁচ বছর পর্যন্ত ময়লা সংগ্রহের দায়িত্বে থাকতে।
তারা আরো জানান, বর্তমানে ওয়ার্ডগুলোয় জাবেদের প্রতিষ্ঠান পাওয়ার জাবেদ সোর্স কোনো কাজ না করলেও বিল তোলা হচ্ছে। মূলত তিনি পলাতক থাকলেও ছেলেকে দিয়ে কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। জনবল সংকট থাকায় ঠিকমতো ময়লাও সংগ্রহ করতে পারছে না চসিক। তারা একদিকে নালা-নর্দমা, রাস্তাঘাট পরিষ্কার করছে, অন্যদিকে ময়লা সংগ্রহ করছে। বিশাল এলাকা হওয়ায় চসিকের পরিচ্ছন্ন বিভাগ রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে। পাঁচটি ওয়ার্ডে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানকে ঠিক করে রাখলেও তাদের কাজের আদেশ দিতে পারছে না চসিক।
কী আছে জাবেদের চুক্তিতে
জানা যায়, ২০২২ সালের ২৭ এপ্রিল চসিকের সাবেক মেয়র রেজাউল পাওয়ার জাবেদের সোর্সের সঙ্গে চুক্তি করেন ২৪ নম্বর উত্তর আগ্রাবাদ ওয়ার্ডে ডোর টু ডোর প্রকল্পের জন্য আর গত বছরের ৭ মে আরো চারটি ওয়ার্ডের জন্য চুক্তি করেন। ওয়ার্ডগুলো হলোÑনগরের ৫ নম্বর মোহরা, ১১ নম্বর দক্ষিণ কাট্টলী, ১২ নম্বর সরাইপাড়া, ২৬ নম্বর উত্তর হালিশহর। ২০২১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর জাবেদ আবেদন করেন এ কাজ পেতে। এরপর যাচাই-বাছাই ছাড়া সক্ষমতা, অভিজ্ঞতা না থাকলেও তার প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেন তৎকালীন মেয়র রেজাউল।
চুক্তিতে বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানটি সব ধরনের প্রতিষ্ঠান থেকে ময়লা সংগ্রহ করতে পারবে। এতে ১০০ থেকে ১০ হাজার টাকা এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে ২০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করতে পারবে প্রতিষ্ঠানটি।
তবে শর্ত দেওয়া হয়েছে, প্রতিষ্ঠানটি তরল, কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্যকে আলাদা করে প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে এসটিএস বা কম্পোস্টিং বা গ্রহণযোগ্য উপায়ে পুনর্ব্যবহারের চূড়ান্ত যোগ্য করবে। এছাড়া বর্জ্য অনুসারে বিভিন্ন রঙের প্রকোষ্ঠ স্থাপন, ডাস্টবিন স্থাপন ও সেকেন্ডারি স্টেশন চিহ্নিতের ব্যবস্থা করবে। চুক্তিটি ২০২৯ সালের ৬ মে পর্যন্ত বলবৎ থাকবে এবং প্রয়োজনে পাওয়ার সোর্স তার চুক্তিভুক্ত এলাকা বড় করতে পারবে বলে জানানো হয়।
তবে অভিযোগ আছে, কাউন্সিলর হওয়ায় আইনের তোয়াক্কা করেননি জাবেদ। উল্টো মানুষের কাছ থেকে ইচ্ছামতো টাকা আদায়, দুর্ব্যবহারের অভিযোগ ছিল পাওয়ার সোর্সের বিরুদ্ধে।
যা বলছে চসিক
সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এক বছরের মধ্যে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় জৈব ও অজৈব বর্জ্য থেকে পুনঃব্যবহারযোগ্য ও পুনঃপ্রক্রিয়াজাতযোগ্য পণ্য পৃথকীকরণের জন্য প্ল্যান্ট স্থাপন করতে হবে, যা করা হয়নি। তিনটি আলাদা ভাগে বর্জ্য পরিবহন করার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। ভিন্ন রঙের বিন বা প্রকোষ্ঠ দেওয়া হয়নি। এতে মারাত্মকভাবে পরিবেশদূষণ হচ্ছে। তাছাড়াও কোনো ধরনের নীতিমালা ঠিক না করে ওই সেবাটি চালু করেছিল তৎকালীন চসিক প্রশাসন।
মেয়র ডা. শাহাদাত আমার দেশকে বলেন, ‘পলাতক কাউন্সিলর জাবেদের রিটের কারণে পাঁচটি ওয়ার্ডে ডোর টু ডোর প্রকল্পের কাজ করা যাচ্ছে না। শিগগির আইনি প্রক্রিয়া শেষ করে আমরা কাজ শুরু করব।’

