আমার দেশ জনপ্রিয় বাংলা নিউজ পেপার

উপজাতি মুসলমানদের জীবন সংগ্রাম

আবু সুফিয়ান

উপজাতি মুসলমানদের জীবন সংগ্রাম
বান্দরবানের রোয়াংছড়িতে মসজিদ নির্মাণ করছেন ধর্মান্তরিত উপজাতি মুসলমানরা। (ইনসেটে) নওমুসলিম ওমর ফারুক। আমার দেশ

বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলার তুলাছড়ি আগা রায়চন্দ্র ত্রিপুরাপাড়ায় ২০২১ সালের ১৮ জুন মোহাম্মদ ওমর ফারুক ত্রিপুরাকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। ইসলাম গ্রহণের আগে তার নাম ছিল বেন্নাচন্দ্র ত্রিপুরা। তিনি তার পরিবারসহ ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। তার অপরাধ ছিল একটাই— তিনি ইসলামের দাওয়াত দিতেন।

এভাবে যারা পার্বত্য চট্টগ্রামে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলমান হন বা ইসলাম প্রচার করেন তাদের ওপর নেমে আসে অকথ্য নির্যাতন। পড়তে হয় সামাজিক বয়কটের মুখে। সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হুমকি তো নিয়মিত ঘটনা। এছাড়া নওমুসলিমদের টার্গেট করে চালানো হয় সহিংস নিপীড়ন। এর মধ্যে উৎকণ্ঠায় দিন পার করছেন পার্বত্য চট্টগ্রামে মুসলিম হওয়া উপজাতিরা।

বিজ্ঞাপন

ওমর ফারুক যেখানে খুন হন সেই পাড়াটি রোয়াংছড়ি সদর থেকে সাত-আট কিলোমিটার দূরে, সড়কবিহীন এক দুর্গম এলাকায়। সেই ঘটনার নেপথ্যের কারণ বর্ণনা দিয়ে নওমুসলিমদের নিয়ে কাজ করা কক্সবাজার ঈদগাহ মডেল হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা ডা. মুহাম্মাদ ইউসুফ আলী আমার দেশকে বলেন, ওমর ফারুক ইসলামের দাওয়াত দিতেন। এজন্য তাকে হত্যা করা হয়। দুর্গম সেই এলাকায় আমরা মসজিদ করেছিলাম, সেখানে ওমর ফারুক আজান দিতেন। তিনি সেই পাড়ায় বাঙালি আলেম নিয়ে যান, ইসলামের দাওয়াত দেন। ওখানে প্রায় ১৮ পরিবার মুসলিম ছিলেন। তাকে হত্যার পর হুমকি-ধমকির কারণে অনেক পরিবারই এখন মুসলিম পরিচয় দিতেও সাহস পান না।

সেই হত্যাকাণ্ডের পর ওমর ফারুকের স্ত্রীকে একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেওয়া হয়। বড় মেয়ের বিয়ে হয় আরেক উপজাতি নওমুসলিমের সঙ্গে। অন্য সন্তানরা লেখাপড়া করছে, নিরাপদ স্থানে থাকে। ওমর ফারুকের হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের আজও ধরা সম্ভব হয়নি। এসব তথ্য জানালেন ডাক্তার ইউসুফ।

মোশা ত্রিপুরা (পরবর্তী সময়ে নাম আলী) নামের ধর্মান্তরিত হওয়া আরেক তরুণের লাশ পাওয়া যায়নি। মুসলিম হওয়ার কিছুদিন পর তিনি স্ত্রী ও পরিবারকে নেওয়ার জন্য থানচি যান। যাওয়ার পর আরাকান আর্মির সদস্যরা তার বাবা-মাকে বলে যে, ছেলেকে না দিলে সমস্যা আছে। বাবা-মা ফোন দিয়ে ছেলেকে বিষয়টি জানায়। চাপের মুখে তাদের সঙ্গে দেখা করতে যান আলী। এরপর থেকে তার কোনো খোঁজ মেলেনি। আরাকান আর্মির সদস্যরা ফোন দিয়ে জানায় যে, তাকে মেরে ফেলা হয়েছে।

ওমর ফারুক আর আলীর তুলনায় ভাগ্য ভালো মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম ত্রিপুরার। তার ‘মাথার দাম’ও ঘোষণা করেছিল পাহাড়ের সন্ত্রাসীরা। ২০১৯ সালে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন তিনি। তার বাবা ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের খ্রিষ্টান ধর্ম প্রচারক। মুসলমান হওয়ার পর এক বাঙালি নারীকে বিয়ে করেন সাইফুল ইসলাম। আমার দেশকে তিনি বলেন, ধর্মান্তরিত হওয়ার পর বাসায় ও এলাকায় অনেক সমস্যা হয়েছিল। ধর্মান্তরিত হওয়ার কিছুদিন পর তাবলিগে গিয়েছিলাম। পরে শুনি আমার নামে মামলা করেছে। পাড়ার সবাই মিলে আমার বাবাকে চাপ দিয়ে ত্যাজ্যপুত্র করতে বলেছিল। এতে জমিজমা থেকে বঞ্চিত করা সহজ হবে।

সাইফুল বলেন, মুসলমান হওয়ায় বিভিন্ন সময় হুমকি-ধমকি দিয়ে তারা বলত, তুমি এই কাজ (দাওয়াতি কাজ) কেন কর? বন্ধ না করলে মেরে ফেলব। পাহাড়ের ভেতর (গহিন অরণ্য) থেকে হুমকি এসেছিল। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে জানিয়েছিলাম।

ধর্মান্তরিতদের জীবন ও বাস্তবতা

সাইফুলের মতো ধর্মান্তরিত উপজাতি কয়েকজন তরুণের কণ্ঠেও উঠে এসেছে সামাজিকভাবে নানা চাপ ও বঞ্চনার কথা। রাঙামাটির ধর্মান্তরিত এক মার্মা তরুণ নিরাপত্তার স্বার্থে নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, কিন্তু এখন আমার নিজের সম্প্রদায়ই আমার শত্রু।

তিনি জানান, যারা ইসলাম গ্রহণ করেন তাদের জীবনযাত্রায় অনেক পরিবর্তন আসে। তাদের সামাজিকভাবে বয়কট করা হয়। গ্রামের পানির নল, সম্প্রদায় কেন্দ্রে প্রবেশ অলিখিতভাবে নিষিদ্ধ থাকে। অনেককে পারিবারিক জমি থেকে উচ্ছেদের চাপও দেওয়া হয়।

এছাড়া, অলিখিতভাবে অর্থনৈতিক অবরোধের মুখেও পড়তে হয় অনেক পরিবারকে। উপজাতি কারবারিদের নিয়ন্ত্রণে থাকা স্থানীয় বাজারে ধর্মান্তরিতদের পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ে বাধা দেওয়ার ঘটনাও ঘটে মাঝেমধ্যে। চাষাবাদেও সমস্যার মুখে পড়তে হয় অনেককে।

বান্দরবানের নওমুসলিম এক ত্রিপুরা তরুণ বলেন, মুসলমান হওয়ার পর পাহাড়ে চাষ করতে জমি পেতে অনেক সমস্যা হয়। ব্যবসা, সামাজিকতা ও বাঙালিদের সঙ্গে মিশতেও বাধা দেওয়া হয়। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ মানেই তারা মনে করে সে বাঙালি হয়ে গেছে। তাকে নিপীড়ন করা হয়। খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করলে অবশ্য এসব সমস্যা হয় না।

নওমুসলিমদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ধর্মান্তরিতদের বিরুদ্ধে উপজাতি গোষ্ঠীগুলোর প্রধান অভিযোগ, তারা ‘আদিবাসী পরিচয় ও সংস্কৃতি’ ত্যাগ করেছে। এই যুক্তিতেই তাদের ভূমির অধিকার, উত্তরাধিকার ও গ্রামীণ সম্পদে প্রবেশাধিকার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতা ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতেও এই বয়কট কাজ করে। আদিবাসী কারবারিরা ধর্মান্তরিতদের সঙ্গে লেনদেন বন্ধ করে দেয়। পার্বত্য এলাকায় ইসলাম গ্রহণ করাকে জাতিগত ‘বেঈমানি’ হিসেবে দেখানো হয়। এটি একটি সংগঠিত সামাজিক নিয়ন্ত্রণ কৌশল।

ধর্মান্তরিত এই তরুণরা জানান, মুসলিম হওয়ার পর সামাজিকভাবে চাপে রাখা হয়। বলে, ‘তুমি বাঙালি হয়ে গেছ। তুমি অন্য, আমাদের সংস্কৃতি যেমন উপজাতিদের কিছু কিছু সংস্কৃতি আছে, এগুলাতে তুমি নাই। তার মানে তুমি পাহাড়বিদ্বেষী— এরকম একটা বিষয়’।

তারা বলেন, ধর্মান্তরিত হওয়াটা পার্বত্য চট্টগ্রামে শুধু ধর্মীয় নয়, বরং একটি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ‘জাতিগত বিশ্বাসঘাতকতার’ অপরাধে পরিণত হয়েছে—যার পরিণতি সামাজিক বর্জন, সহিংসতা, এমনকি মৃত্যু। জেএসএস, ইউপিডিএফ ও তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সশস্ত্র গ্রুপগুলো ধর্মান্তরবিরোধী কার্যক্রমে সরাসরি জড়িত। ‘জাতিগত পরিচয় রক্ষা’র নামে তারা ইসলাম গ্রহণকারীদের ‘বাঙালি প্রজেক্টের এজেন্ট’ হিসেবে চিহ্নিত করে।

হুমকি, চাঁদা আদায় ও বিয়েতে বাধা

নওমুসলিমদের নিয়ে কাজ করা এক স্বেচ্ছাসেবক আমার দেশকে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করা অপরাধে পরিণত হয়েছে। তাদের ওপর চলে একের পর এক সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিগ্রহ। তাদের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ, সম্প্রদায়ের পানির কল বা সমাজকেন্দ্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ এবং পারিবারিক জমি থেকে উচ্ছেদের চাপ দেওয়া হয়। এমনকি বিয়ের মতো ব্যক্তিগত অনুষ্ঠানেও সশস্ত্র ব্যক্তিরা চাঁদা দাবি করে। নিরাপত্তার স্বার্থে তার পরিচয় গোপন রাখার অনুরোধ করেন এই স্বেচ্ছাসেবক।

নওমুসলিমদের বিয়েতে উপজাতি সন্ত্রাসীদের চাঁদাবাজির ঘটনা বর্ণনা করেন সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘এক নওমুসলিম তরুণীর বিয়ের সময় সশস্ত্র উপজাতি সদস্যরা ৫০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করেছিল। যদিও পরে স্থানীয় প্রশাসন সেই সশস্ত্র ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে।’

বেশি মুসলিম হচ্ছেন ত্রিপুরা সম্প্রদায় থেকে

নওমুসলিমদের সঙ্গে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবীরা জানান, পার্বত্য চট্টগ্রামে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর মধ্যে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের হার সবচেয়ে বেশি। এছাড়া, ম্রোং, চাকমা, মারমা ও খিয়াং সম্প্রদায়ের লোকদের মধ্যেও মুসলমান হচ্ছেন অনেকে। শুধু বান্দরবানেই এখন ৩৩৬ উপজাতি পরিবার মুসলমান হয়েছে। ওমর ফারুক ত্রিপুরা যেখানে বাস করতেন সেই রোয়াংছড়ি এলাকায় ১৩ পরিবার মুসলমান হয়েছিলেন। উনি যখন জীবিত ছিলেন তখন ১৮ পরিবার মুসলমান ছিল।

জেএসএস যা বলছে

উপজাতিদের ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে রাঙামাটি জেএসএস-এর জেলা কমিটির সভাপতি গঙ্গা মানিক চাকমা আমার দেশকে বলেন, ‘তাদের সংখ্যা খুবই কম। চোখে পড়ার মতো না, খোঁজও রাখি না। সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার জন্য তারা ভেতরে ভেতরে (মুসলিম) হয় । তাদের সঙ্গে (আমাদের) কোনো সমস্যাও নেই।’

তিনি আরো বলেন, ‘রাঙামাটি এলাকায় বাঙালিদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব লাগায় ইউপিডিএফ।’অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে ইউপিডিএফ-এর একজন মুখপাত্রকে ফোন ও বার্তা দেওয়া হলেও তাদের পক্ষ থেকে সাড়া মেলেনি। বান্দরবান জেলা প্রশাসকও বার্তার জবাব দেননি।

আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মীরা যা বলছেন

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহরিয়ার মাহমুদ আমার দেশকে বলেন, ‘এসব ঘটনা সুস্পষ্টভাবে সংবিধানের ৪১ নম্বর অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন এবং একই সঙ্গে মানবাধিকারেরও সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। কিন্তু কোনো সরকারই পাহাড়ে সন্ত্রাস নির্মূলের বিষয়ে আন্তরিক নয়। মূলত এ দেশের দুর্বল শাসকরা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য যাদের উপর নির্ভরশীল, সেই আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলোই নিজেদের ভূরাজনৈতিক স্বার্থে পাহাড়ি সন্ত্রাসীগোষ্ঠীগুলোকে মদত দিচ্ছে এবং ব্যবহার করছে।’

দীর্ঘ ২ যুগ পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ে গবেষণা করছেন সাংবাদিক ও গবেষক এ এইচ এম ফারুক। তিনি আমার দেশকে বলেন, ‘উপজাতিদের কেউ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে পাহাড়ের ৬টি সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠনই তাদের হুমকি-ধমকি দেয়। এমনকি অতীতে হত্যার নজিরও আছে। বিশেষ করে বান্দরবানে মোহাম্মদ ওমর ফারুক ত্রিপুরাকে গুলি করে হত্যার ঘটনা দেশ-বিদেশে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে।’

পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্রপরিষদ নেতা আসিফ ইকবাল আমার দেশকে বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে কেউ মুসলিম হলে নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয়। ইসলামের প্রচার ও প্রসার করতে গেলে ধর্মপ্রচারকদের বিরুদ্ধে সুপরিকল্পিতভাবে একটি গোষ্ঠী প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে গুম-খুনের হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে।’

মানবাধিকার কর্মীরা বলেন, এটি জাতিগত ও ধর্মীয় নিপীড়নের একটি জটিল সংমিশ্রণ। ভুক্তভোগীরা রাষ্ট্র ও নিজ সম্প্রদায়—দুই দিক থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে, ধর্মান্তরিতরা সংখ্যালঘুদের মধ্যেও একটি সংবেদনশীল উপগোষ্ঠী। পার্বত্য চট্টগ্রামের ধর্মান্তরিত মুসলমানরা এক চরম মানবিক ও আইনগত সংকটের মধ্যে আটকা পড়েছেন।

Google News Icon

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর

খুঁজুন