মহেশখালীতে পরিত্যক্ত বহু আশ্রয়কেন্দ্র , ঝুঁকিতে তিন লাখ মানুষ

আনছার হোসেন, কক্সবাজার
প্রকাশ : ২৯ জুলাই ২০২৫, ০৪: ৩২
ছবি: সংগৃহীত

কক্সবাজারের দ্বীপ উপজেলা মহেশখালী ভৌগোলিক কারণে বরাবরই প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ এলাকা। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসের কারণে এখানকার সাধারণ মানুষের নিরাপত্তায় সরকারিভাবে ইউনিয়ন পর্যায়ে নির্মাণ করা হয়েছিল বেশ কয়েকটি আশ্রয়কেন্দ্র। কিন্তু তিন দশকের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ না করায় অধিকাংশ আশ্রয়কেন্দ্র বর্তমানে পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছে। আবার কিছু দখল হয়ে আছে প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতাদের হাতে। স্থানীয়দের মতে নতুন আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ বা পুরোনোগুলোর সংস্কার করা না হলে ঝুঁকিতে পড়বে তিন লাখেরও বেশি উপকূলবাসীর জীবন।

১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে এই এলাকায় ব্যাপক প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির পর এ উপজেলায় আশ্রয়কেন্দ্রগুলো নির্মাণ করা হয়। ছোট মহেশখালী, মাতারবাড়ী, কালারমারছড়া, হোয়ানক, শাপলাপুর ও ধলঘাটাসহ বেশ কয়েকটি ইউনিয়নে সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। কোথাও ছাদ ফেটে পানি পড়ে, কোথাও দরজা-জানালা ভেঙে পড়ে আছে। অনেক আশ্রয়কেন্দ্র এখন গোডাউন, গবাদিপশুর খামার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

তাদের মতে, অতিবৃষ্টি হলেই ডুবে যায় কুতুবজোমের ঘটিভাঙা, পৌরসভার চরপাড়া, ছোট মহেশখালীর মুদিরছড়া ও উম্বনিয়াপাড়া, বড় মহেশখালীর বরদিয়া, হোয়ানকের কালাগাজির পাড়া, ধলঘাটা ইউনিয়ন, মাতারবাড়ীর সাইটপাড়াসহ কয়েকটি গ্রাম। এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েন অন্তত ২০ হাজার ও আশ্রয়হীন হন দুই হাজারের বেশি মানুষ।

মাতারবাড়ী ইউনিয়নের স্থানীয় বাসিন্দা কাইমুল ইসলাম ছোটন বলেন, আমরা জানি ঘূর্ণিঝড় এলে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে হবে, কিন্তু আমাদের ইউনিয়নের আশ্রয়কেন্দ্রগুলো এখন গুদাম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তার ভাষায়, সেখানে গেলে নিজেরাই আরো বিপদে পড়ি। সরকার যদি নতুন ভবন করে দিত বা পুরোনোগুলো ঠিক করত, তাহলে আমরা অন্তত সন্তানদের নিয়ে নিরাপদে থাকতে পারতাম।

মহেশখালীর আদি উপদ্বীপ ধলঘাটা ইউনিয়ন বঙ্গোপসাগরের পাশে হওয়ায় অতি জোয়ার হলেই এটি প্লাবিত হয়। এ ইউনিয়নে অন্তত ১০ হাজার মানুষের বসবাস। কিন্তু ভালো আশ্রয়কেন্দ্র বলতে দুটি স্কুল ও একটি আশ্রয়কেন্দ্র ছাড়া আর কিছু নেই।

ধলঘাটা ইউনিয়নের স্কুলশিক্ষক মোহাম্মদ হোসেন বলেন, আমাদের স্কুলের পাশে যে আশ্রয়কেন্দ্র ছিল, সেটা এখন ব্যবহার অনুপযোগী। ফাটল ধরেছে, ছাদ থেকে পলেস্তারা খসে পড়ছে। সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হলো, প্রায় তিন-চার কিলোমিটারের মধ্যে কোনো কার্যকর আশ্রয়কেন্দ্র নেই।

মহেশখালী উপজেলার প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা ও ধলঘাটা ইউনিয়নের নৌকা প্রতীকের চেয়ারম‌্যান (বর্তমানে বহিষ্কৃত) আহসান উল্লাহ বাচ্চু নিজেই একটি তিনতলা আশ্রয়কেন্দ্র দখল করে দিব‌্যি ঘরসংসার চালিয়ে যাচ্ছেন। আওয়ামী লীগ নেতা হলেও এখনো বহাল তবিয়তে সেটা দখল করে রেখেছেন। এখানেই তার টর্চার সেল আছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

মহেশখালীর আরো একটি উপদ্বীপ হলো সোনাদিয়া। এটি সাগরের একবারে মাঝখানে। এ দ্বীপে দুই পাড়া মিলে প্রায় দেড় হাজার মানুষের বসবাস। কিন্তু দ্বীপের একমাত্র ভবনটি হলো স্কুলভবন। সোনাদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ‌্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মিজানুর রহমান মোল্লা বলেন, আমাদের স্কুলেই অন্তত ১২০ জন শিক্ষার্থী পড়ে। দুর্যোগের সময় তাদের নিয়ে কোথায় যাব আমরা? ভবনটি খুবই নড়বড়ে। তাছাড়া সোনাদিয়া এলাকার মানুষজনের জন‌্য এর বিকল্প কোনো আশ্রয়কেন্দ্র নেই।

মহেশখালীর হোয়ানক ইউনিয়নের একজন প্রতিনিধি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অনেক জায়গায় দেখা গেছে আশ্রয়কেন্দ্র দখল করে রেখেছে স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি। কেউ গরুর খামার করেছে, কেউ আবার পাটাতন লাগিয়ে ঘর বানিয়েছে। এসব বিষয়ে অনেকবার অভিযোগ জানানো হলেও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

মহেশখালীর বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, দুর্যোগের আশঙ্কায় সাধারণ মানুষ সব সময় আতঙ্কে থাকে। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুম ও ঘূর্ণিঝড়ের সময় আতঙ্ক কয়েকগুণ বেড়ে যায়।

ছোট মহেশখালী ইউনিয়নের মুদিরছড়া এলাকার গৃহবধূ হালিমা খাতুন বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের সময় আমাদের ঘরে পানি উঠে যায়। ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে কোথায় যাব—এ চিন্তায় রাত কাটে। আগের মতো আরেকটা বড় ঝড় এলে কী হবে আল্লাহই জানে। আমরা শুধু চাই, একটা নিরাপদ জায়গা।

এ বিষয়ে মহেশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হেদায়েত উল‌্যাহ বলেন, মহেশখালী একটি ঘূর্ণিঝড়প্রবণ এলাকা। আশ্রয়কেন্দ্র ঘাটতির বিষয়টি আমরা গুরুত্ব সহকারে দেখছি। ইতোমধ্যে কিছু পুরোনো আশ্রয়কেন্দ্রের তালিকা করা হয়েছে। নতুন প্রকল্পের আওতায় কয়েকটি আধুনিক ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে।

তিনি বলেন, স্থানীয় পর্যায়ে যারা আশ্রয়কেন্দ্র দখল করে আছে, তাদের বিষয়ে আমরা খোঁজ নিচ্ছি। শিগগির উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হবে।

স্থানীয় উন্নয়নকর্মী ও অ্যাকটিভিস্ট রুহুল আমিন বলেন, মহেশখালীতে তিন লাখেরও বেশি মানুষের বাস। কিন্তু কার্যকর আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে মাত্র ৪০-৫০টি, যার অধিকাংশই জরাজীর্ণ। তিনি মনে করেন, এই উপজেলায় কমপক্ষে আরো ৫০টি আধুনিক আশ্রয়কেন্দ্র প্রয়োজন। যাতে একযোগে অন্তত এক লাখ মানুষ নিরাপদে থাকতে পারেন।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত