হঠাৎ করেই আবার চাপে পড়তে শুরু করেছে দেশের ব্যাংকব্যবস্থা। চলতি অর্থবছরের শুরুতে সরকার যেখানে ব্যাংক থেকে নেওয়া আগের ঋণ পরিশোধে মনোযোগী ছিল, সেখানে কয়েক মাসের ব্যবধানে পরিস্থিতি পুরোপুরি পাল্টে গেছে। অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে এসে সরকারের ব্যাংকঋণ নেওয়ার গতি দ্রুত বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জুলাই থেকে ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে সরকার ব্যাংকগুলো থেকে ৪৫ হাজার ২৩৯ কোটি টাকা নিট ঋণ নিয়েছে, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৫৮ দশমিক ৪৬ শতাংশ বেশি। আগের অর্থবছরের একই সময়ে সরকারের ব্যাংকঋণ ছিল ২৮ হাজার ৫৪৯ কোটি টাকা। যদিও চলতি অর্থবছরের ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত সরকারের ব্যাংকঋণ ৫০৩ কোটি টাকা কমেছিল।
খাতসংশ্লিষ্টদের মতে, অর্থবছরের শুরুর দিকে সরকার উন্নয়ন ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়েছিল। পাশাপাশি রাজস্ব আয়ের ভালো প্রবৃদ্ধি এবং বিদেশি ঋণপ্রাপ্তির কারণে প্রাথমিকভাবে সরকারের ঋণের চাহিদা কম ছিল। তবে বর্তমানে উন্নয়ন ব্যয়ের গতি বৃদ্ধি, নতুন ব্যাংকের বিনিয়োগ, নির্বাচনি ব্যয় এবং ভর্তুকি ও সুদ পরিশোধের দায় বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার প্রবণতা আবার বেড়েছে। এতে একদিকে সরকারের তাৎক্ষণিক অর্থ সংস্থানের চাপ কিছুটা কমছে, অন্যদিকে ব্যাংক খাতে তারল্য পরিস্থিতি ও বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত অর্থবছরের ৩০ জুন শেষে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সরকারের মোট ঋণের পুঞ্জীভূত স্থিতি ছিল চার লাখ ৫২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে চার লাখ ৭৫ হাজার ৭০৯ কোটি টাকায়। ফলে অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাস ১২ দিনে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার পরিমাণ বেড়েছে ২৩ হাজার ২২৮ কোটি টাকা। যদিও গত অর্থবছরের একই সময়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে সরকারের নিট ঋণের পরিমাণ ছিল ৬৫ হাজার ৯৯৫ কোটি টাকা।
অন্যদিকে, গত অর্থবছরের ৩০ জুন শেষে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নেওয়া সরকারের ঋণের স্থিতি ছিল ৯৮ হাজার ৪২৩ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের
৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত বেড়ে হয়েছে এক লাখ ২০ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা। ফলে এ সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ বেড়েছে ২২ হাজার ১১ কোটি টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সরকার ৩৭ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা ঋণ ফেরত দিয়েছিল। সব মিলিয়ে ব্যাংক খাত থেকে সরকারের মোট ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে পাঁচ লাখ ৯৬ হাজার ১৪৪ কোটি টাকা।
বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার প্রতিবছরই বড় অঙ্কের ঋণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণের লক্ষ্যমাত্রা কমানো হয়েছে। এবার ব্যাংকব্যবস্থা থেকে সরকারের ঋণ লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এক লাখ চার হাজার কোটি টাকা এবং সঞ্চয়পত্র থেকে ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
গত অর্থবছরের মূল বাজেটে ব্যাংক থেকে এক লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ৯৯ হাজার কোটি টাকা করা হয়। একই অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। বর্তমানে সরকার যেভাবে ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে, তাতে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার নিচেই থাকবে বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে সরকার ব্যাংক থেকে নিট ৭২ হাজার ৩৭২ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল, যা গত চার অর্থবছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এটি ওই অর্থবছরের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২৬ হাজার ৬২৮ কোটি টাকা কম। মূলত আগের মতো এখন আর উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে না। ফলে সরকারের ঋণের চাহিদাও তুলনামূলকভাবে কম। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক বর্তমানে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে প্রধান অগ্রাধিকার দিচ্ছে।
কয়েকটি ব্যাংকের আর্থিক দুরবস্থা এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক কার্যক্রম কিছুটা সীমিত থাকায় ব্যাংক খাতে এমনিতেই তারল্য সংকট রয়েছে। পাশাপাশি বিনিয়োগ চাহিদাও কম। গত অক্টোবর পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৬ দশমিক ২৩ শতাংশ, যা সাম্প্রতিক যেকোনো বছরের তুলনায় কম।
আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন


কাদেরসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল