ঘুষের টাকা নেন এতিমখানার নামে

গাজী শাহনেওয়াজ
প্রকাশ : ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৬: ৪২
আপডেট : ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২১: ৩৪

সমাজসেবা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) মোহাম্মদ কামরুজ্জামানের বিরুদ্ধে উন্নয়ন প্রকল্পপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে ঘুস নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ঘুষের টাকা বৈধ করতে এতিম ও সুবিধাবঞ্চিত শিশু হিফজখানা খুলেছেন। সেখান থেকেও হাতিয়ে নিয়েছেন কয়েক কোটি টাকা। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকার পরিবর্তন হলেও তার নীতি অপরিবর্তিত আছে। নানা ফন্দিফিকিরে ফাঁদে আটকে ফেলেছেন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রভাবশালীদের। এর ফলে সরকারি টাকা সুকৌশলে হাতিয়ে নিতে তার বেগ পেতে হচ্ছে না।

বিজ্ঞাপন

জানা গেছে, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হওয়ার সুবাদে শেখ হাসিনা সরকারের আমলে একাই ছিলেন তিনটি প্রকল্পের পরিচালক (পিডি)। প্রকল্পগুলো হচ্ছে—প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন প্রকল্প, ‘বেড়া ডায়াবেটিক সমিতি (বেডাস) ভবন নির্মাণ’ শীর্ষক কর্মসূচি প্রকল্প ও বিদ্যমান শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের (তিনটি) সক্ষমতা বৃদ্ধি’। দুর্নীতির অভিযোগে একটির পিডির দায়িত্ব ছাড়লেও এখনো দুটির দায়িত্ব হাতে রেখেছেন।

এ বিষয়ে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ আমার দেশকে বলেন, যে কোনো দুর্নীতির বিষয়ে সজাগ আছি। আমরা খতিয়ে দেখছি, কার কী কর্মকাণ্ড। তবে অপরাধী যেই হোক তিনি অনুকম্পা পাচ্ছেন না—এটা নিশ্চিত। তিনি আরো বলেন, এখন যার বিরুদ্ধে এ অভিযোগÑসত্যতা পেলে তিনিও ছাড় পাবেন না।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের ডিজি সাইদুর ইসলাম খান বলেন, এ ধরনের অভিযোগ আমার কাছেও এসেছে। এরপর উজানপাড়ায় প্রতিষ্ঠিত এতিম-সুবিধাবঞ্চিত শিশু হিফজখানাটি সমাজসেবা কার্যক্রম থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এমনকি প্রকল্পের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। এ সংক্রান্ত অভিযোগের বিষয়টিও তদন্তাধীন আছে।

তথ্যসূত্র বলছে, রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ী উপজেলার মাটিকাটা ইউনিয়নের উজানপাড়া এলাকায় একটি এতিমখানা প্রভাব খাটিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন সমাজসেবা অধিদপ্তরের ডিডি মোহাম্মদ কামরুজ্জামান। আলোচিত প্রতিষ্ঠানটির নাম ‘উজানপাড়া এতিম সুবিধাবঞ্চিত শিশু হিফজখানা কমপ্লেক্স’। পরিকল্পনা ও উন্নয়ন শাখা দেখভালের সুবাদে সহজেই নিবন্ধন পেয়ে যায় এতিমখানাটি। আপন ভাই ও নিকটাত্মীয়দের সহায়তায় পরিচালিত হচ্ছে এটি।

আমার দেশের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। সূত্রমতে, এতিমখানার নামে খোলা ইসলামী ব্যাংক গোদাগাড়ী শাখার হিসাবটি পরিচালনায় রয়েছেন তিনজন (দুরুল হুদা, আবুল কালাম আজাদ ও তরিকুল ইসলাম)। তবে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রকল্প পরিচালক ও বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কাজপ্রত্যাশী সংস্থার সেখানে টাকা জমা করছেন, যার পুরোটাই ঘুস বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ টাকা কামরুজ্জামান নগদায়ন করেন প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট স্থানীয় শাখা থেকে। মূলত ঘুসের টাকা বৈধ করতে এতিমখানাকে লেনদেনের চ্যালেন হিসেবে কাজে লাগাচ্ছেন কামরুজ্জামান।

ব্যাংক স্টেটমেন্ট ও বিভিন্ন নথিপত্র থেকে পাওয়া তথ্যমতে, গত দুই বছরে ওই হিসাবের মাধ্যমে কোটি টাকার ওপর শুধু ঘুসের টাকা লেনদেন হয়েছে। দেখা গেছে, বেশি লেনদেন জমা হয়েছে রাজধানীর ইসলামী ব্যাংকের আগারগাঁও, মোহাম্মদপুর ও বনানী শাখায়। তার অনেক অবৈধ লেনদেনের তথ্যপ্রমাণ আমার দেশ-এর কাছে রয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, প্রকল্পের পিডি হওয়ার সুবাদে বিভিন্ন সুবিধাভোগীর কাছ থেকে নিজের তৈরি এতিমখানার নামে ঘুস নিতেন কামরুজ্জামান। এর মাধ্যমে এখন তিনি একজন কোটিপতি সরকারি আমলা। অবৈধ এ টাকা দিয়ে ভিআইপিদের নানা উপঢৌকন দিয়ে থাকেন। এর বিনিময়ে আস্থাভাজন হিসেবে তাদের আরো আনুকূল্য পেয়ে আসছেন তিনি।

এতিমখানাটির কোষাধ্যক্ষ তরিকুল ইসলাম আমার দেশকে বলেন, ২০২০ সালে এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথমে ১০ জন এতিম ও সুবিধাবঞ্চিত শিশু নিয়ে কার্যক্রম শুরু হলেও এখন এখানে ৬৪ জন রয়েছে। জনপ্রতি সমাজসেবা থেকে দুই হাজার টাকা পেয়ে আসছি। সমাজসেবার ডিডি কামরুজ্জামানের ভাই মঞ্জুরও এর সদস্য। আর সারাদেশ থেকে এ এতিমখানার ব্যাংক হিসাবে টাকা জমা হয়। এ ছাড়া বাইরের দেশ থেকেও টাকা আসে। এভাবেই চলছে এতিমখানাটি।

একাই তিন প্রকল্পের পিডির দায়িত্ব

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী এ কর্মকর্তা একাই বাগিয়ে নেন তিনটি প্রকল্পের পরিচালকের (পিডি) পদ। প্রথম প্রকল্প (প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন প্রকল্প) থেকে অনিয়মের কারণে সরে পড়তে হয়। অভিযোগ রয়েছে, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর টাকা আত্মসাৎ করতে সচ্ছল ব্যক্তিদের কামার-কুমার, তাঁতি, নাপিত, বাঁশ ও বেতপণ্য উৎপাদনকারী সাজিয়ে বাগিয়ে নিতেন সরকারি টাকা। অসচ্ছল ব্যক্তিদের বদলে সুবিধাভোগীরা ছিলেন ছাত্রলীগ, যুবলীগ নেতা ও উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের কর্মচারীদের পরিবারের সদস্যরা। ওই প্রকল্পের অনিয়মগুলো বর্তমানে দুদক খতিয়ে দেখছে।

একটি থেকে সরে এলেও পরিকল্পনা ও উন্নয়ন শাখার পাশাপাশি এখনো দুটি প্রকল্পের পিডির দায়িত্ব পালন করছেন কামরুজ্জামান। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর ছাত্রদের দাবির মুখে সাবেক সমাজসেবা ডিজি ও উপপরিচালক সরলেও বহাল আছেন কামরুজ্জামান।

সাবেক মন্ত্রীর সঙ্গে সখ্য

এতিমখানার মাধ্যমে ঘুসের টাকা বৈধ করা কামরুজ্জামান অঢেল সম্পদের মালিক হওয়ায় মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন নানা উপঢৌকন দিয়ে। এ ছাড়া সমাজসেবা অধিদপ্তরের যত উন্নয়ন প্রকল্প সবকটি প্রস্তুত হয় অধিদপ্তরের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন শাখার মাধ্যমে। সে সুবাদে পতিত হাসিনা সরকারের সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদের সঙ্গে সখ্য গড়ে হাতিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা। মূল টাকা ভাগাভাগি হয় সাবেক মন্ত্রী নুরুজ্জামান, তার এপিএস মিজান ও সাবেক সচিবের মাধ্যমে। পরে আশীর্বাদ পান ডা. দীপু মনিরও।

তবে অভিযোগ অস্বীকার করে সমাজসেবা অধিদপ্তরের (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন শাখা) অতিরিক্ত পরিচালক মোহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, ‘আমি বর্তমানে একটি প্রকল্পের (বিদ্যমান শিশু উন্নয়ন) পিডি। বাকিগুলোতে বিগত সময়ে ন্যস্ত ছিলাম। আর উজানপাড়া এতিম ও সুবিধাবঞ্চিত শিশু হিফজখানাটি আমার পিতা-মাতার নামে নয় এলাকার নামে। তার সঙ্গে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।’ এতিমখানার অ্যাকাউন্টে ঘুস নেওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি সমাজসেবার (অধিদপ্তর) কিছু অসৎ লোক বা ডাকাত মিলে প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে।’ এটি নিয়ে তদন্ত হচ্ছে বলেও এ সময় স্বীকার করেন তিনি।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত