কটিয়াদীতে ৫০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী ঢাকের হাট

উপজেলা প্রতিনিধি, কটিয়াদী (কিশোরগঞ্জ)
প্রকাশ : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৫: ২৩

কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীতে পাঁচ শ’ বছরের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী ঢাকের হাট শনিবার থেকে শুরু হয়েছে। পৌর এলাকায় প্রেসক্লাব সংলগ্ন পুরাতন বাজারে প্রতিবছর পূজা শুরুর আগের দু’দিন এই হাট বসে।

চারদিকে ঢাক ঢোল, কাঁসর, সানাই, নানা বাঁশি, করতাল ও খঞ্জরির আওয়াজে প্রকম্পিত এলাকা। কারো হাতে ঢোল বাঁশিসহ নানান ধরনের বাদ্যযন্ত্র। বাজারের রাস্তায় বাজনা বাজিয়ে নেচে-গেয়ে পূজারিদের মন আকৃষ্ট করছে ঢাকিরা। শনিবার শুরু হওয়া এই হাট চলবে রবিবার বিকাল পর্যন্ত।

বিজ্ঞাপন

যুগ যুগ ধরে অম্লান হয়ে আছে এই ঢাকের হাটের ঐতিহ্য। দূরদূরান্ত থেকে পূজারীরা এই হাটে আসেন পছন্দের বাদক দলটি বাছাই করে নিয়ে যেতে। তাদের আকৃষ্ট করতে নানান রকম ছন্দে ঢাক ঢোল, বাঁশি বাজিয়ে তাদের মুনশিয়ানা দেখায়। বাজনা পছন্দ হলেই শুরু হয় বায়না করার আলাপ আলোচনা। কোন দলের কত মূল্য হবে, তা নির্ধারিত হয় উপস্থিত পরীক্ষার মাধ্যমে। বাজনার তালে নাচ আর নানা অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে পূজারিদের নজর কাড়ারও চেষ্টা করেন ঢাকিরা। বাজনার শব্দে মুখর হয়ে ওঠে চারপাশ। যাদের সঙ্গে দরদাম মিলছে, তাদের অনুসরণ করে পিছু নেন ঢাকিরা।

শনিবার দুপুরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাজারের রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বাজনা বাজাচ্ছেন তারা। কেউ রিকশা থেকে দলবল নিয়ে সবেমাত্র নামছেন৷ কেউ আগের রাতেই এসেছেন। কেউ চুক্তি হয়ে চলে যাচ্ছেন। অনেক দল বায়না না হওয়া পর্যন্ত হাটে অবস্থান করবেন। স্থানীয়সহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অনেক পূজারিরা এসেছেন পছন্দের বাদক দলটি নিতে। ৩০-৪০ হাজার এবং সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকায় চুক্তি হয়ে অনেক দল চলে গেছে।

জনশ্রুতি আছে, ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে স্থানীয় সামন্ত রাজা নবরঙ্গ রায় তার রাজপ্রাসাদে দুর্গাপূজার আয়োজন করতেন। কটিয়াদীর চারিপাড়া গ্রামে ছিল রাজার প্রাসাদ। একবার রাজা নবরঙ্গ রায় সেরা ঢাকিদের সন্ধান করতে ঢাকার বিক্রমপুর পরগনার (বর্তমানে মুন্সিগঞ্জ) বিভিন্ন স্থানে আমন্ত্রণ জানিয়ে বার্তা পাঠান। সে সময় নৌপথে অসংখ্য ঢাকি দল পুরোনো ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে যাত্রাঘাটে সমবেত হন। রাজা নিজে দাঁড়িয়ে একে একে বাজনা শুনে সেরা দলটি বেছে নেন এবং পুরস্কৃত করেন। সেই থেকেই যাত্রাঘাটে ঢাকের হাটের প্রচলন শুরু। পরবর্তী সময়ে হাট স্থানান্তরিত হয় পুরানবাজারে। এখনো হাট বসে সেখানে।

ঢাকার দোহার নবাবগঞ্জ থেকে আগত সিতল দাস জানান, তার দলে সাত সদস্যের ঢাকি রয়েছে। একাধিক দলে বিভক্ত হয়ে চল্লিশ জন ঢাকি এ হাটে এসেছেন। বায়না মিললে তারা বিভিন্ন পূজা মণ্ডপে যোগ দেবেন।

বিক্রমপুর থেকে আসা মিন্টু দাস বলেন, আমি ১৫ বছর ধরে এই ঢাকির হাটে আসি। আমার দলে ১০ জন সদস্য আছে। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার পূজা বেশি হলেও ঢাকি সংখ্যা কিছুটা কম। আশা করি, দরদাম ঠিক থাকলে বায়না হয়ে যাবে।

কটিয়াদী উপজেলা পূজা উদযাপন কমিটির সদস্য সচিব প্রভাষক ধ্রুব রঞ্জন দাস জানান, এই ঢাকের হাট আমাদের শতবর্ষী ঐতিহ্য। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আগত ঢাকিদের দেখাশোনা ও তদারকি করছি আমরা। তবে এবার ডাকি সংখ্যা কিছুটা কম। এখন অনেকেই প্রযুক্তির যুগে মোবাইল ফোনে বায়না করে থাকেন। হাটে অস্থায়ী মনিটরিং কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে এবং স্থানীয় প্রশাসনের সাথে সমন্বয় করে সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। এলাকাবাসীরাও সহযোগিতা করছেন।

কটিয়াদী মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ মো. তরিকুল ইসলাম বলেন, ঢাকিদের নিরাপত্তার জন্য পুলিশ কাজ করছে। শান্তিপূর্ণ ও আনন্দঘন পরিবেশে হাট চলছে।

কটিয়াদী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. মাঈদুল ইসলাম জানান, কটিয়াদীর ৫০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী ঢাকের হাট আমি পরিদর্শন করেছি। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা মনিটরিং করা হচ্ছে। এ হাটের অবকাঠামোগত উন্নয়নে শিগগিরই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত