আজ ১০ ডিসেম্বর বুধবার, বিশ্ব মানবাধিকার দিবস। ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রের (ইউডিএইচআর) ৭৭ বছর পূর্ণ হলো আজ। ঘোষণাপত্রটি গ্রহণের দুই বছর পর ১৯৫০ সালের ১০ ডিসেম্বর দিনটিকে বিশ্ব মানবাধিকার দিবস হিসেবে ঘোষণা করে জাতিসংঘ।
সেই থেকে বিশ্বজুড়ে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশে এ বছর দিনটি নিয়ে এসেছে সম্পূর্ণ এক ভিন্ন বাস্তবতা। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে দেড় দশকের ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে এটি দ্বিতীয় মানবাধিকার দিবস।
এবার মানবাধিকার দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘মানবাধিকার, আমাদের নিত্যদিনের অপরিহার্য’। দেশের বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন মানববন্ধন, আলোচনা সভাসহ নানা কর্মসূচির মাধ্যমে দিবসটি পালন করছে। বিশ্ব মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাণী দিয়েছেন।
দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে ‘আয়নাঘর’ নামক বর্বরতার মাধ্যমে গুম ও ‘ক্রসফায়ার’-এর নামে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও ত্রাসের যে রাজত্ব কায়েম হয়েছিল, আপাতদৃষ্টিতে তার অবসান ঘটেছে। জাতি সেই সময়কার নিত্যদিনের ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তি পেয়েছে। তবে স্বস্তির বাতাসের সঙ্গে এখনো জড়িয়ে রয়েছে কিছুটা দীর্ঘশ্বাস। প্রশ্ন উঠছেÑক্ষমতার পালাবদলে কি সত্যিই সাধারণ নাগরিকের মানবাধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া সম্ভব হয়েছে?
মানবাধিকার সংগঠনগুলোর বার্ষিক পর্যবেক্ষণ ও পরিসংখ্যান বলছে, রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনায় গুম কিংবা ক্রসফায়ার হয়তো অতীত হয়েছে, কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু ও নির্যাতনের সংস্কৃতি এখনো থামেনি। সেই সঙ্গে বেড়েছে রাজনৈতিক সংঘাত।
মানবাধিকার কর্মী ও পর্যবেক্ষকদের মতে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামল ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে মানবাধিকার লঙ্ঘনের এক কালো অধ্যায়। ভিন্নমত দমনে বিরোধী দলীয় নেতাকর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ সমালোচকÑসবাইকেই পড়তে হয়েছিল গুম কিংবা গায়েবি মামলার নিদারুণ অভিশাপে। ‘আয়নাঘর’ শব্দটি হয়ে উঠেছিল আতঙ্কের প্রতীক। ৫ আগস্টের পর সেই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস কাঠামোগতভাবে ভেঙে ফেলা হয়েছে, যা নিঃসন্দেহে একটি বড় অর্জন।
তবে হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসের এক পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন দিচ্ছে মিশ্র পরিস্থিতির ইঙ্গিত। প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, নাটক সাজিয়ে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ক্রসফায়ারের ঘটনা শূন্যের কোঠায় নেমে এলেও থানা হাজতে কিংবা যৌথ বাহিনীর হেফাজতে অভিযুক্তের মৃত্যুর ঘটনা এখনো পুরোপুরি বন্ধ হয়নি।
মানবাধিকার বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সরকার পরিবর্তন হলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দীর্ঘদিনের গড়ে ওঠা মনস্তত্ত্ব ও কার্যপদ্ধতিতে এখনো পুরোপুরি পরিবর্তন আসেনি। কিছুদিন আগে সন্ত্রাস দমনে ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ নামে যৌথবাহিনী যে বিশেষ অভিযান চালিয়েছিল তাতে ক্ষমতার অপব্যবহারের কিছু অভিযোগ পাওয়া গেছে। আটকের পর শারীরিক নির্যাতন ও রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনাগুলো মানবাধিকারের মৌলিক নীতিমালার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
রাজনৈতিক সংঘাত : প্রতিপক্ষ যখন নিজ দল
২০২৫ সালের মানবাধিকার দিবসের পরিসংখ্যানে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে, তা হলো রাজনৈতিক সহিংসতা। রাষ্ট্রীয় বাহিনী যখন কিছুটা সংযত আচরণের চেষ্টা করছে, ঠিক তখনই রাজনীতির মাঠ দখলে নিতে রক্তক্ষয়ী সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন পক্ষ। চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসেই দেশে ৭৫৬টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে, যেখানে ঝরে গেছে ১১৭টি তাজা প্রাণ এবং আহত হয়েছেন ছয় হাজারেরও বেশি মানুষ।
বিগত বছরগুলোতে সংঘাতের মূল চিত্র ছিল সরকার বনাম বিরোধী দল। তবে বর্তমানে সহিংসতার সিংহভাগই ঘটছে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে। পরিসংখ্যান বলছে, সহিংসতার অর্ধেকেরও বেশি ঘটেছে নিজ দলের সংঘাত বা গ্রুপিংয়ের জেরে।
এদিকে ২০২৫ সালের ১২ মে অন্তর্বর্তী সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেও দলটির নাশকতামূলক তৎপরতার রেশ কাটেনি। অতি সম্প্রতি দলটির প্রধান শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়কে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে বোমাবাজি, গাড়িসহ বিভিন্ন স্থাপনায় আগুন দেওয়াসহ তাদের চোরাগোপ্তা নাশকতা সাধারণ মানুষের জানমালের নিরাপত্তাকে মারাত্মক ঝুঁকির মুখে ফেলে দিয়েছে।
বিচারহীনতার দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত
গত ১৫ বছরে দেশের বিচারব্যবস্থার ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে গিয়েছিল। বিচারহীনতার সেই দীর্ঘস্থায়ী সংস্কৃতি সমাজদেহে এমনভাবে বিষবাষ্প ছড়িয়েছে, মানুষ এখন আর আইনের অপেক্ষা করে না; নিজেরাই আইন হাতে তুলে নিচ্ছে। ২০২৫ সালে মানবাধিকারের জন্য অন্যতম বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে এ ‘মব জাস্টিস’ বা গণপিটুনি।
পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে গত ৯ জুলাইয়ের ঘটনাটি ছিল এ নির্মম বাস্তবতার নিকৃষ্ট উদাহরণ। ব্যবসায়ী সোহাগকে প্রকাশ্য দিবালোকে শত শত মানুষের সামনে কুপিয়ে-পিটিয়ে হত্যা করা হয়। কেবল চোর বা ছিনতাইকারী সন্দেহে নয়, কখনো ধর্ম অবমাননার গুজব ছড়িয়ে আবার কখনো তুচ্ছ রাজনৈতিক মতপার্থক্যের জেরে মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে।
গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশ
অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম প্রধান প্রতিশ্রুতি ছিল গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা বা ‘ফ্রিডম অব স্পিচ’ নিশ্চিত করা। বিগত ১৫ বছরের মতো খুব খারাপ পরিস্থিতি না হলেও সাংবাদিকতা এখনো একটি ঝুঁকিপূর্ণ পেশা হিসেবেই রয়ে গেছে। আশার কথা হলো, বর্তমান সরকার সাংবাদিকদের নিবর্তনমূলক সাইবার নিরাপত্তা আইন রহিত করে সাইবার নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করেছে। নতুন আইনে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পথ কিছুটা সুগম হয়েছে।
সীমান্তে লাশের মিছিল
মানবাধিকার কেবল দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়, সীমান্তের নিরাপত্তাও এর অবিচ্ছেদ্য অংশ। ২০২৫ সালেও সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) আগ্রাসন থামেনি। আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ এবং নিরীহ বাংলাদেশিদের গুলি করে হত্যার ঘটনা অব্যাহত রয়েছে।
অন্যদিকে মিয়ানমার সীমান্তে আরাকান আর্মির তৎপরতা, বাংলাদেশি জেলেদের অপহরণ ও মর্টারের গোলাবর্ষণ সীমান্ত জনপদের মানুষের জীবন ও জীবিকার অধিকারকে বিপন্ন করে তুলেছে। নিজের ভূখণ্ডে নিরাপদে বেঁচে থাকার অধিকারও মানবাধিকারের অংশ, যা সীমান্তে বারবার লঙ্ঘিত হচ্ছে।
আইন সংস্কার
মানবাধিকার সুরক্ষায় প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের অংশ হিসেবে ‘জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অধ্যাদেশ, ২০২৫’ জারি হয়েছে। কমিশনের ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং একে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করার এ উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তবে কেবল কাগজে-কলমে আইন বা অধ্যাদেশ জারি করলেই মানবাধিকার রক্ষা হবে না। এর জন্য প্রয়োজন আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং সংস্কৃতির পরিবর্তন।
মানবাধিকারকর্মী ও আইন বিশ্লেষকদের মতে, পুলিশ ও কারাগার সংস্কার ছাড়া হেফাজতে মৃত্যু ও নির্যাতন বন্ধ করা সম্ভব নয়। ৫৪ ধারার অপব্যবহার রোধ এবং রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের নির্দেশনাগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করা জরুরি। যতক্ষণ পর্যন্ত একজন অপরাধী বা অভিযুক্ত ব্যক্তি আইনের পূর্ণ সুরক্ষা না পাবে, ততক্ষণ মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার দাবি অসম্পূর্ণই থেকে যাবে।
প্রধান উপদেষ্টার বাণী
বিশ্ব মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে দেওয়া বাণীতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, জনগণের বিপুল সমর্থনের ভিত্তিতে, সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, বাংলাদেশের রায়ের মাধ্যমে ন্যায়বিচারের প্রতি আমাদের অঙ্গীকার আরো সুদৃঢ় করেছি, যেখানে পতিত স্বৈরাচারী সরকারের সদস্যদের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে।
তিনি বলেন, চব্বিশের জুলাইয়ে এ দেশের সর্বস্তরের জনগণ নিপীড়ন ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে ফ্যাসিবাদী শাসনকে পরাজিত করে, নিশ্চিত হয় জনগণের অধিকার ও মর্যাদা। অশান্ত পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই একটি ‘নতুন বাংলাদেশ’ আত্মপ্রকাশ করে। আমরা এখন ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে একটি গণতান্ত্রিক, অবাধ ও সুষ্ঠু জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছি, যাতে ন্যায়ভিত্তিক ও সমতাপূর্ণ সমাজ গঠন এবং আমাদের গণতন্ত্রকে আরো শক্তিশালী করার পথ নির্ধারণ করা যায়।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, আমরা আমাদের জাতীয় মানবাধিকার ব্যবস্থাকে আরো শক্তিশালী করতে আন্তর্জাতিক অংশীদার ও জাতিসংঘের সঙ্গে দৃঢ়ভাবে কাজ করার এবং বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার সমুন্নত রাখতে সব আন্তর্জাতিক অংশীদারের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করছি।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আজ আমরা গর্বের সঙ্গে এমন একটি জাতি হিসেবে দাঁড়িয়ে আছি, যারা মানবাধিকার-সংক্রান্ত জাতিসংঘের ৯টি মূল আন্তর্জাতিক চুক্তির সবগুলোয় যোগ দিয়েছে, যার সর্বশেষটি হলো গুমবিষয়ক আন্তর্জাতিক কনভেনশন ‘ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর দ্য প্রোটেকশন অব অল পারসনস ফ্রম এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স’। আমরা একই সঙ্গে নির্যাতনবিরোধী কনভেনশনের ঐচ্ছিক প্রটোকল এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সব মূল কনভেনশনেও সই করেছি, যা আমাদের শ্রমিকদের অধিকার ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে।
মিয়ানমারে জাতিগত নিপীড়নের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের অধিকার সুরক্ষায় আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ উল্লেখ করে ড. ইউনূস বলেন, এটি অত্যন্ত দুঃখজনক, আট বছর পরও মিয়ানমার এখন পর্যন্ত কোনো রোহিঙ্গাকে ফেরত নেয়নি। দ্রুততম সময়ে নিরাপদ প্রত্যাবাসন কার্যকর করার মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানের বিষয়ে আমি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সুদৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
একই ভাবে গাজাসহ বিশ্বের যেকোনো স্থানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে আমরা সোচ্চার রয়েছি এবং একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতি আমাদের অকুণ্ঠ সমর্থন অব্যাহত রেখেছি, স্বাধীনতার জন্য ফিলিস্তিনের জনগণের ন্যায্য সংগ্রামে তাদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছি।

