সদরঘাটে লাল ও হলুদের পর এবার সবুজ বাহিনীর দৌরাত্ম্য

রাকিব হোসেন, ঢাকা দক্ষিণ
প্রকাশ : ২৪ আগস্ট ২০২৫, ১৩: ৫১

ঢাকার সদরঘাট দেশের সুপ্রাচীন নদীবন্দর । স্বাধীনতা পরবর্তীকালে যখন যে রাজনৈতিক দল সরকার গঠন করেছে তখন সে দলের সমর্থিত ঘাট শ্রমিকের রাজত্ব ও দৌরাত্ম্য বেড়েছে এই ঘাটে।

বিজ্ঞাপন

আওয়ামী লীগের শাসনামলে লাল বাহিনী, বিএনপির শাসনামলে তাদের হলুদ বাহিনী অপরাধের রামরাজত্ব কায়েম করে। এবার সব বাহিনীকে পেছনে ফেলে গড়ে উঠেছে ঘাট শ্রমিক দলের সভাপতি সুমন ভুইয়ার সবুজ বাহিনী।

এই বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করছে শ্যামবাজার থেকে শুরু করে বাদামতলী ফলের বাজার, বুড়িগঙ্গার তীরের সড়কে ফুটপাত, ভাসমান দোকান, বুড়িগঙ্গার নৌঘাট ও শুল্ক আদায় কেন্দ্র।

জিম্মি করে রাখা হয়েছে বুড়িগঙ্গা তীরের ওয়াইজঘাটের তিন ফেরি শুল্ক কেন্দ্র ও কেরানীগঞ্জের আলম মার্কেট থেকে দ্বিতীয় বুড়িগঙ্গা সেতু পর্যন্ত ১৫টি নৌঘাট। সুমন ভুইয়ার দখলদারিত্বের কারণে এসব নৌঘাট ১০ বার টেন্ডার আহ্বান করেও ইজারা দিতে পারেনি বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ।

মামলার জালে আটকে রেখেছেন সদরঘাট লেবার হ্যান্ডলিং পয়েন্ট ও বাকল্যান্ডবাদ শুল্ক আদায় এবং লেবার হ্যান্ডলিং পয়েন্ট। এ কারণে সরকার এই দুটি শুল্ক আদায় কেন্দ্র থেকে কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সদরঘাটের একটি সূত্র জানায়, ২০০১ সালে কিশোরগঞ্জ থেকে ঢাকায় এসে সদরঘাট পন্টুনে কাজ নেয় সুমন ভুইয়া। ২০০৪ সালে পরিচয় হয় একজন শ্রমিক নেতার সঙ্গে। এই শ্রমিক নেতার আশীর্বাদে সুমন ভুইয়া ২০১০ সালে ঘাট শ্রমিক দলের সাধারণ সম্পাদক ও ২০২১ সালে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শ্রমিক দলের আহ্বায়কের পদ পান।

রাজনীতিতে সফলতা পেলেও ফেঁসে যান দুটি হত্যা মামলায়। সুমন ভুইয়া কেরানীগঞ্জের ঝুট ব্যবসায়ী সোহেল হত্যার এজাহারভুক্ত এক নম্বর ও দেলোয়ার হত্যা মামলার তিন নম্বর আসামি।

কিছুদিন গা-ঢাকা দিলেও ব্যাপক উত্থান হয় ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে। দখলে নেন শ্যামবাজার থেকে শুরু করে বাদামতলীর ফল বাজার। চাঁদা আদায়ের জন্য রেখেছেন ঘাট শ্রমিক কুলি মজুর, আওয়ামী লীগ, বিএনপির সমন্বয়ে ৫০০ লোকের নিজস্ব বাহিনী। এই বাহিনীর সদস্যদের সবুজ রংয়ের গেঞ্জিতে লেখা রয়েছে, ঘাট ইজারাদার সুমন ভুইয়া ও কুলি নাম্বার।

বাহিনীর সদস্যরা সুমন ভুইয়ার নামে শ্যামবাজার থেকে বাদামতলী পর্যন্ত ২ কিলোমিটার সড়কের দুই পাশে প্রায় ৩/৪ হাজার দোকান থেকে দৈনিক ৫০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা তোলে। মোবারক (ছদ্মনাম) ফুটপাতের কাপড় বিক্রেতা জানায়, সুমন ভুইয়ার লোকদের তিনি প্রতিদিন ৩০০ টাকা চাঁদা দেন।

তিনি বলেন, চায়ের দোকান, ভাতের দোকান, ফলের দোকান, পুরান কাপড়, চোরাই মালামাল বিক্রি, জুতার দোকান কেউ চাঁদার বাইরে না। বাহিনীর সদস্যদের হাতে হয়রানির শিকার হচ্ছে সাধারণ লঞ্চ যাত্রীরাও। ইচ্ছেমাফিক মাল ওঠানামার মজুরি আদায় করা হয়। মানা হয় না সরকার কর্তৃক নির্ধারিত নীতিমালা। যে কারণে শ্রমিকদের জোর-জুলুমের কাছে সাধারণ যাত্রীরা জিম্মি থাকে সব সময়।

ঢাকা নদী বন্দর সূত্রে জানা যায়, সদরঘাট তিন লেবার হ্যান্ডলিং পয়েন্ট ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৬ কোটি দুই লাখ, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৫ কোটি ৯৭ লাখ ৮৫ হাজার, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা ইজারা দেওয়া হয়েছে।

বাকল্যান্ডবাদ শুল্ক আদায় ও লেবার হ্যান্ডলিং পয়েন্টে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১ কোটি ২০ লাখ, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এক কোটি পঁচিশ লাখ ও ২০২৫-২৬ অর্থবছরে এক কোটি ৩২ লাখ টাকা ইজারা দেওয়া হয়েছে। এই দুটি শুল্ক আদায়ের কেন্দ্র ও লেবার হ্যান্ডলিং মামলা দিয়ে আটকে রেখেছে সুমন ভুইয়া। যে কারণে ওপেন টেন্ডারে যেতে পারছে না বিআইডব্লিউটিএ।

বিআইডব্লিউটিএ-এর বন্দর ও পরিবহন পরিচালক একেএম আরিফ উদ্দিন আমার দেশকে জানান, ঢাকা নদী বন্দরের চারটি পয়েন্ট মামলা দিয়ে আটকে রাখায় সরকার কোটি টাকার রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে। তিনি বলেন, ওয়াইজ ঘাটে তিন ফেরি শুল্ক কেন্দ্র জিম্মি করে রাখায় ১০ বার টেন্ডার আহ্বান করেও ইজারাদার খুঁজে পাননি।

কোতোয়ালি থানা বিএনপির সাবেক সভাপতি আবুল হোসেন বাবলা আমার দেশকে বলেন, সুমন ভুইয়া শ্যামবাজার থেকে বাদামতলী পর্যন্ত ব্যাপক চাঁদা আদায় করছে এ কথা সত্য। তিনি বলেন, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের কমিটি স্থগিত থাকায় যে যেভাবে পারছে চাঁদা আদায় করছে।

সুমন ভুইয়া বাইরের লোক তার এলাকা ও দলের প্রতি কোনো কমিটমেন্ট নাই। দলের প্রতি আনুগত্য ও ভালোবাসা থাকলে এভাবে চাঁদা তুলে দলের বদনাম করতে পারত না। তিনি বলেন, কমিটি না থাকায় আমরা স্থানীয় লোক হয়েও কিছু করতে পারছি না।

এ ব্যাপারে ঘাট শ্রমিক দলের সভাপতি সুমন ভুইয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত নই। কেউ প্রমাণ দিতে পারবে না আমি চাঁদাবাজি করছি।

দুটি শুল্ক আদায় কেন্দ্র মামলা দিয়ে আটকে রাখার ব্যাপারে তিনি বলেন, ২০২৪ -২৫ অর্থ বছরে ইজারামূল্য বেশি হওয়ায় আমার ব্যবসায়িক ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিপূরণ আদায় ও সঠিক মূল্যে দরপত্র আহ্বানের জন্য মামলা করা হয়েছে।

তার বিরুদ্ধে দুটি হত্যা মামলার ব্যাপারে বলেন, বিএনপির সঙ্গে যুক্ত থাকায় আওয়ামী শাসনামলে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে। সদরঘাটে ৫০০ লোক নিয়ে নিজস্ব বাহিনী গঠনের ব্যাপারে বলেন, সবাই বিগত আন্দোলন-সংগ্রামে শ্রমিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিল। বাহিনীতে আওয়ামী লীগের কেউ নেই। শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য তাদের আমার নামের পোশাক দেওয়া হয়েছে।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত