জামালপুরের মাদারগঞ্জ উপজেলার নগর বধ্যভূমি অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পাক হানাদার বাহিনীর বুলেটে নিমর্মভাবে নিহত হন উপজেলার আদারভিটা ইউনিয়নের নগরগ্রামে ৬ জন গ্রামবাসী। নৃশংস সেই হত্যাযজ্ঞের দুই-তিন দিন পর পাশের গ্রামের লোকজন ডোবা থেকে তাদের লাশ উদ্ধার করে ঘটনাস্থলেই দাফন করে। এরপর স্বাধীনতার ৫৪ বছর পার হলেও এই বধ্যভূমি সংরক্ষণের রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। পালন হয় না গণহত্যা দিবসও। ভয়াল সেই স্মৃতি আজও কাঁদায় নগরগ্রামের মানুষকে।
শহীদ পরিবারসহ স্থানীয়রা ছয় শহীদের কবর সংরক্ষণ, তাদের নামে সড়ক ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ এবং ‘মাদারগঞ্জ গণহত্যা দিবস’ হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবি জানিয়েছেন।
স্থানীয়দের ভাষ্য অনুযায়ী, ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের কোনো এক দিন পাকিস্তানি সেনাদের একটি দল আক্রমণের উদ্দেশ্যে সরিষাবাড়ীর ভাটারা এলাকা থেকে মাদারগঞ্জের দিকে রওয়ানা দেয়। কয়েকটি জিপে করে তারা মাদারগঞ্জ সদরে আসছিল। পথে ভুল করে তারা উপজেলার আদারভিটা ইউনিয়নের নগর গ্রামের ভেতরে ঢুকে পড়ে।
এ সময় ওই গ্রামের মেছের আলী নামের এক বাকপ্রতিবন্ধী যুবক তাদের একটি জিপ লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ করেন। সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানি সেনারা জিপ থেকে নেমে মেছের আলীকে গাছের সঙ্গে বেঁধে গুলি করে হত্যা করে। এ ঘটনার প্রতিবাদ করলে গ্রামের সাহসী যুবক আব্দুল গনি, আব্দুল কদ্দুছ, নুর হোসেন, ঘোতা মিয়া ও ভোলা মিয়ার ওপর হানাদার বাহিনী নির্বিচারে ব্রাশ ফায়ার চালায়। ঘটনাস্থলেই তারা মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। হঠাৎ এ হত্যাযজ্ঞে আতঙ্কিত হয়ে গ্রামের অন্য বাসিন্দারা প্রাণ বাঁচাতে পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলোতে পালিয়ে যান। পাকসেনারা চলে যাওয়ার আগে নগর গ্রামে অগ্নিসংযোগ ও ব্যাপক লুটপাট চালায়। ঘটনার দুই থেকে তিন দিন পর আশপাশের গ্রাম থেকে লোকজন এসে পাশের ডোবা থেকে ছয় শহীদের মরদেহ উদ্ধার করে সড়কের পাশে তাদের দাফন করেন। দেশ স্বাধীনের পর তৎকালীন এমপি করিমুজ্জামান তালুকদারসহ প্রশাসনের লোকজন গণকবরটি পরিদর্শন এবং এটিকে বধ্যভূমি হিসেবে চিহ্নিত করেন।
এরপর ১৯৯১ সালের দিকে আদারভিটা-কালিবাড়ী গ্রামীণ সড়ক নির্মাণকালে বধ্যভূমির ওপর দিয়ে মাটির রাস্তা করার পরিকল্পনা করা হয়। তখন এলাকার লোকজন ও শহীদদের পরিবার রাস্তা নির্মাণে বাধা দেন। কিন্তু কাজ এগিয়ে যায় এবং বধ্যভূমিটি নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ২০০১ সালের দিকে এলজিইডি সড়কটি পাকাকরণ করলে ছয় শহীদের কবর স্থায়ীভাবে সড়কের নিচে চাপা পড়ে যায়। ফলে সংরক্ষণের অভাবে শনাক্ত করার পরও আজও মর্যাদাহীন অবস্থায় পড়ে রয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দা মোসাদ্দেক আলী জানান, ১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞের সাক্ষী হয়ে আছে নগরগ্রামের বধ্যভূমি। সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে এটি। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ধরে রাখতে সরকারিভাবে দ্রুত বধ্যভূমিটি সংরক্ষণ ও স্মৃতিসৌধ নির্মাণের দাবি জানান তিনি।
উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, মাদারগঞ্জের একমাত্র বধ্যভূমি নগর গ্রামে। ৫৪ বছরেও এটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। শহীদদের কবরের ওপর দিয়ে রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। এটি জাতির জন্য খুবই লজ্জার বিষয়। দ্রুত বধ্যভূমি চিহ্নিত করে সীমানাপ্রাচীর দিয়ে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করলে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস নতুন প্রজন্ম জানতে পারবে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুমন চৌধুরী জানান, তিনি সদ্য এ উপজেলায় যোগদান করেছেন এবং নগর গ্রামের বধ্যভূমি বিষয়ে অবগত নন। তবে তিনি স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও প্রবীণদের সঙ্গে কথা বলে বধ্যভূমির সীমানা চিহ্নিত করে তা সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগ্রহণের কথা জানান।

