বিচারহীনতা ও দমননীতি থেকে উত্তরণে গুম কমিশনের দুই সুপারিশ

আবু সুফিয়ান
প্রকাশ : ১৬ জুন ২০২৫, ১৮: ৩০

বাংলাদেশের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার বর্তমান চিত্র ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবিরোধী নীতির কার্যকারিতা নিয়ে সাম্প্রতিক এক মধ্যবর্তী প্রতিবেদনে অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশ্যে দুটি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ তুলে ধরেছে গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন।

বিজ্ঞাপন

সম্প্রতি জমা দেয়া তাদের প্রতিবেদনে, একদিনে অতীতের ভুল সংশোধনের আহ্বান জানানো হয়েছে, অন্যদিকে ভবিষ্যতের জন্য একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও পুনর্বাসনভিত্তিক কৌশল গঠনের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

গুম-সংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। গত ৪ জুন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে এই প্রতিবেদন জমা দেয় কমিশন। সোমবার প্রতিবেদনটির কয়েকটি অধ্যায় সাংবাদিকদের জন্য অবমুক্ত করা হয়।

প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, বাংলাদেশে বর্তমানে হাজার হাজার সাজানো সন্ত্রাসবিরোধী মামলার নিষ্পত্তিতে চরম বিলম্ব হচ্ছে। এ মামলাগুলোর অনেকটিই জুড়ে রয়েছে এমনসব ব্যক্তিদের, যারা এক সময় গোপনে গুম বা হেফাজতে নির্যাতনের শিকার হন, পরে ‘পুনরুদ্ধার’ হওয়ার পর দেখেন, তাদের বিরুদ্ধে অতীতের ঘটনাকে কেন্দ্র করে মামলা ঝুলছে—প্রকৃতপক্ষে তারা সেই সময় রাষ্ট্রীয় হেফাজতে ছিলেন। এমনকি, অনেক ব্যক্তিকে কেবল মতাদর্শিক অবস্থান বা রাজনৈতিক সম্পর্কের কারণে মিথ্যা মামলায় জড়ানো হয়েছে।

২০০৯ সালের সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ৩৩ ধারায় বলা হয়েছে, মামলার বিচার এক বছরের মধ্যে শেষ করতে হবে। কিন্তু বাস্তবে এসব মামলা বছরের পর বছর ধরে চলমান এবং আইন অনুযায়ী বিচার বিলম্বে কোনো দায় বা জবাবদিহিতা নির্ধারিত নেই। এতে করে অনেক নির্দোষ ব্যক্তি ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কারাগারে আটক রয়েছেন—যা সংবিধানের ৩৫(৩) অনুচ্ছেদের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

প্রতিবেদনটি এ অবস্থার নিরসনে সুপারিশ করেছে, যদি এক বছরের মধ্যে মামলার নিষ্পত্তি না হয়, তাহলে সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনাল বাধ্য থাকবে মামলা বাতিল ও আসামিকে মুক্তি দেওয়ার নির্দেশ দিতে। একই সঙ্গে ট্রাইব্যুনালগুলোর ওপর দ্রুত বিচার সম্পন্নের চাপ বাড়ানো, বিচারকদের কাঠামোগত বাস্তবতা সম্পর্কে সংবেদনশীল করা, এবং দীর্ঘসূত্রতা রোধে বিচারিক সংস্কারের আহ্বান জানানো হয়েছে।

‘সিকিউরিটি-স্টেট’ মডেল নয়, সমাজভিত্তিক পুনর্বাসন:

প্রতিবেদনের দ্বিতীয় সুপারিশটি ভবিষ্যতের জন্য। এখানে তাগিদ দেওয়া হয়েছে—বাংলাদেশ যেন কেবল একটি নিরাপত্তাভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গিতে না থেমে গিয়ে চরমপন্থা মোকাবেলায় একটি পূর্ণাঙ্গ, পুনর্বাসনকেন্দ্রিক কৌশল গ্রহণ করে।

বেশ কয়েকজন নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের মতামতের ভিত্তিতে প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে ‘আমেরিকান’ সামরিকীকৃত নিরাপত্তা মডেল অনুসরণ করেছে—যেখানে গোপন আটক, জোরপূর্বক জিজ্ঞাসাবাদ ও বিরোধী দমনকে ‘সন্ত্রাসবিরোধী’ লড়াইয়ের অংশ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। বাস্তবে, যুক্তরাজ্য-অনুপ্রাণিত ভাষণ ব্যবহার করে চরমপন্থা রুখতে সামাজিক অংশগ্রহণের কথা বলা হলেও, বাস্তবনীতিতে গৃহীত হয়েছে দমন-পীড়ন ও অভিযানের কৌশল।

এই বৈপরীত্য কেবল সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতাকেই ক্ষুণ্ন করে না, বরং জাতীয় নিরাপত্তাকেও হুমকির মুখে ফেলে।

প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে, বাংলাদেশের উচিত সমাজভিত্তিক পুনর্বাসন কাঠামো তৈরি করা, যা ধর্মীয় শিক্ষার যথাযথ ব্যাখ্যা, মানসিক পরামর্শ, পরিবারভিত্তিক হস্তক্ষেপ এবং কারিগরি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে চরমপন্থা থেকে মুক্তি নিশ্চিত করতে পারে। বিশেষভাবে পূর্বে চরমপন্থায় যুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ব্যবহার করে সহিংস মতাদর্শের ‘ইনসাইড ক্রিটিক’ তৈরির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার মতো দেশে যে মডেলগুলো সফল হয়েছে—যেমন ধর্মীয় সংলাপ, সম্প্রদায়ভিত্তিক জড়িতকরণ এবং দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসন—সেগুলোকে অনুসরণ করার আহ্বান জানানো হয়েছে, তবে যান্ত্রিক অনুকরণে নয়,বরং স্থানীয় প্রেক্ষাপটে উপযোগী করে প্রয়োগ করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

বিষয়:

গুমকমিশন
এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত