গত দেড় দশকের বেশি সময় সময় ধরে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সবগুলো নিয়েই ছিল নানা প্রশ্ন। গণঅভ্যুত্থানের প্রায় দেড় বছর পর আগামী ফেব্রুয়ারির ১২ তারিখ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন।
নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর রাজনৈতিক দল ও ইচ্ছুক প্রার্থীদের ভোটে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। যে কারণে এই নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ও ভোটারদের মধ্যে আগ্রহ দেখা যাচ্ছে।
তবে বাংলাদেশের সংবিধান ও নির্বাচনের আইন অনুযায়ী, দেশের সব নাগরিক যেমন নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন না, তেমনি ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রেও সবাই ভোট দেওয়ার যোগ্য নন।
সংবিধানে বলা আছে, নির্বাচনে অংশ নিতে হলে কোনো ব্যক্তিকে বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে এবং তার বয়স ২৫ বছর পূর্ণ হতে হবে। তবে, আইন ও সংবিধানের ধারা অনুযায়ী প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে বেশ কিছু বিধি-নিষেধও রয়েছে।
এর আগে সংবিধান অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী সংসদ সদস্যরা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার যোগ্য হলেও বুধবার নির্বাচন কমিশনার আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেছেন, এবারের নির্বাচনে যারা সরকারের পদে রয়েছেন তারা স্বপদে থেকে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না।
অন্যদিকে, আদালত ঘোষিত ফেরারি বা পলাতক আসামি এখন থেকে কোনো নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না।
প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতা-অযোগ্যতা কী কী
নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতার বিষয় নিয়ে বাংলাদেশের সংবিধান ও গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ বা আরপিওতে বেশ কয়েকটি ধারা রয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানে বলা হয়েছে, নির্বাচনে প্রার্থী হতে হলে তাকে বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে এবং তার বয়স ২৫ বছর পূর্ণ হতে হবে।
তবে, শুধু ২৫ বছর বয়স হলেই যে তিনি নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন বিষয়টি একেবারেই এমন না। নির্বাচনে প্রার্থী হতে হলে আরো কিছু বিধি নিষেধ মানতে হবে।
সংবিধান ছাড়াও ১৯৭২ সালের গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ১২ ধারাতেও সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতা সম্পর্কে বলা হয়েছে। এই ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি প্রার্থী হতে পারবেন না যদি তিনি সরকারি কোনো লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত থাকেন।
দুর্নীতির কারণে কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে বরখাস্ত বা অপসারিত বা বাধ্যতামূলক অবসরপ্রাপ্ত না হন এবং এই ঘটনার পর যদি পাঁচ বছর অতিবাহিত না হয়, তাহলেও তিনি নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না।
সরকারি চাকরিজীবীদের ক্ষেত্রে- সামরিক ও সরকারি চাকরি থেকে পদত্যাগ বা অবসর গ্রহণ করলে পদত্যাগ বা অবসরের পর তিন বছর পার না হলে তিনি সংসদ সদস্য পদে প্রার্থী হতে পারবেন না। সরকার বা সরকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ক্ষেত্রেও একই শর্ত প্রযোজ্য হবে।
এ নিয়ে আরো পড়তে পারেন
কোনো ব্যক্তি সরকারের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্কে জড়িত থাকলে তিনি সংসদ সদস্য পদে লড়তে পারবেন না। এছাড়া, বিদেশি কোনো রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠান থেকে অনুদান বা তহবিল গ্রহণ করে এমন কোনেও বেসরকারি সংস্থার কার্যনির্বাহী পদে কর্মরত থাকলে বা এই পদ থেকে পদত্যাগ বা অবসরের পর তিন বছর পার না হলে তিনি প্রার্থী হতে পারবেন না।
অন্যদিকে, ঋণগ্রস্ত, ঋণের জামিনদার ও বিভিন্ন সেবা খাত অর্থাৎ টেলিফোন, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি বা সরকারের সেবাদানকারী কোনো সংস্থার বিল খেলাপি হলে তিনিও নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না।
নির্বাচন কমিশনের সাবেক অতিরিক্ত সচিব ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ জেসমিন টুলী বলেন, নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে অযোগ্যতার এই বিষয়গুলো আগে থেকেই সংবিধান ও আরপিওতে যুক্ত ছিল। এসব শর্ত যারা ভঙ্গ করবেন তারা নির্বাচনে প্রার্থী হলেও তার প্রার্থিতা বাতিল করতে পারবে নির্বাচন কমিশন।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর বর্তমান নির্বাচন কমিশন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ বা আরপিওতে বেশ কিছু ধারায় পরিবর্তন এনেছে। সেখানে প্রার্থী হওয়ার অযোগ্যতার ক্ষেত্রে আরো কিছু বিধি-নিষেধ যুক্ত করা হয়েছে।
সংশোধিত আরপিও অনুযায়ী, আদালত ঘোষিত ফেরারি বা পলাতক আসামি এখন থেকে কোনো নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না। এছাড়া সংশ্লিষ্ট নির্বাচনি এলাকার কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি বা অন্য কোনো পদে অধিষ্ঠিত থাকলেও তিনি প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য হবেন।
সব নাগরিক কী ভোট দিতে পারবেন
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে গত ১৮ নভেম্বর চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন। ঘোষিত তালিকা অনুযায়ী বর্তমানে দেশে ভোটার সংখ্যা ১২ কোটি ৭৬ লাখ ৯৫ হাজার ১৮৩ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ছয় কোটি ৪৮ লাখ ১৪ হাজার ৯০৭ জন, আর নারী ভোটার ছয় কোটি ২৮ লাখ ৭৯ হাজার ৪২ জন। আর হিজড়া পরিচয়ে ভোটার আছেন এক হাজার ২৩৪ জন।
নিয়ম অনুযায়ী, ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সী যে কেউ বাংলাদেশের নাগরিক ভোটার হতে পারবেন এবং যাদের নাম ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত আছে, তারা সবাই ভোট দিতে পারেন।
এমনকি কারাগারে বন্দি ব্যক্তিরাও পোস্টাল ব্যালটে ভোট দেওয়ার সুযোগ পাবেন।
ভোটার তালিকা আইন অনুযায়ী, কিছু নির্দিষ্ট কারণে একজন নাগরিক ভোটাধিকার হারান বা তার নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ যেতে পারে।
এর মধ্যে রয়েছে- যদি উপযুক্ত আদালত কর্তৃক যদি কোনো ব্যক্তিকে অপ্রকৃতিস্থ বা মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন ঘোষণা করা হয়, তাহলে তিনি ভোট দেওয়ার অধিকার হারাবেন।
দেউলিয়া ঘোষিত হওয়ার পর যদি কেউ দায় থেকে অব্যাহতি লাভ না করেন তিনিও ভোট দিতে পারবেন না।
যদি বাংলাদেশের কোনো নাগরিক স্বেচ্ছায় অন্য কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জন করেন বা কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন, তবে তিনি বাংলাদেশের ভোটার হিসেবে অযোগ্য বলে গণ্য হবেন।
গত বছরের জুলাই অগাস্টের মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় আইসিটি আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে বিচার চলছে।
ভোটার তালিকা আইনের ১৩ এর ঘ ধারা অনুযায়ী- ভোটার তালিকা থেকে নাম কর্তন সম্পর্কে বলা হয়েছে, কেউ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের অধীনে কোনো অপরাধে অপরাধী সাব্যস্ত হলে ভোটার তালিকা থেকে তার নাম বাদ পড়বে।
গত ১৭ই নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছে।
একই অপরাধে মামলার অন্য আসামি সাবেক পুলিশপ্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনকে দেওয়া হয় পাঁচ বছরের কারাদণ্ড।
আইন অনুযায়ী, দণ্ডপ্রাপ্তদের আগামী ১৭ই ডিসেম্বরের মধ্যে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবে। এই সময়ের মধ্যে আপিল না করলে তাদের নামও ভোটার তালিকা থেকে বাদ যাবে।
নির্বাচন বিশ্লেষক জেসমিন টুলী বলেন, "যদি কেউ বাংলাদেশের নাগরিকত্ব হারায়, উপযুক্ত আদালত কর্তৃক কাউকে অপ্রকৃতস্থ ঘোষণা করা হয় বা ট্রাইব্যুনাল আইনে দণ্ডিত হয় তাহলে তার নাম থেকে কর্তন হয়ে যাবে"।
তিনি বলছিলেন, এসব ব্যক্তিরা একদিকে যেমন ভোট দেওয়ার যোগ্য হবেন না তেমনি তারা নির্বাচনেও প্রার্থী হতে পারবেন না।
দ্বৈত নাগরিকদের ক্ষেত্রে আলাদা নিয়ম
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে প্রথম বারের মতো ভোট দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন প্রবাসী বাংলাদেশি ভোটাররা। এরই মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশি ভোটাররা অনলাইনে ভোটার নিবন্ধন করছেন। পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে ভোট দিতে পারবেন তারা।
তবে, ভোটাধিকার ও প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে দ্বৈত বা বিদেশি নাগরিকদের ক্ষেত্রে দুই ধরনের নিয়ম রয়েছে বাংলাদেশের আইনে। বাংলাদেশের সংবিধান ও নির্বাচনী আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশের দ্বৈত নাগরিকরা জাতীয় নির্বাচনে ভোট দিতে পারেন যদি ভোটার তালিকায় তার নাম থাকে এবং তিনি যদি বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ না করে।
তবে, দ্বৈত নাগরিকরা ভোট দেওয়ার যোগ্য হলেও বাংলাদেশের যে কোনো নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য হবেন। সাম্প্রতিক বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দ্বৈত নাগরিকত্বের কারণে কয়েকজন প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিলও করেছিল নির্বাচন কমিশন।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য জেসমিন টুলী বলেন, বাংলাদেশের নাগরিকদের দ্বৈত নাগরিকত্ব থাকলে ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে বাধা নিষেধ নেই। তবে দ্বৈত নাগরিকরা সংবিধান ও আইন অনুযায়ী নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না"।
সাবেক এই নির্বাচন কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশের কোনো নাগরিক যদি স্বেচ্ছায় অন্য কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জন করেন বা কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন, তবে তিনি বাংলাদেশের ভোটার হিসেবে অযোগ্য বলে গণ্য হবেন।
সূত্র: বিবিসি বাংলা

