রাজধানীর কল্যাণপুরের কথিত ‘জাহাজবাড়ী’ জঙ্গি অভিযানে একযোগে বিপরীতমুখী দুটি বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। একদিকে ওই ঘটনায় সাবেক পুলিশপ্রধানসহ শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা চলছে; অপরদিকে একই ঘটনায় আট তরুণের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেছে ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনাল। এতে জনমনে প্রশ্ন উঠেছেÑ এক ঘটনায় রাষ্ট্র দুটি ভিন্ন অবস্থান নিল কেন?
২০১৬ সালের ২৫ জুলাই কল্যাণপুরের পাঁচ নম্বর সড়কে ‘জাহাজবাড়ী’ নামে পরিচিত ভবনে পুলিশের কথিত জঙ্গি দমন অভিযানে ৯ তরুণ নিহত হন। পুলিশ তখন দাবি করেছিল গোপন সংবাদের ভিত্তিতে ওই ভবনে অভিযান চালিয়ে সন্ত্রাসীদের গুলি করে হত্যা করা হয়। তবে অভিযানে কোনো পুলিশ সদস্য আহত না হওয়া এবং নিহতদের হাতে ফল কাটার ছুরি থাকার বিষয়টি সামনে আসায় শুরু থেকেই এ নিয়ে তৈরি হয় ব্যাপক সন্দেহ ও বিতর্ক।
আমার দেশ-এ প্রকাশিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ‘ডিবি থেকে নিয়ে ৯ তরুণ খুন’-এ এসব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে পুলিশের গোপন অপারেশন ও সাজানো নাটকের বিষয়টি উঠে আসে। ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পর ২০২৫ সালের ২৪ মার্চ সাবেক আইজিপি একেএম শহীদুল হক, সাবেক ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া এবং সাবেক এসপি জসিম উদ্দিন মোল্লাকে আসামি করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা করা হয়। ওই মামলায় তাদের গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে হাজিরও করা হয়েছিল। বর্তমানে তারা কারাগারে আছেন।
তবে একই ঘটনায় সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের পদক্ষেপে বিস্মিত আইনজীবীরা। গত ৭ এপ্রিল ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের বিচারক আবদুল হালিম আট অভিযুক্তের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। এই বিচারক এর আগে চট্টগ্রামের সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালে কর্মরত ছিলেন।
অভিযুক্ত আসামি শরিফুল ইসলাম ও হাদিসুর রহমানের পক্ষে শুনানিতে অংশ নেন অ্যাডভোকেট সুব্রত দেব রানা। তিনি বলেন, ‘চার্জশিটে যেসব সাজানো তথ্য ছিল, হুবহু তা রেখেই অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। অথচ রাষ্ট্রপক্ষই বলছে ঘটনাটি সাজানো এবং এর দায়ে পুলিশ কর্মকর্তারা অভিযুক্ত।’
রাকিবুল হাসান নামে এক অভিযুক্ত চার্জ গঠন শুনানির সময় বিচারককে বলেন, তাকে গুম করার পর জাহাজবাড়ীতে নিয়ে চোখ বাঁধা অবস্থায় গুলি করা হয়।
শরিফুল ইসলামের আইনজীবীরা আদালতে বলেন, চার্জশিটে কোথাও শরিফুলের নাম নেই। এমনকি জব্দ করা অস্ত্রের ব্যালিস্টিক রিপোর্টেও দেখা গেছেÑ চারটি পিস্তলের কোনোটিতেই গুলি ছোড়ার প্রমাণ মেলেনি। অথচ পুলিশ দাবি করেছে, অভিযুক্তরা পুলিশের ওপর গুলি চালিয়েছে।
আইনজীবীদের এসব যুক্তির পরও বিচারক অব্যাহতির আবেদন নাকচ করে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ৬(২) ধারায় অভিযোগ গঠন করেন। শুনানিকালে বিচারক আদালতের স্ক্রিনে ২০১৬ সালের পুরোনো সংবাদ প্রচার করতে বলেন। কিন্তু আমার দেশ-এর সাম্প্রতিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রদর্শনের অনুরোধ অগ্রাহ্য করেন।
আইনজীবী অ্যাডভোকেট সুব্রত রানা অভিযোগ করে বলেন, ‘এই বিচারক আগেই ঠিক করে রেখেছিলেনÑ কাউকে অব্যাহতি দেওয়া হবে না। এ যেন আবারও ওয়ার অন টেররের নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘অভিযুক্তদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও জোরপূর্বক এবং ভিত্তিহীন।’
নিহতদের পরিবারের সদস্যরাও বিচারব্যবস্থার ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সাতক্ষীরার তরুণ মতিউর রহমানের বাবা নাসির উদ্দিন জানান, ‘ছেলেকে গুম করার পর জাহাজবাড়ীতে হত্যা করে বেওয়ারিশ লাশ ঘোষণা করে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের মাধ্যমে দাফন করা হয়। জানাজাও করতে পারিনি। আমার ছেলে জঙ্গি ছিল না। শুধু ইসলামী আদর্শের কথা বলত। এ অপরাধে কি তাকে মরতে হলো?’
দুটি ভিন্ন আদালতে একই ঘটনার বিপরীতমুখী বিচারিক পদক্ষেপে এখন জনমনে প্রশ্নÑ তাহলে প্রকৃত অপরাধী কে?
একদিকে রাষ্ট্র বলছে পুলিশের কিছু শীর্ষ কর্মকর্তা পরিকল্পিতভাবে ৯ তরুণকে হত্যা করেছে, অন্যদিকে ওই হত্যার নাটকেই আবার তরুণদেরই আসামি বানিয়ে বিচার শুরু করেছে আরেকটি আদালত।
আইনজ্ঞরা বলছেন, এক রাষ্ট্রে এক ঘটনায় এমন দ্বিমুখী বিচারীয় ব্যবস্থা আইনের পরিপন্থী এবং ন্যায়বিচারের জন্য হুমকিস্বরূপ।

