পুলিশের ডিআইজি (উপমহাপরিদর্শক) পদে পদোন্নতির জন্য ৩৪ জন কর্মকর্তার ব্যাপারে সুপারিশ করেছে সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড (এসএসবি)। গত বৃহস্পতিবার রাতে অনুষ্ঠিত এসএসবির সভায় এ সুপারিশ চূড়ান্ত করা হয়। তবে পদোন্নতির এ তালিকা প্রকাশ হওয়ার পর থেকেই পুলিশ প্রশাসনে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করছে।
অভিযোগ উঠেছে, বিগত সরকারের সময়ে সুবিধাভোগী ও বিতর্কিত কর্মকর্তাদের এ তালিকায় প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, অন্যদিকে বঞ্চিত করা হয়েছে ২১তম ব্যাচের দীর্ঘদিনের বঞ্চিত, যোগ্য ও মেধাবী কর্মকর্তাদের।
জানা গেছে, সুপারিশ করা ৩৪ জনের মধ্যে ২৭ জনই ২০তম ব্যাচের কর্মকর্তা। বাকি সাতজন ১৫ ও ১৭তম ব্যাচের। অভিযোগ রয়েছে, ২০তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের অনেকেই বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে বিরোধী দল দমনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন।
বঞ্চিত ও ক্ষুব্ধ কর্মকর্তাদের দাবি, ২০তম ব্যাচের কর্মকর্তারা বিগত সরকারের সময়ে নজিরবিহীন সুবিধা ভোগ করেছেন। ২০১১ সালে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে ১৫, ১৭, ১৮ ব্যাচের দুই শতাধিক কর্মকর্তাকে ডিঙিয়ে তারা এসপি (পুলিশ সুপার) হয়েছিলেন। ২০২২ সালের জুনের মধ্যে তাদের অনেকেই সিনিয়রদের টপকে অতিরিক্ত ডিআইজি ও ডিআইজি পদে আসীন হন।
অভিযোগ রয়েছে, ব্যাচটির অনেক কর্মকর্তাই ডিবি হারুন হিসেবে পরিচিত ডিআইজি হারুন অর রশিদ, আনিস, বিপ্লব ও মোল্ল্যা নজরুলদের মতো বিতর্কিত পুলিশ কর্মকর্তাদের সহযোগী হিসেবে কাজ করেছেন এবং ‘পুলিশ লীগ’ প্রতিষ্ঠায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ডিআইজি পদে পদোন্নতির জন্য ২০তম ব্যাচের পাশাপাশি ২১তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের নামও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব করা হয়েছিল। কয়েক মাস আগে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ১০৩ জন কর্মকর্তার নাম পাঠানো হয়। পরে ২১তম ব্যাচের বেশ কয়েকজন মেধাবী ও বিগত সময়ে নিগৃহীত কর্মকর্তাকে বিবেচনায় নিয়ে মোট ৪৯ জনের একটি সম্পূরক প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল। এর মধ্যে ২১তম ব্যাচে এমন কর্মকর্তাও রয়েছেন, যারা আওয়ামী আমলে কোনো ধরনের প্রমোশন পাননি। তারা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হয়েই চাকরি করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
শুধু তা-ই নয়, শাস্তিমূলক বদলিস্বরূপ কিছুদিন পরপর তাদের ঢাকার বাইরে বিভিন্ন ডাম্পিং স্থানে পোস্টিং দেওয়া হতো। নিয়মিত ছুটি পেতেন না পরিবার-পরিজনের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্যও। অথচ তাদের মুজিববাদী ব্যাচমেটরা সে সময় পুলিশের অন্যতম নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় ছিলো। সেই বঞ্চিত, মজলুম কর্মকর্তাদের বাদ দিয়ে গত ২০ নভেম্বর মাত্র দুই ঘণ্টার নোটিসে তড়িঘড়ি করে এসএসবি সভা ডেকে ২০তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের নাম সুপারিশ করা হয়। এর মধ্যে বিতর্কিত ও ফ্যাসিস্টের সুবিধাভোগী কর্মকর্তাদের নাম থাকায় পুলিশের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে। জানা গেছে, ২১তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ভেরিফিকেশন সম্পন্ন হয়েছিল এবং এনএসআই (NSI) ভেটিংও শেষ পর্যায়ে ছিল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সামনে জাতীয় নির্বাচন। এমন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বিগত ‘ফ্যাসিস্ট’ সরকারের দোসর হিসেবে পরিচিত কর্মকর্তাদের ডিআইজি পদে বসানো নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নষ্ট করার একটি নীলনকশা হতে পারে।
তারা আরো বলেন, সুপারিশপ্রাপ্ত ২০তম ব্যাচের অন্তত ২৩ জন কর্মকর্তা বিগত সরকারের আমলে বিভিন্ন জেলার এসপি, ডিএমপি ও মেট্রোপলিটন শহরের ডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাদের বিরুদ্ধে বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর দমন-পীড়ন চালানো এবং তৎকালীন প্রভাবশালী পুলিশ কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম ও হাবিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ থাকার অভিযোগ রয়েছে। কেউ কেউ বিগত সরকারের গুণগান গেয়ে কবিতা-গান লিখেও তোষামোদ করেছেন।
বঞ্চিতদের দাবি, সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হওয়ার পরও ২১তম ব্যাচকে বাদ দেওয়া উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এ সুপারিশের ফলে পুলিশ প্রশাসনে চেইন অব কমান্ড এবং অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা নিয়ে নতুন করে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। তাই বর্তমান তালিকা বাতিল করে ২১তম ব্যাচের যোগ্য, মেধাবী এবং বিগত সময়ে বঞ্চিত কর্মকর্তাদের অন্তর্ভুক্ত করে নতুন করে সুপারিশ করা হোক।
এ বিষয়ে গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনি এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এহছানুল হকের মোবাইলে যোগাযোগ করলেও সাড়া পাওয়া যায়নি। ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েও কোনো উত্তর মেলেনি।

