রাজধানীর মোহাম্মদপুরের শাহজাহান রোডের একটি আবাসিক ভবনের সপ্তম তলার ফ্ল্যাট থেকে মা–মেয়ের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে নতুন করে নিয়োগ পাওয়া এক গৃহকর্মীর সম্পৃক্ততা থাকতে পারে বলে সন্দেহ করছেন তদন্তসংশ্লিষ্টরা। সোমবার সকালে হত্যাকান্ড ঘটে।
পুলিশ জানায়, নিহত গৃহিণী লায়লা আফরোজ (৪৮) ও তার একমাত্র কিশোরী মেয়ে নাফিসা বিনতে আজিজ (১৫) দীর্ঘদিন ধরে ওই ফ্ল্যাটে বসবাস করছিলেন। পরিবারের কর্তা আজিজুল ইসলাম, যিনি উত্তরার একটি স্কুলের শিক্ষক; প্রতিদিনের মতো সকালে কর্মস্থল যান। স্কুলের পরীক্ষা শেষ হলে বাসায় ফিরে দরজা খোলা দেখতে পান। ভেতরে ঢুকে ড্রইং রুমে তিনি স্ত্রী ও মেয়েকে গুরুতর আহত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন। প্রতিবেশীদের সহায়তায় দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হলেও চিকিৎসক নাফিসাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে পুলিশ এসে লায়লার লাশ উদ্ধার করে। তাদের গ্রামের বাড়ি নাটোর জেলায়। শাহজাহান রোডে রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের বিপরীত পাশের আবাসিক ভবনের সপ্তম তলায় থাকতেন তারা।
একাধিক সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে পুলিশ জানায়-সকাল ৭টা ৫১ মিনিটে বোরকা পরিহিত এক তরুণীকে ভবনে ঢুকতে দেখা যায়। আয়েশা নামের এই মেয়েকে চার দিন আগে গৃহকর্মী হিসেবে কাজে রাখা হয়েছিল। সকাল ৯টা ৩৬ মিনিটে একই নারীকে স্কুলড্রেস পরে বেরিয়ে যেতে দেখা যায়, যা ছিল নিহত নাফিসার ইউনিফর্ম। নিহত নাফিসা মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। তার কাঁধে একটি ব্যাগও ছিল, মুখে ছিল মাস্ক। গেট দিয়ে বের হওয়ার সময় নিরাপত্তাকর্মী তাকে চিনতে পারেননি।
ঘটনাস্থলের বিবরণ দিয়ে তদন্ত সংশ্লিষ্ট সুত্র জানা, বাড়ির প্রবেশদ্বারের সামনে এবং ভেতরের কয়েকটি স্থানে রক্তের দাগ রয়েছে, আসবাবপত্র এলোমেলো। আলমারি ও ব্যাগপত্র তছনছ পাওয়া গেছে। বাসায় ধস্তাধস্তির আলামত দেখা গেছে। তদন্তকারীরা ধারণা করছেন, হত্যাকাণ্ডের পর বাথরুম ব্যবহার করা হয়েছে। বাথরুমের বালতি থেকে দুটি ধারালো ছুরি উদ্ধার করা হয়েছে, যা ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, গৃহিনী লায়লা আফরোজকে হত্যার পর মেয়ে নাফিসা আহত অবস্থায় সম্ভবত ইন্টারকমে সিকিউরিটি গার্ডকে ফোন করতে চেয়েছিল। কিন্তু সেখানে গিয়ে ইন্টারকমের লাইনটি খোলা পাওয়ায় তা হয়ে ওঠেনি। মনে হচ্ছে, কাজের মেয়েটি ঠান্ডা মাথায় খুন করে বাথরুমে গিয়ে শরীরে লাগা রক্ত ধুয়ে নিহত স্কুল ছাত্রী নাফিসার স্কুলের ড্রেস পরে গেট দিয়ে চলে যায়।
গৃহকর্তা আজিজুল ইসলাম জানান, চার দিন আগে দারোয়ানের মাধ্যমে কাজের সন্ধানে আসা তরুণীকে তার স্ত্রী সাক্ষাৎকার নিয়ে কাজে রেখেছিলেন। মেয়েটি জানিয়েছিল-পরিবার নেই, আত্মীয়দের সঙ্গে থাকে এবং আগে অন্য বাসায় কাজ করত। তবে পরিচয় যাচাইয়ের মতো কোনো কাগজপত্র তার কাছে ছিল না। তবে নাম শুনেছি আয়েশা। আয়েশা তাদেরকে জানিয়েছিল, তার গ্রামের বাড়ি রংপুর, জেনিভা ক্যাম্পে চাচা-চাচির সঙ্গে থাকেন। বাবা-মা আগুনে পুড়ে মারা গেছে, তার শরীরেও আগুনে পোড়ার ক্ষত রয়েছে বলে জানিয়েছিল। স্থায়ী গৃহকর্মী না হওয়ায় তার কোনো কাগজপত্র রাখা হয়নি বলে জানান আজিজুল।
ঘটনার পর ভবনের নিরাপত্তাকর্মী খালেককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ হেফাজতে নিয়েছে। তিনি জানান, ঘটনার দিন সকালে বোরকা পরে আসায় তিনি স্বাভাবিকভাবেই মেয়েটিকে ফ্ল্যাটে ঢুকতে দেন। পরে স্কুলড্রেস পরে বের হওয়ার সময় মাস্ক পরার কারণে তাকে ঠিকমতো চিনতে পারেননি।
তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার ইবনে মিজান আমার দেশকে বলেন, ‘ফুটেজে একজনেরই আসা–যাওয়া দেখা গেছে। তার গতিবিধি এবং সময় মিলিয়ে তদন্ত এগোচ্ছি। পলাতক গৃহকর্মীকে শনাক্ত ও গ্রেপ্তারের জন্য বিশেষ টিম কাজ করছে।’ কাজ করছে ডিবি পুলিশের টিমও। তিনি আরও জানান, হত্যার উদ্দেশ্য ও বাসা থেকে কিছু হারিয়ে গেছে কি না-তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
মা–মেয়ের মরদেহ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে। পুলিশ বলছে, তদন্তের অগ্রগতি অনুযায়ী ঘটনার পেছনে অন্য কারও সম্পৃক্ততা আছে কি না-তা স্পষ্ট হবে। মূর ফোকাস এখন পলাতক গৃহকর্মীকে আটক করা।

