আমার দেশ জনপ্রিয় বাংলা নিউজ পেপার

আওয়ামী সুবিধাভোগী জয় গ্রুপকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ সুবিধা

রোহান রাজিব

আওয়ামী সুবিধাভোগী জয় গ্রুপকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ সুবিধা

কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলা চেয়ারম্যান হয়েছিলেন মজিবর রহমান শামীম। গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর তিনি চরমোনাই পীরের দলে যোগ দেন। গত সরকারের সময়ে মজিবরের মালিকানাধীন জয় গ্রুপ একাধিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিলেও সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তা পরিশোধ করেনি। এ কারণে ট্রাস্ট ব্যাংক গ্রুপটিকে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসেবে ঘোষণা করে।

তবুও রাজনৈতিক কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের জন্য প্রণীত নীতির ব্যাখ্যা ব্যবহার করে বাংলাদেশ ব্যাংক জয় গ্রুপকে বিশেষ এক্সিট সুবিধা দিয়েছে—যা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ, জয় গ্রুপ আগের সরকারের আমলেই সুবিধাভোগী ছিল। অভিযোগ রয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর জাকির হোসেন চৌধুরীর চাপেই এই সুবিধা দেওয়া হয়েছে। যদিও তিনি অভিযোগটি অস্বীকার করেছেন।

বিজ্ঞাপন

ব্যাংকগুলোর তথ্য অনুযায়ী, জয় গ্রুপের আটটি প্রতিষ্ঠানের নামে চারটি ব্যাংকে মোট ঋণ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৫১৭ কোটি টাকা, যার পুরোটাই খেলাপি। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকে চারটি প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ রয়েছে ২৫০ কোটি ৮২ লাখ টাকা। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকে দুটি প্রতিষ্ঠানের ঋণ ১০৯ কোটি টাকা। এছাড়া ট্রাস্ট ব্যাংকে তিনটি প্রতিষ্ঠানের ঋণ ৯৮ কোটি এবং পদ্মা ব্যাংকে দুটি প্রতিষ্ঠানের নামে ৫৮ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে।

জানা গেছে, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ব্যবসা করতে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বা ডলারের মূল্য বৃদ্ধির কারণে সংকটে পড়েছে—এমন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করতে বাংলাদেশ ব্যাংক বিশেষ ব্যবস্থায় ঋণ পুনঃতফসিল ও এক্সিট সুবিধা দেওয়ার উদ্যোগ নেয়। এ সুবিধায় ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানগুলো মাত্র দুই শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে পারবে। ঋণের মেয়াদ হবে সর্বোচ্চ ১০ বছর। নিয়মিত হলে শুরুতে দুই বছর কিস্তি পরিশোধে বিরতির সুবিধা মিলবে।

এছাড়া কোনো ঋণগ্রহীতা চাইলে এক্সিট সুবিধাও নিতে পারবে। এ ক্ষেত্রে চার বছরের জন্য এক্সিট সুবিধা দেওয়া হবে, যা আগে ছিল তিন বছর। তবে ঋণ ত্রৈমাসিক কিস্তিতে পরিশোধ করতে হবে এবং বার্ষিক পরিশোধের পরিমাণ বকেয়া ঋণের কমপক্ষে ২০ শতাংশ হতে হবে। আগে এক্সিট সুবিধা নিলেও পুরো ঋণ পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত ঋণগ্রহীতা খেলাপি হিসেবেই গণ্য হতেন। নতুন ব্যবস্থায় এই সুবিধা নিলে তাকে আর খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা হবে না। তবে ব্যাংক কর্তৃক চূড়ান্তভাবে ঘোষিত ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতারা এই সুবিধা পাওয়ার কথা নয়।

কিন্তু জয় গ্রুপের ক্ষেত্রে চিত্র দেখা গেছে ভিন্ন। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আগের সরকারের সময়ে জয় গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মজিবর রহমান শামীম একাধিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে খেলাপিতে পরিণত হন। সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তিনি এসব ঋণ পরিশোধ করেননি। সম্প্রতি ট্রাস্ট ব্যাংক জয় গ্রুপকে ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঘোষণা করে। এরপরও আগের আমলে সুবিধাভোগী হওয়া এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর আপত্তি থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ব্যাংক গ্রুপটিকে ‘ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী’ হিসেবে নীতিগত সহায়তার আওতায় এনে এক্সিট সুবিধা দেয়।

ব্যাংক কর্মকর্তারা জানান, এর আগেও জয় গ্রুপকে পুনঃতফসিল সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। ব্যবসার অবস্থা ও ক্যাশ ফ্লো বিবেচনায় সে সময় এই পুনঃতফসিল অনুমোদন করা হয়। কিন্তু ঋণ পরিশোধের সময় এলে গ্রুপটি অর্থ দেয়নি। এবারও ব্যাংকগুলো নতুন করে সুবিধা দিতে অনাগ্রহী

থাকলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশে তা কার্যকর করতে বাধ্য হচ্ছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী জয় গ্রুপ এখনো অর্থ পরিশোধে গড়িমসি করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

গত ২১ ডিসেম্বর ব্যাংকগুলোকে পাঠানো এক চিঠিতে বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, চার শতাংশ ডাউন পেমেন্ট নিয়ে চার বছরের এক্সিট সুবিধা বাস্তবায়ন করতে হবে। এর মধ্যে দুই শতাংশ ডাউন পেমেন্ট ছয় মাস পর পরিশোধের সুযোগ রাখা হয়েছে। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ক্ষেত্রে চাইলে পুনঃতফসিল সুবিধা দেওয়ার কথাও উল্লেখ করা হয়।

এ বিষয়ে ট্রাস্ট ব্যাংকের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লাহ আল ইউসুফ আমার দেশকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী চারটি ভিত্তিতে কাউকে ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঘোষণা করা যায়। সেগুলো হলো—সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ঋণ বা সুদ পরিশোধ না করা; জালিয়াতি, প্রতারণা বা মিথ্যা তথ্য দিয়ে ঋণ গ্রহণ; নির্ধারিত উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য কাজে ঋণ ব্যবহার এবং ব্যাংকের লিখিত অনুমোদন ছাড়া জামানত হস্তান্তর বা স্থানান্তর করা।

তিনি আরো বলেন, জয় গ্রুপের ক্ষেত্রে এই চারটি শর্তই প্রমাণিত হওয়ায় তাদের ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঘোষণা করা হয়েছে। ইচ্ছাকৃত খেলাপির তালিকা থেকে নাম না কাটা পর্যন্ত কোনো নীতিগত সহায়তা কার্যকর হওয়ার সুযোগ নেই।

ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওমর ফারুক খান বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে একটি চিঠি পাওয়া গেছে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান আমার দেশকে বলেন, ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের নিয়ম অনুযায়ী এই সুবিধা পাওয়ার কথা নয়। যদি এর ব্যত্যয় ঘটে থাকে, তাহলে বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ডেপুটি গভর্নর জাকির হোসেন চৌধুরী তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ প্রসঙ্গে জানান, যেসব বিভাগ থেকে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, সেখানে তার কোনো দায়িত্ব নেই। সুতরাং তার সুপারিশে কোনো সুবিধা দেওয়ার প্রশ্নই আসে না।

Google News Icon

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন