সরকার-বিএনপি মুখোমুখি

বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশ : ৩০ অক্টোবর ২০২৫, ০৯: ১৩

স্বাক্ষরিত জুলাই জাতীয় সনদকে পাশ কাটিয়ে সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি। দলটির অভিযোগ, সনদে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকলেও বাস্তবায়নের সুপারিশে তা বাদ দেওয়া হয়েছে। প্রস্তাবিত সংবিধান সংস্কার পরিষদের সমালোচনা করে দলটির অভিযোগ, আইয়ুব খানের বেসিক ডেমোক্রেসি ও ইয়াহিয়া খানের ‘লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার’ অনুসরণে এটা করা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

গণভোটের সময়কাল নিয়েও বিএনপি আপত্তির কথা জানিয়েছে। বাস্তবায়নের সুপারিশে তীব্র আপত্তি তুলে বিএনপি বলেছে, দু-একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলকে সুবিধা দিতে জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। কমিশন রেফারির ভূমিকায় থেকে নিজেই গোল দিয়ে দিয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকারেরও কঠোর সমালোচনা করেছে বিএনপি। অন্তর্বর্তী সরকারকে উদ্দেশ্য করে দলটি বলেছে, সত্যিকার অর্থেই যেটুকু সংস্কার দরকার, তা সম্পন্ন করে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিতে হবে। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে পার্লামেন্ট আসবে, সে পার্লামেন্ট দেশের সংকটগুলো সমাধান করবে। এর থেকে বাইরে গেলে সরকারকেই তার দায়দায়িত্ব বহন করতে হবে।

বিএনপির অভিযোগের বিষয়গুলো নিয়ে সরকারের তরফ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি। উপদেষ্টা পরিষদে আলোচনার পর এ বিষয়ে সরকার তার অবস্থান জানাবে বলে জানা গেছে। এদিকে ঐকমত্য কমিশন বলেছে, তারা সরকারকে সুপারিশ দিয়েছে। এটি গ্রহণ করা বা না করার এখতিয়ার সরকারের। এছাড়া জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জোটভুক্ত দলের প্রতীকে ভোট করার বিধানটি বাদ দেওয়া নিয়েও বিএনপির ঘোরতর আপত্তি রয়েছে। সব মিলিয়ে লন্ডন বৈঠকে অন্তর্বর্তী সরকার ও দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির মধ্যে একটা বোঝাপড়ার সম্পর্ক তৈরি হলেও নতুন করে সেই অবস্থানের পরিবর্তন হয়েছে। নির্বাচনের চূড়ান্ত প্রস্তুতির সময়কালে এসে সরকার ও বিএনপি অনেকটাই মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়েছে।

সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার এই মুখোমুখি অবস্থানকে দেশের ভবিষ্যতের জন্য অশনিসংকেত বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক প্রফেসর এম মাহবুব উল্লাহ। তিনি বলেন, নিজেদের অনৈক্যের পথ ধরে ফ্যাসিস্ট শক্তির পুনর্বাসনের পথ তৈরি হতে পারে। ভুল বোঝাবুঝি দূর করে রাজনৈতিক দল ও সরকারকে ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনের পথে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।

রাষ্ট্র সংস্কার বিষয়ক জাতীয় জুলাই সনদ গত ১৭ অক্টোবর স্বাক্ষরিত হয়। এনসিপি ছাড়া জুলাই আন্দোলনের পক্ষের প্রায় সব দলই এই সনদে স্বাক্ষর করেছে। এছাড়া ঐকমত্য কমিশনের পক্ষে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনূসসহ কমিশনের সদস্যরা এতে সই করেন। সনদ সইয়ের পর এর বাস্তবায়ন নিয়ে সুপারিশ তৈরি করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। গত মঙ্গলবার ‘জাতীয় জুলাই সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়নে আদেশ’ শিরোনামে সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দিয়েছে ঐকমত্য কমিশন। এতে ৮৫টি সংস্কার বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়। এর মধ্যে ৯টি নির্বাহী আদেশে। ২৮টি আইন প্রণয়ন/সংশোধন (অধ্যাদেশ জারি) করে এবং সংবিধান সম্পর্কিত বাকি ৪৮টি বাস্তবায়নে দুটি বিকল্প প্রস্তাব দেওয়া হয়। পাশাপাশি আদেশের প্রশ্নে গণভোট ও আগামী জাতীয় সংসদে দ্বৈত ভূমিকা (সংবিধান সংস্কার পরিষদ ও জাতীয় সংসদ) পালনের ক্ষমতা দেওয়ার সুপারিশ করা হয়।

স্বাক্ষরিত জুলাই জাতীয় সনদে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপিসহ কয়েকটি দলের ভিন্ন ভিন্ন ইস্যুতে নোট অব ডিসেন্ট থাকলেও বাস্তবায়নের সুপারিশে তা রাখা হয়নি। জানা গেছে, সংবিধান সম্পর্কিত ৪৮টি প্রস্তাবের ২৬টির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে। জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপির একটি করে নোট অব ডিসেন্ট থাকলেও বিএনপির বেশ কয়েকটি ইস্যুতে নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে। বিএনপির নোট অব ডিসেন্টের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—উচ্চকক্ষে পিআর, প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধান একই ব্যক্তি না থাকা, চারটি সাংবিধানিক পদ অর্থাৎ, দুর্নীতি দমন কমিশন, সরকারি কর্ম কমিশন, ন্যায়পাল এবং মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের নিয়োগ স্পিকারের মাধ্যমে নিয়োগ, সংবিধান সংশোধনে উচ্চকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন, আপিল বিভাগের জেষ্ঠতম ব্যক্তিকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ।

সনদ বাস্তবায়ন সুপারিশে গণভোটের সুপারিশ করা হলেও এর দিনক্ষণ সরকারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। সরকার চাইলে নির্বাচনের আগে অথবা নির্বাচনের দিন গণভোট আয়োজন করতে পারবে। বিএনপি চাচ্ছে ভোটের দিন, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি নির্বাচনের আগে। এক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামী সুনির্দিষ্টভাবে নভেম্বর মাসে গণভোট চেয়েছে। নভেম্বরে গণভোট আদায়ে দলটি এরই মধ্যে রাজপথে কর্মসূচিও ঘোষণা করেছে।

বাস্তবায়ন প্রস্তাবে নোট অব ডিসেন্ট না থাকার কারণ উল্লেখ করে মঙ্গলবার প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, তারা সরকারকে বলেছেন এগুলো জনগণের কাছে নিয়ে যেতে। জনগণের রায় পাওয়ার পর রাজনৈতিক দল সিদ্ধান্ত নেবে।

নোট অব ডিসেন্টের বিষয়টি বাস্তবায়ন সুপারিশে উল্লেখ না থাকায় জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপিসহ অন্য দলগুলো খুব একটা প্রতিক্রিয়া না দেখালেও তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছে বিএনপি। প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পরপরই ‘নোট অব ডিসেন্টের’ বিষয়গুলো না থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, কমিশন সুপারিশের মাধ্যমে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার বদলে অনৈক্য তৈরির চেষ্টা করেছে।

গণভোটের বিষয় নিয়ে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একই দিন হবে, এর বাইরে যাওয়ার ‘কোনো সুযোগ নেই’। জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট বিষয়ে বিএনপি ‘একমত’ নয়। গতকালও বিএনপির ক্ষোভ অব্যাহত ছিল। গতকাল পৃথক দুটি কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং দলটির পক্ষে সংস্কার কমিশনের বৈঠকে অংশ নেওয়া প্রতিনিধিদলের প্রধান সালাহউদ্দিন আহমেদ বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন। মঙ্গলবার রাতে অনুষ্ঠিত দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ নিয়ে আপত্তি তোলা হয়েছে।

গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক অনুষ্ঠানে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়েছে। এটা ঐক্য হতে পারে না। তাহলে এই কমিশন কেন করা হয়েছিল? তিনি বললেন, জনগণের সঙ্গে এটা একটা প্রতারণা। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এটা প্রতারণা।

নোট অব ডিসেন্টগুলো পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, যে বিষয়গুলোতে তারা একমত ছিলেন না, সেখানে তারা নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছিলেন। তা কমিশনের সুপারিশে লিপিবদ্ধ করার একটা প্রতিশ্রুতি ছিল। কিন্তু অবাক হয়ে তারা লক্ষ করলেন, সুপারিশে সেই বিষয়গুলো নেই। ইগনোর করা হয়েছে। এটা তো ঐক্য হতে পারে না।

এ মুহূর্তে এই অন্তর্বর্তীকালের সময়টা ঐক্যের সময় বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখানে ন্যূনতম বিষয়গুলোয় একমত হয়ে একটা রাস্তা ধরা, একটা ট্র্যাক ধরা—সেই জায়গাটাকে বিভক্ত করে ফেলা হচ্ছে। কারা করছেন, কেন করছেন, এটা নিশ্চয়ই সবাই উপলব্ধি করতে পারছেন।

বিএনপি মহাসচিব বলেন, একটি কথা তারা খুব পরিষ্কারভাবে বলতে চান, যা তারা এর আগেও বলেছেন। তারা মনে করেন, সব সংকটের মূলে যে বিষয়টি আছে, তাহলো সত্যিকার একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। সে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগণের যে পার্লামেন্ট তৈরি হবে, সে পার্লামেন্টে এসব সমস্যাকে সংবিধানের মধ্যে নিয়ে আসবেন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা। সেভাবে দেশ চলবে। তারা সে কারণেই ৫ আগস্টের বিপ্লবের পরই নির্বাচনের কথা বলেছিলেন। তখন অনেকে বলেছিল, তারা ক্ষমতা চান, সেজন্য অতিদ্রুত নির্বাচন চাচ্ছেন। আজ প্রমাণিত হচ্ছে, এ নির্বাচনটা যত দেরি হচ্ছে, তত বেশি সে শক্তিগুলো শক্তিশালী হচ্ছে, ফ্যাসিস্ট শক্তিশালী হচ্ছে। যারা বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল দেখতে চায়, এখানে একটা অরাজকতা তৈরি করতে চায়।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করে মির্জা ফখরুল বলেন, আপনি কিন্তু এবার জনগণের সামনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, ওয়াদাবদ্ধ। আপনি এখানে সত্যিকার অর্থেই যেটুকু সংস্কার দরকার, সে সংস্কারগুলো করে আপনি জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য একটা নির্বাচন দেবেন। সে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে পার্লামেন্ট আসবে, সে পার্লামেন্ট এ দেশের সংকটগুলো সমাধান করবে। সুতরাং আজ যদি এর থেকে কোনো ব্যত্যয় ঘটে, এর থেকে বাইরে যদি যান, তার দায়দায়িত্ব সম্পূর্ণ আপনাকেই বহন করতে হবে। এ কথাটা আমি খুব পরিষ্কার করে বলতে চাই।

যা বললেন সালাহউদ্দিন আহমেদ

গতকাল রাজধানীর একটি হোটেলে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ অভিযোগ করেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশে জুলাই সনদের পূর্ণ প্রতিফলন নেই। সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় যে সনদ স্বাক্ষরিত হয়েছে, কমিশনের দেওয়া সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশে তার হুবহু প্রতিফলন নেই।

বাস্তবায়ন সুপারিশে সরকারের সমর্থন রয়েছে এমন দাবি করে তিনি বলেন, গতকাল (মঙ্গলবার) জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে সরকারকে সুপারিশ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে তারা কিছু সত্য আবিষ্কার করতে পেরেছেন। এতদিন তারা মনে করতেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রেফারির ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু তারা যে সুপারিশ দিয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, এর মধ্যে একজন দস্তখতকারী প্রধান উপদেষ্টাও আছেন, যিনি কমিশনের সভাপতি। ফলে এটি সরকারের পক্ষ থেকেও এক ধরনের অনুমোদন বা সমর্থন।

সুপারিশে কিছু দলের প্রস্তাব ও ঐকমত্য কমিশনের চিন্তাভাবনা জাতির ওপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা লক্ষ করেছেন বলে মন্তব্য করেন সালাহউদ্দিন আহমেদ। বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, ‘রেফারিকে আমরা কখনো গোল দিতে দেখিনি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, ঐকমত্য কমিশন, সরকার এবং আরো দু-তিনটি রাজনৈতিক দল একই পক্ষ। আমি বিপক্ষেই খেলছিলাম মনে হয়। সে হিসেবে জাতির পক্ষের দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করেছি।

স্থায়ী কমিটির বৈঠক

মঙ্গলবার রাতে অনুষ্ঠিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করা হয় বলে সূত্রে জানা গেছে। স্থায়ী কমিটি ঐকমত্য কমিশনকে ‘অনৈক্য কমিশন’ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলে বৈঠক সূত্র জানিয়েছে। বৈঠকে বলা হয়, সুপারিশে কমিশন জামায়াত ও এনসিপির কথাই রেখেছে। দুটি দলের এজেন্ডাই প্রতিফলিত হয়েছে। বিএনপি সবচেয়ে বড় স্টেকহোল্ডার হলেও তাদের কোনো কথা রাখা হয়নি।

সাংবিধানিক আদেশ, সাংবিধানিক পরিষদ ও ২৭০ দিনের মধ্যে পাস করার বাধ্যবাধকতারও সমালোচনা হয় বৈঠকে। বলা হয়, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে ইয়াহিয়া খানের এলএফও (লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার) এবং আইয়ুব খানের বেসিক ডেমোক্রেসির অনুকরণে কমিশন এটা করেছে। তারা এলএফও, বেসিক ডেমোক্রেসি—এগুলো বাংলাদেশে আনার চেষ্টা করছে। বিষয়টিকে নির্বাচন অনুষ্ঠান না করার একটি প্রক্রিয়া বলেও অভিযোগ ওঠে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু আমার দেশকে বলেন, বিএনপি সবচেয়ে বড় অংশীজন। বিএনপির যা প্রস্তাবনা, কিছুই রাখা হয়নি। বরং বিএনপি যেগুলো চায়নি, সেগুলোই তারা করছে। ঐকমত্য কমিশন কিন্তু কাজ করেছে অনৈক্য কমিশনের মতো। তিনি আরো বলেন, তারা তো কখনোই নির্বাহী আদেশের পক্ষে নন কিন্তু তারা তাদের ইচ্ছামতো করছে। তাদের ইচ্ছামতো যদিই করবে, তাহলে বিএনপিকে তো না ডাকলেই পারত।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ আমার দেশকে বলেন, বিষয়টি বিএনপির নিজস্ব ব্যাপার। তাদের রাজনৈতিক অবস্থান থাকতে পারে। সে অবস্থান থেকে হয়তো মন্তব্য করেছে।

বিএনপি বলেছে, সনদে নোট অব ডিসেন্টের বিষয়টি থাকলেও বাস্তবায়ন সনদে তা বাদ দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি কেন হয়েছে জানতে চাইলে আলী রীয়াজ কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, আমরা সরকারের কাছে আমাদের সুপারিশ জমা দিয়েছি। এখন সরকার এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। সরকার চাইলে যে কোনো সুপারিশ গ্রহণ করতে পারে। আবার গ্রহণ না-ও করতে পারে।

কমিশনের প্রতিবেদন এবং বিএনপির প্রতিক্রিয়া নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। আমার দেশকে দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে এ মুহূর্তে কথা বলতে চাচ্ছি না। প্রতিবেদন উপদেষ্টা পরিষদে উপস্থাপন করা হবে। সেখান থেকে কোনো সিদ্ধান্ত এলে তখন তা জানাতে পারব।

জুলাই সনদসহ সার্বিক ইস্যুতে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার বিভেদকে দুঃখজনক বলে আখ্যায়িত করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক এম মাহবুব উল্লাহ। আমার দেশকে দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, ‘গত এক বছরে নানা বাধাবিপত্তি ও ষড়যন্ত্র দেখলেও আশাবাদী ছিলাম। কিন্তু কেন যেন গতকাল থেকে হতাশাবোধ করছি। এতদিন মনে হচ্ছিল নির্বাচনটা সময়মতো হবে। এখন কেন যেন নির্বাচনের পথে অনেক সমস্যার আশঙ্কা করছি। বুঝতে পারছি দেশ অনৈক্য ও সংঘাতের পথে যাচ্ছে। এ সংঘাতের পথ ধরে ফ্যাসিস্ট শক্তি আবারও প্রত্যাবর্তনের পথ সুগম হতে পারে।’

এ মুহূর্তে রাজনৈতিক দলগুলো ও অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে নির্বাচনের পথে এগোনো ছাড়া কোনো বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করেন এ শিক্ষাবিদ।

রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোকে একে অপরের বিরুদ্ধে সমালোচনার ক্ষেত্রে সীমারেখা টানছি না। কথা বলার ক্ষেত্রে সবার শালীনতাবোধ ও সৌন্দর্যবোধ থাকা উচিত। কিন্তু সেটাও আমাদের লোপ পাচ্ছে।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার গত বছর ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেওয়ার পর বিএনপিসহ জুলাই আন্দোলনের পক্ষের সব দল ঐক্যবদ্ধভাবে সরকারকে সমর্থন করলেও কিছুদিন যেতে না যেতেই বিএনপি নির্বাচনের দাবিতে সরব হয়ে ওঠে। বিএনপিসহ কয়েকটি দলের অবস্থান ছিল ন্যূনতম সংস্কার করে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হতে হবে। তবে জামায়াত ও এনসিপির অবস্থান ছিল আগে সংস্কার করে নির্বাচন করতে হবে। সংস্কারের স্বার্থে নির্বাচন পেছানো হলে তাদের আপত্তি থাকবে না বলে জানিয়েছিল। দুপক্ষের পাল্টাপাল্টি অবস্থানের প্রেক্ষাপটে ২০২৬ সালের প্রথমার্ধে (৩০ জুনের মধ্যে) নির্বাচন করার ঘোষণা দেয় সরকার। এতে ঘোর আপত্তি তোলে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো। পরে অবশ্য আরো একটু এগিয়ে রোজার পর এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচনের ঘোষণা দেন প্রধান উপদেষ্টা।

তবে বিএনপি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে অনড় থাকে। পরে গত এপ্রিলে প্রধান উপদেষ্টা রাষ্ট্রীয় সফরে লন্ডনে গেলে সেখানে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে রোজার আগে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ভোট অনুষ্ঠানের বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত আসে। একই সঙ্গে সরকারের সংস্কার কার্যক্রম এগিয়ে নিতে বিএনপির সহযোগিতা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। ওই সিদ্ধান্তের বিষয়ে জামায়াত ও এনসিপি প্রথমে আপত্তি জানালেও সংস্কার কার্যক্রম সম্পন্ন হওয়া শর্তে তারা ফেব্রুয়ারিতে ভোটে সম্মতি জানায়। এরপর থেকে সংস্কার কার্যক্রম স্বাভাবিক গতিতে এগিয়ে গেলেও সর্বশেষ সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের সুপারিশ নিয়ে নতুন করে জটিলতা তৈরি হলো।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত