দেশের সীমান্তবর্তী উত্তর-পূর্বাঞ্চলের গারো পাহাড় বেষ্টিত শেরপুরের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শেরপুর জি কে পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়। এই জনপদের অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে অজ্ঞতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে ১০৬ বছর আগে এই বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সেই থেকে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে জ্ঞানের দ্যুতি ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে অবিরাম কর্মপ্রয়াস অব্যাহত রেখেছে বিদ্যালয়টি।
উনিশ শতকে তৎকালীন জমিদার গোবিন্দ কুমার চৌধুরী ১৯১৯ সালে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন।
জেলা শহরের মাধবপুর এলাকায় সোয়া ছয় একর জমির ওপর স্কুলটি স্থাপন করা হয়। এর প্রতিষ্ঠার ব্যয়ভার হিসেবে তৎকালীন আড়াইআনী জমিদার গোপাল চন্দ্র দাস ২৫ হাজার টাকা, পৌনে তিনআনী জমিদার সত্যেন্দ্র মোহন চৌধুরী ১৫ হাজার টাকা ও সতীন্দ্র মোহন চৌধুরী ১০ হাজার টাকা অনুদান দেন।
এক সময় শেরপুর ছিল জমিদার অধ্যুষিত এলাকা। তৎকালীন জমিদাররা তাদের জমিদারি পরিচালনার জন্য কাচারি, লেখাপড়ার জন্য বিদ্যালয়, চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল ও বসবাসের জন্য দৃষ্টিনন্দন বাড়িসহ প্রয়োজনীয় বহু স্থাপনা নির্মাণ করেছিলেন। তাদের এমন একটি দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা হলো শেরপুর জি কে পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়।
গথিক স্থাপত্য রীতিতে চুন ও সুরকির সংমিশ্রণে ইটের গাঁথুনি দিয়ে এই বিদ্যালয় ভবনটি নির্মিত হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে ২০১৮ সালে শতবর্ষ উপলক্ষে বিদ্যালয়টির সংস্কার করা হয়। বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের মধ্যে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক কেন্দ্রীয় সিনিয়র সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মরহুম মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম নেতা প্রয়াত রবি নিয়োগী (পুরো নাম রবীন্দ্র চন্দ্র নিয়োগী), খ্যাতনামা চক্ষু বিশেষজ্ঞ মরহুম ডা. সৈয়দ আব্দুল ওয়াদুদ, শিক্ষাবিদ অধ্যক্ষ মরহুম সৈয়দ আব্দুল হান্নানের নাম উল্লেখযোগ্য।
বিদ্যালয়টিতে তৃতীয় থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত মোট আটটি ক্লাসে প্রায় ৬শ’ জন ছাত্রছাত্রী পড়ালেখা করছে। বর্তমানে ১৯ জন শিক্ষক দিয়ে চলছে পাঠদান কার্যক্রম। শিক্ষার্থীদের খেলাধুলার জন্য রয়েছে দুটি মাঠ। রয়েছে প্রশস্ত একটি পুকুর। বিভিন্ন সাঁতার প্রতিযোগিতায় পুকুরটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বিদ্যালয়ের সামনে স্থাপন করা হয়েছে একটি শহীদ মিনার। আছে চার হাজারের অধিক বই নিয়ে একটি লাইব্রেরি। বিদ্যালয় ভবনের দক্ষিণ পাশে নির্মাণাধীন চারতলা বিশিষ্ট একটি একাডেমিক ভবন। রয়েছে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি ও স্কাউটিং কার্যক্রম।
এই বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান শিক্ষক ছিলেন তৎকালীন জমিদার সত্যেন্দ্র মোহন চৌধুরী। পরবর্তী সময়ে ১৯৫০ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৩৭ বছর এই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন প্রয়াত রোহিনী কান্ত হোড়। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান ও ৭১ সালের স্বাধীনতা আন্দোলনে এই বিদ্যালয়ের ছাত্ররা অংশ নিয়েছেন। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করে জীবন দিয়ে শহীদ হয়েছেন। তারা হলেন- শহীদ দারোগ আলী, শহীদ মুতাসিম বিল্লাহ খুররম, শহীদ গোলাম মোস্তফা তালুকদার, শহীদ কে এম নাজমুল হোসেন বুলবুল, শহীদ কাজল, শহীদ কায়সার।
এছাড়াও মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অ্যাডভোকেট আখতারুজ্জামান, আমির ফারুক, কাজী মাসুদ রানা, কর্নেল আরিফ, মরহুম তালাপতুফ হোসেন মঞ্জু, মরহুম এমদাদুল হক নিলু, ফরিদুর রহমান ফরিদ, মরহুম আলী কবির মানিক, অ্যাডভোকেট প্রদীপ দে কৃষ্ণ প্রমুখ।
শেরপুর জি কে পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী সাংবাদিক রফিক মজিদ বলেন, আমি এই বিদ্যালয় থেকে ১৯৮৬ সালে এসএসসি পাস করেছি। তৎকালীন প্রধান শিক্ষক রোহিনী কান্ত হোড়ের দক্ষতার কারণে ওই সময় বিদ্যালয়টির সুনাম ছিল সবচেয়ে বেশি। পড়াশোনার পাশাপাশি স্কুলটির দাপট ছিল খেলাধুলায়।
তিনি বলেন, হাজারো স্মৃতি এখনো মনে পড়ে বিশেষ করে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বিদ্যালয়ের পিছনে বসে সময় কাটানো, জাকির ভাইয়ের টং দোকানের চালতা ও জলপাইয়ের আচার, আইসক্রিম, মুড়ি
এবং চানাচুর ভর্তা কী স্বাদই না ছিল! সে কথা মনে করলে এখনো জিভে পানি এসে যায়। বিদ্যালয় ভবনের প্রতিটি ভাঁজে রয়েছে অনেক আনন্দ-বেদনার স্মৃতি।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, আমি এই বিদ্যালয়ে ২০১২ সালে যোগ দিয়েছি। ২০১৩ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এসএসসি পরীক্ষায় এই বিদ্যালয়ের প্রায় শতভাগ শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়েছে। কিন্তু এই বছর এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল আশানুরূপ হয়নি। ১০৮ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৫৮ জন শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়েছে। গত বছর রাজনৈতিক অস্থিরতায় পর্যাপ্ত ক্লাস হয়নি। আগামী বছর থেকে চেষ্টা করা হবে এসএসসির ফলাফল যাতে পূর্বের মতো হয়। স্বীয় গৌরব ও সুনাম অক্ষুণ্ণ রেখে শতবর্ষী বিদ্যালয়টি এগিয়ে যাচ্ছে। সামনের দিনগুলোতে এই বিদ্যালয়ের সুনাম আরো বৃদ্ধি পাবে বলে প্রত্যাশা করি।

