বাংলাদেশে সাংবাদিকতার বড় বাধা এলিটিজম: মাহমুদুর রহমান

স্টাফ রিপোর্টার
প্রকাশ : ৩১ জুলাই ২০২৫, ১৬: ১৮
আপডেট : ৩১ জুলাই ২০২৫, ২০: ৪৯

আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক ড. মাহমুদুর রহমান বলেছেন, এলিটিজম (যে শ্রেণি সমাজে নিজেদের বিশেষভাবে প্রভাবশালী মনে করে) বাংলাদেশে সাংবাদিকতার বড় বাধা। তিনি বলেছেন, যতদিন না আমরা সকল সাংবাদিক ও সম্পাদককে এক নজরে দেখতে না পারব ততদিন পর্যন্ত আমাদের মুক্তি নাই।

বৃহস্পতিবার রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে ঐতিহাসিক জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন। সভার আয়োজন করে জাতীয় প্রেসক্লাব।।

বিজ্ঞাপন

মাহমুদুর রহমান বলেন, বাংলাদেশে বর্ণবাদের মতো পত্রিকার সম্পাদকদের শ্রেণি বিভাগ আছে। একদল হলেন- এলিট সম্পাদক, আরেকদল হলো নমঃশূদ্র সম্পাদক। আজকে আমি ধন্য- যে পাঁচজনের নাম বললেন তার মধ্য ব্রাহ্মণ সম্পাদক আছে আবার নমঃশূদ্রও আছে। বাংলাদেশের সাংবাদিকতার মধ্যে দুইটা ব্রাহ্মণ প্রতিষ্ঠান আছে। একটা হলো সম্পাদক পরিষদ; আরেকটা হলো নোয়াব। আমি যাকে বলি নবাব। সম্পাদক পরিষদ ও নোয়াবের সদস্য আমরা যারা নই, তারা আমরা নমঃশূদ্র সম্পাদক। এলিট সম্পাদক না হলে নোয়াব ও সম্পাদক পরিষদের সদস্য হওয়া যায় না। আজকে দুই গ্রুপই এখানে আছে দেখে ভাল লাগছে।

এলিট সম্পাদকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, কয়েক বছর আগে নিউ এইজের সম্পাদক নূরুল কবীরের বিরুদ্ধে ডিজিএফআই নানা রকম ঝামেলা করছিলো; তখন মানবজমিনের সম্পাদক মতিউর রহমান আমাকে ফোন দিয়েছিলো একটা বিবৃতিতে স্বাক্ষর দেওয়ার জন্য। তখন আমি বলেছিলাম- রাজপুত্রের (সজীব ওয়াজেদ) দুর্নীতি নিয়ে একটা নিউজ করেছিলাম। এরপর আমার সহকর্মী আব্দুল্লাহর ওপর হামলা হয়েছে, আমার গাড়িতে তেজগাঁও সাতরাস্তা এলাকায় হাতুড়ি দিয়ে ভেঙে ফেলেছিল, আমাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছিল।

পরে আমি মতিউর রহমান ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম- আমার ওপর ও আমার সহকর্মীর ওপর আক্রমণ হলো- আপনারা তো কোনো বিবৃতি দেন নাই- আমি আবার প্রশ্ন করলাম, এই বিবৃতিতে আব্দুল্লাহর নাম থাকবে কি? তিনি বললেন না- এটা শুধু নূরুল কবীরের নাম থাকবে, পরে আমরা আব্দুল্লাহর নাম দিবো। আমি অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানাচ্ছি, এটাতে সই করা আমার পক্ষে সম্ভব না।

এই বিষয় নিয়ে নূরুল কবীর সাহেব খুব অসন্তুষ্ট ছিলেন। আমি যখন জেলে ছিলাম তখন নূরুল কবীর সাহেব দুই একটি টেলিভিশনে টকশোতে বলেছিলো আমার বিরুদ্ধে যখন অত্যাচার হয়েছে তখন মাহমুদুর রহমান বিবৃতিতে স্বাক্ষর করে নাই। এটা অস্পূর্ণ অসত্য বলেছিলেন। ওইখানে আব্দুল্লার নাম না থাকায় আমি স্বাক্ষর করি নাই। বাংলাদেশে সাংবাদিকতার বড় সমস্যা এলিটিজম। যতদিন না আমরা সকল সাংবাদিক ও সম্পাদককে এক নজরে দেখতে না পারব ততদিন পর্যন্ত আমাদের মুক্তি নাই।

আমার দেশ পত্রিকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের লড়াই বাংলাদেশের গণতন্ত্রের পক্ষে, আমার দেশের লড়াই মানবাধিকারের পক্ষে, আমাদের লড়াই ছিলো ভারতীয় হেজিমনির বিরুদ্ধে। আমাদের এই লড়াইয়ে বিএনপি কখনো বলে নাই জামায়াত কখনো বলে নাই এভাবে পত্রিকা চলতে হবে। আমি নিজের তাড়না থেকে পত্রিকা চালিয়েছি। তাতে করে লাভবান হয়েছে তৎকালীন বিরোধী দল অর্থাৎ বিএনপি ও জামায়াত।

মাহমুদুর রহমান বলেন, বেগম খালেদা জিয়া বিভিন্ন জনসভায় আমার দেশ পত্রিকা নিয়ে যেতো। জনসভায় পত্রিকা উঁচু করা দেখাতো আজকে আমার দেশে কি লিখেছে। আমি বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি কৃতজ্ঞ। তখন আমাদের চিহ্নিত করত বিএনপিপন্থি, সুতরাং মাহমুদুর রহমানের উপর নির্যাতন করা জায়েজ। চিহ্নিত করার মাধ্যমে নির্যাতন করা সহজ হতো; কারণ মাহমুদুর রহমানের ওপর নির্যাতন করলে কোনো সাংবাদিক সংগঠন ও সম্পাদক বিবৃতি দিবে না। এটা ছিলো সাংবাদিকতার বাস্তব অবস্থা। এটা ভুলে গেলে চলবে না। এখন আমাদের চিহ্নিত করছে ইসলামপন্থি, দক্ষিণপন্থি হিসেবে।

এটা করা হচ্ছে- ভবিষ্যতে যেন আমাদের উপর আবারো নির্যাতন করা যায়। কারণ ব্র্যান্ডিং না করলে আপনি জুলুম চালাতে পারবেন না। এতে আমি খুব আশ্চর্য হই না। কারণ বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো সমালোচনা সহ্য করতে পারে না। এনসিপির অন্তঃকোন্দল নিয়ে নিউজ হয়েছে আমার দেশ পত্রিকায়। তারা সেই নিউজ নিয়ে মন্তব্য করেছে, মজলুম যখন জালিম। এরপর বিএনপির ইশরাকের যখন আন্দোলন চলছিলো তখন আমাদের নিউজ ইশরাক ও বিএনপির পছন্দ হয়নি।

ইশরাক তখন তার ফেসবুকে লিখেছে, আমার দেশ পত্রিকা একটি গার্বেজ। আমার দেশ চালু না হওয়াই ভালো ছিল। এটা হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর অসহিষ্ণুতা। এর থেকে বের হয়ে আসতে না পারলে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আসবে না।

জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে আমার বিরুদ্ধে মামলা করেছে ৭১ টিভির মালিক। মামলা কেন করতে পারলো আপনি জানেন কারণ, তারা জানে তার এত টাকা আছে সে মনে করে সে সব দলকে কিনতে পারবে। আমরা বিভিন্নভাবে খবর পেয়েছি বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি সবার সাথে ৭১ টিভির মালিকের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। এইভাবেই বাংলাদেশ চলবে। যাদের হাতে টাকা থাকবে তারাই সব করবে। এটাই আমাদের দুর্ভাগ্য।

তিনি আরও বলেন, আমার বিরুদ্ধে এই মুহূর্তে ১৭টা ওয়ারেন্ট আছে। পুলিশ চাইলে যে কোনো সময় আমাকে গ্রেপ্তার করতে পারবে। কারণ আমার বিরুদ্ধে এখনো ১২৫টা মামলা চলমান রয়েছে। পরবর্তীতে যারা ক্ষমতায় আসবে তাদের ভবিষ্যতে মনে হয় কোনো মামলা দিতে হবে না। এই ১৭ মামলা দিয়ে আমাকে ঘায়েল করতে পারবে।

আমার দেশ পত্রিকার ভবিষ্যতে নিয়ে তিনি বলেন, আমার দেশের ভবিষ্যৎ কেমন হবে সেটা মোটামুটি আমি জানি। একটা পত্রিকাকে চাপে ফেলতে প্রথমে তারা বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেবে। মন্ত্রী মহোদয় বলতে হবে না, খালি সিগন্যাল দিলেই হবে যে সরকারের সঙ্গে "আমার দেশের" সম্পর্ক ভালো না। ২০০৮ থেকে ২০১৩ সালে আমরা সরকারি-বেসরকারি কোনো বিজ্ঞাপন পাইনি। এখনো পাই না, কারণ আপনারা জানলে অবাক হবেন, বেসরকারি বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রণ করে আওয়ামী লীগের প্রেতাত্মাদের কোম্পানির নাম এশিয়াটিক। কোম্পানির মালিক সাবেক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। তার কোম্পানি যেমন আওয়ামী লীগের সময় ক্ষমতাবান ছিল এখনো ক্ষমতাবান আগামীতেও ক্ষমতাবান থাকবে। তাদের কিছুই করতে পারবে না এটাই বাস্তবতা।

সম্পাদকদের দুই শ্রেণির উদ্দেশে তিনি বলেন, ব্রাহ্মণরা ব্রাহ্মণই থাকবে-নমঃশূদ্ররা নমঃশূদ্রই থাকবে। যতদিন না আমরা একটি শক্তিশালী বিপ্লব করতে না পারব। সত্যিকার অর্থে আমরা এখনো সেই বিপ্লব করতে পারি নাই।

তিনি বলেন, গত কয়েকদিন আগে প্রেস কাউন্সিলের তালিকা বের হয়েছে- সেখানে যে সম্পাদকের নাম রয়েছে সবগুলো ব্রাহ্মণ সম্পাদক। সেখানে কোনো নমঃশূদ্র সম্পাদক নাই। আজকে আমাদের যে পাঁচজন সম্পাদককে ডাকা হয়েছে, তার মধ্যে দুইজন আমরা নমঃশূদ্র সাংবাদিক। আমি ও আসাদ ভাই। কারণ আমরা ইসলামিক কথা বলি; বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অপরাধ যারা ইসলামিস্ট কথা বলে। আবুল আসাদ ভাই এই বয়সে যে পরিমাণ নিগৃহীত হয়েছেন তার জন্য কয়জন সম্পাদক কথা বলেছে।

বাংলাদেশের সাংবাদিকতার সমস্যা তুলে ধরে তিনি বলেন, সাংবাদিকরা জানে ক্ষমতার সাথে কিভাবে থাকতে হয়। সুবিধার জন্য। আমার দেশ কখনো পারে নাই ভবিষ্যতেও পারবে না। এখন বিএনপির মিটিংয়ে মাঝে মাঝে দেখি যেসব সাংবাদিকরা কথা বলে তাদের বিগত ১৫ বছরে অবস্থান কী ছিলো। বাংলাদেশের সাংবাদিকতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এখনো আসে নাই ভবিষ্যতে আসবে কিনা আমি সন্দিহান। যদি আমরা ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে আদর্শের ভিত্তিতে ইউনাইটেড হতে পারি, তখন সংবাদপত্র স্বাধীন হবে, তার আগে নয়।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত