চট্টগ্রাম নগরীর কেসি দে রোডে অবস্থিত বিভাগীয় গণগ্রন্থাগারটি টানা সাত বছর ধরে বন্ধ। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে সংস্কারকাজ শুরু হওয়ার পর থেকে বন্ধ হয়ে যায় জনসাধারণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এ পাঠাগার। কয়েক দফা আশ্বাস ও উদ্যোগ নেওয়া হলেও চালু করা সম্ভব হয়নি। দীর্ঘসূত্রতা, প্রকল্প স্থবিরতা ও ব্যবস্থাপনার দুর্বলতায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গ্রন্থাগারের এক লাখেরও বেশি মূল্যবান বইসহ বিপুল আসবাবপত্র। এ নিয়ে ক্ষোভ বাড়ছে পাঠক, লেখক, গবেষক ও সংস্কৃতিপ্রেমীদের মাঝে। প্রকল্পের কাজ শেষ পর্যায়ে থাকলেও বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। ফলে গ্রন্থাগারটি কবে খুলবে- সেটা নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে।
পাঠক-লেখক সমাজের অভিযোগ, সংস্কার শুরুর পর থেকেই গ্রন্থাগারটির দুর্ভাগ্য শুরু হয়। সাত বছর ধরে শহরে সরকারি কোনো গ্রন্থাগার না থাকায় শিক্ষার্থীদের পাঠাভ্যাসে বড় ধরনের বিরূপ প্রভাব পড়েছে। তারা বলছেন, বই থেকে দূরে সরে কিশোর-তরুণরা ডিভাইসে আসক্ত হয়ে পড়ছে, জড়িয়ে পড়ছে নানা ধরনের অপরাধে। তাদের আশঙ্কা, প্রকল্পের ধীরগতির কারণে চট্টগ্রামবাসী এই ঐতিহাসিক গ্রন্থাগারটিই হারাতে বসেছে।
জানা যায়, নগরীর মুসলিম ইনস্টিটিউট এলাকায় গড়ে ওঠা এ গ্রন্থাগার ঘিরে ২০১৮ সালে নেওয়া হয় ২৮১ কোটি টাকার সংস্কার প্রকল্প। প্রাথমিকভাবে প্রকল্পের মেয়াদ ছিল তিন বছর। ২০২১ সালে চালু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কাজ শেষ না হওয়ায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয় ছয়বার। সর্বশেষ ২০২৪ সালের জুনে মেয়াদ শেষ হলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আরপি এন্টারপ্রাইজ কাজ অসম্পূর্ণ রেখে চলে যাওয়ায় পুরো প্রকল্পই বন্ধ হয়ে আছে।
১৫ তলাবিশিষ্ট গ্রন্থাগার ভবনের পাশাপাশি মুসলিম ইনস্টিটিউটের আটতলা ভবন, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, পাবলিক প্লাজা, ওপেন এয়ার থিয়েটার, পুকুর, ভাস্কর্য গার্ডেনসহ সমৃদ্ধ একটি সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স নির্মাণের লক্ষ্য ঠিক করা হয়।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, ১৫ তলা ভবনের নির্মাণকাজ শেষ হলেও ভেতরের অবস্থা নাজুক। পাঠকক্ষে উল্টে রাখা টেবিল-চেয়ারে ঘুণপোকা ধরেছে; মেঝেতে পড়ছে কাঠের গুঁড়ো। ধুলাবালিতে ঢেকে আছে বইয়ের তাক। অনেক বই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে; কোনো তদারকি নেই। তবে ভবনের পঞ্চম তলায় অস্থায়ীভাবে সীমিত পরিসরে চালু রয়েছে গ্রন্থাগারের অফিস কার্যক্রম।
নতুন ১৫ তলা গ্রন্থাগারে থাকবে ৯টি পাঠকক্ষ, যেখানে একসঙ্গে দেড় হাজার পাঠক বসতে পারবেন, বড় ও ছোট সেমিনার হল, প্রতিবন্ধী পাঠকদের জন্য পৃথক পাঠকক্ষ, শিশুদের জন্য আলাদা ফ্লোর, গবেষণা কেন্দ্র, আইসিটি লাইব্রেরি, ক্যানটিন, রেস্টহাউস ও ডরমিটরি।
এছাড়া মুসলিম ইনস্টিটিউট ভবনে থাকবে ৯০০ আসনের মিলনায়তন, ৩৫০ আসনের মিনি অডিটোরিয়াম, ১০০ ও ২০০ আসনের দুটি সেমিনার কক্ষ, আর্ট গ্যালারি ও স্যুভেনির শপ।
গ্রন্থাগার সূত্র জানায়, চট্টগ্রামের কেসি দে রোডে ১৯২৫ সালে সংস্কৃতিকর্মী ও সমাজসেবীদের উদ্যোগে গড়ে তোলা হয় চট্টগ্রাম মুসলিম ইনস্টিটিউট হল। এরপর প্রায় ১০০ বছর ধরে সেখানে এ অঞ্চলের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়ে আসছে। ১৯৫৯ সালে সরকার মুসলিম ইনস্টিটিউট অধ্যাদেশের মাধ্যমে হলটি অধিগ্রহণ করে। ১৯৬৩ সালে সেখানে স্বল্পপরিসরে গ্রন্থাগারের কার্যক্রম শুরু হয়। এরপর নব্বইয়ের দশকে মুসলিম ইনস্টিটিউটের পাশে লাইব্রেরির বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়। বর্তমানে এক লাখ ১১ হাজার বই রয়েছে গণগ্রন্থাগারে। নতুন আরো পাঁচ হাজার বই সংযোজন করা হবে।
চট্টগ্রামের মঞ্চ উপস্থাপক দিলরুবা খানম বলেন, জ্ঞান আহরণে শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবইয়ের বাইরে প্রচুর দেশ-বিদেশের বই পড়তে হয়। কিন্তু চট্টগ্রামে গত সাত বছর ধরে বন্ধ আছে বিভাগীয় গণগ্রন্থাগার। তাহলে শিক্ষার্থী, লেখক, কবি, সাহিত্যিকরা কোথায় যাবেন। এতে বই পড়ে আলোকিত মানুষ হওয়ার সুযোগ আর থাকছে না। দিন দিন কিশোররা অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। সমাজে মা-বাবা, ভাই-বোনকেও খুন করছে কিশোররা। বই পড়ার সেই সুযোগ রাষ্ট্রই বন্ধ করে দিয়েছে।
কলামিস্ট জামশেদ উদ্দিন বলেন, আমরা একটি পুরো ব্যাচ গ্রন্থাগারে গিয়ে বই পড়তাম। অনেক দুর্লভ বই সেখানে আছে। কোনো লেখার রেফারেন্স টানতে তথ্যের জন্য সেখানে বই খুঁজতে যেতাম। এছাড়াও আমাদের সাহিত্যের আড্ডা জমত। এখন সেটা হারিয়ে গেছে। সরকারের কাছে আহ্বান, দ্রুত এটি খুলে দিয়ে চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে মুক্ত করা হোক।
প্রকল্পের ব্যাপারে জানতে চাইলে প্রিন্সিপাল লাইব্রেরিয়ান-কাম-উপরিচালক দেবাশীষ ভদ্র বলেন, প্রকল্পের প্রায় ৯৫ শতাংশ কাজ শেষ। কেবল লিফট, এসি স্থাপন ও ইন্টেরিয়র ডিজাইনের কাজ বাকি আছে। বর্তমানে প্রকল্পটি স্থগিত আছে। আমরা এটি চালু করার চেষ্টা করছি। তিনি আরো বলেন, গত বছর আমাদের বাইরে ভাড়ায় অফিস করতে হয়েছে। এতে পাঠকদের যেমন অসুবিধা হচ্ছে, তেমনি আমাদেরও হচ্ছে।
ডেপুটি প্রকল্প পরিচালক ও বিভাগীয় গণগ্রন্থাগারের সহকারী প্রোগ্রামার মো. কামরুল হাসান জানান, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আরপি এন্টারপ্রাইজ কাজ শেষ না করায় বর্তমানে কাজ বন্ধ রয়েছে। আমরা প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করেছি। একনেকে অনুমোদন হলে পুনরায় চালু হবে। প্রকল্পটির ৯২ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। বাকি আট শতাংশ ইলেকট্রো মেকানিক্যাল কাজ গণপূর্ত অধিদপ্তরের অধীনে রয়েছে।
চট্টগ্রামবাসীর দাবি, চলতি বছরের মধ্যেই গ্রন্থাগারটি খুলে দেওয়া হোক। নগরের সাংস্কৃতিক জীবন, পাঠাভ্যাস ও জ্ঞানচর্চা পুনরুদ্ধারের জন্য এর বিকল্প নেই।

