ইউরোপের দেশ ডেনমার্কে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চশিক্ষার দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়ার শঙ্কার মধ্যেই নতুন করে দেশের পোশাক শিল্প নিয়ে শুরু হয়েছে নেতিবাচক প্রচারণা। সম্প্রতি ডেনমার্কের একটি টিভিতে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের অতি নিম্ন মজুরি, নিম্নমানের পরিবেশ এবং কল-কারখানা থেকে নির্গত বিষাক্ত কেমিক্যালের মাধ্যমে পরিবেশ দূষণের চরম নেতিবাচক চিত্র তুলে ধরা হয়। ‘টিভি ২ প্লে’-তে প্রচারিত দুই পর্বের ওই ডকুমেন্টারিতে বাংলাদেশের প্রায় শতাধিক কারখানায় তৈরি পোশাকের বড় ক্রেতা ও ইউরোপের বৃহত্তম ফ্যাশন ব্র্যান্ড ‘বেস্টসেলার’ কোম্পানিরও কঠোর সমালোচনা করা হয়।
এর আগে, ব্যাপকসংখ্যক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির অভিযোগে ডেনমার্কের রসকিল্ড ইউনিভার্সিটির বিভাগীয় প্রধানের পদত্যাগের পর দেশটির সংসদ ও বাইরে ক্ষমতাসীন সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ব্যাপক সমালোচনার পাশাপাশি শিক্ষামন্ত্রীরও পদত্যাগের দাবি জানানো হয়। একই অভিযোগে ২০২৬ সাল থেকে রসকিল্ড ইউনিভার্সিটির বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অ্যান্ড লিডারশিপ বিভাগের মাস্টার্স প্রোগ্রামে ভর্তিসহ পুরো কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়। তাছাড়া বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ও ভিসা প্রক্রিয়াতে আরো কঠোরতা আরোপের ঘোষণার পাশাপাশি ইমিগ্রেশনসহ তিন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর পদেও রাতারাতি পরিবর্তন করা হয়। এসব ঘটনায় গত দুই সপ্তাহ ধরে ডেনমার্কের গণমাধ্যমগুলোতে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ ইস্যু।
পোশাকশিল্প নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা : ‘টিভি ২ প্লে’-তে প্রচারিত দুই পর্বের ওই ডকুমেন্টারিতে উল্লেখ করা হয়, বেস্টসেলার ডেনমার্কের এমন একটি বৃহত্তম ফ্যাশন কোম্পানি যারা ‘সবুজ প্রতিশ্রুতি’ দিয়ে বাজারে ক্রেতাদের কাছে তাদের পোশাক বাজারজাত করলেও বাস্তবে কি তারা তাদের প্রতিশ্রুতি রাখে? ‘বেস্টসেলার’ এর ‘সবুজ প্রতিশ্রুতি’র বাস্তব চিত্র তদন্ত করতে বাংলাদেশের যেসব পোশাক কারখানা থেকে তারা পোশাক তৈরি ও ক্রয় করে থাকে টিভি ২ সরেজমিন এসবের তদন্ত করতে গিয়ে সবুজ প্রতিশ্রুতির পরিবর্তে কারখানার ব্যাপক পরিবেশ দূষণ, শ্রমিকদের নিম্ন মজুরি, সহিংসতা, নির্যাতনসহ বিভিন্ন অনিয়মের তথ্য পায়। পরে সংগৃহীত তথ্য ও চিত্রের মাধ্যমে ‘বেস্টসেলার অন দ্যা রঙ সাইট : ডু দ্যা কিপ দেয়ার গ্রিন প্রোমিজ’ শিরোনামে ৪৫ মিনিটের দৈর্ঘ্যের সিজন-১ এর এপিসোড-১ এবং ‘বেস্টসেলার অন দ্যা ইনসাইড : ভায়োলেন্স, অ্যাবিউজ অ্যান্ড লো পে’ শিরোনামে ৪৪ মিনিট দৈর্ঘ্যের এপিসোড-২ শীর্ষক দুই পর্বের দুইটি ডকুমেন্টারি প্রচার করে।
এপিসোড-১ এ বেস্টসেলার যে ‘গ্রীণ প্রতিশ্রুতি’ দিয়েছিল সেটা কীভাবে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে তার চিত্র তুলে ধরা হয় এবং এসব কারখানায় কীভাবে পরিবেশ দূষিত হয় সেই চিত্র তুলে ধরা হয়। দ্বিতীয় পর্বে কারখানাগুলোর অভ্যন্তরীণ নিম্ন মানের পরিবেশ, শ্রমিকদের অতি নিম্ন মজুরি প্রদান এবং কীভাবে সহিংসতা এবং নির্যাতন করা হয় সেটা তুলে ধরা হয়।
এদিকে, ফ্যাশন কোম্পানি বেস্টসেলার তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে টিভি ২ তে প্রচারিত ডকুমেন্টারির সব তথ্য সঠিক নয় এবং তারা কারখানা ও শ্রমিকদের পরিবেশ উন্নত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে বলে জানিয়েছে। এতে আরো বলা হয়, অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি, তারা প্রতি বছর বাংলাদেশের পোশাক কারখানায় কর্মপরিবেশ সম্পর্কিত প্রায় ৩৫০টি সমস্যা চিহ্নিত করে যার বেশিরভাগ সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে।
বাংলাদেশিদের জন্য উচ্চশিক্ষার দরজা বন্ধের শঙ্কা
অন্যদিকে ডেনমার্কের অন্যতম পাবলিক রসকিল্ড ইউনিভার্সিটির বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অ্যান্ড লিডারশিপ বিভাগের মাস্টার্স প্রোগ্রামে ব্যাপক হারে বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছে ওই বিভাগের বিভাগীয় প্রধান কার্স্টেন টফট বোয়েসেন। তার জায়গায় স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে নতুন সভাপতিকে। অভিযোগ রয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়টির অর্থনৈতিক অবস্থাকে শক্তিশালী করার জন্যই মূলত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের অধিকহারে ভর্তি করানো হয়েছিল এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতেই মূলত তিনি পদত্যাগ করেন। শিক্ষামন্ত্রীর কাছে পাঠানো পদত্যাগপত্রে তিনি উল্লেখ করেন, আমি যেই প্রতিষ্ঠানে দায়িত্বে রয়েছি যার বিরুদ্ধে ব্যাপক ও ধারাবাহিক সমালোচনা হচ্ছে যার সামগ্রিক দায়িত্ব আমার নিজের উপরেই বর্তায়। সেজন্য আমি উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা মন্ত্রীকে জানিয়েছি সেপ্টেম্বর মাসের শেষ অবধি আমি পদত্যাগ করবো।
এছাড়া ইউনিভার্সিটি অফ সাউদার্ন ডেনমার্ক (এসডিইউ) তাদের এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে বিস্ফোরক বৃদ্ধি হিসেবে উল্লেখ করেছে। যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০২০ সালে যেখানে মাত্র ৬৬ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছিল বাংলাদেশ থেকে, ২০২৪ সালে সেই সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৯৭ জনে। এটাকেও তারা উদ্বেগজনক হিসেবে উল্লেখ করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য অফিসিয়াল চুক্তির মাধ্যমে কাজ করে থাকে দেশটির শিক্ষা ও গবেষণা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর নিজস্ব কনসালটেন্সি এজেন্সি ‘এজেন্সি ফর হায়ার এডুকেশন অ্যান্ড সায়েন্স। এই এজেন্সির কার্যক্রমের ব্যাপক সমালোচনা করে ডেনমার্কের ইমিগ্রেশন বিরোধী দল হিসেবে পরিচিত ড্যানিশ পিপলস পার্টি। দলটির ইমিগ্রেশন মুখপাত্র মাইকেল বন গণমাধ্যমকে জানায়, রসকিল্ড ইউনিভার্সিটির ‘ভর্তি কেলেঙ্কারি’র ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রী ক্রিস্টিনা এগেলুন্ড ও তার মন্ত্রণালয় আর কিছুই অবশিষ্ট রাখেনি। অবিলম্বে তার পদত্যাগ করা উচিত।
এর আগে, ২০২৪ সালের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে রসকিল্ড ইউনিভার্সিটির প্রতি ৬ জন শিক্ষার্থীর ১ জন বাংলাদেশি যা ২০২০ সালে ছিল প্রতি ৯ জনে ১ জন।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ডেনমার্কে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এ কে এম শহীদুল করিম বলেন, বাংলাদেশি পোশাক কারখানা নিয়ে সম্প্রতি ডেনমার্কের একটি টিভিতে যে ডকুমেন্টারি প্রচারিত হয়েছে সেটি আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। আমরা সংশ্লিষ্ট ড্যানিশ কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছি। তাদেরকে জানিয়েছি যে প্রতিবেদনটির তথ্য সঠিক নয়। এছাড়া শিক্ষার্থীদের বিষয়টি নিয়েও আমরা কাজ করছি। দুই দেশের পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নে আমাদের যোগাযোগ অব্যাহত রয়েছে।
রসকিল্ড ইউনিভার্সিটির সাবেক শিক্ষার্থী রুশনান বিনতে আমিন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়টি তাদের বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অ্যান্ড লিডারশিপ প্রোগ্রাম বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়ার আগে সঠিক তথ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের আত্মপক্ষ সমর্থন করার সুযোগ দেয়নি। সরকারের তড়িৎ প্রতিক্রিয়া রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত করা হয়েছে, যা একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর ছাত্রদের আলাদা করে বৈষম্য করাকে গ্রহণযোগ্য বলে মনে করা হয়েছে।
তিনি বলেন, এই সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা দেশ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের বিরুদ্ধে কিছু না করেও শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

