ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রার্থীদের ওপর সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় সারা দেশের প্রার্থীদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বেড়েছে। প্রার্থীরা নিজের নিরাপত্তা নিয়েও এখন উদ্বিগ্ন। তারা বলছেন, সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পূর্বশর্ত শান্তিপূর্ণ পরিবেশ। কিন্তু পরপর দুজন প্রার্থীর ওপর সন্ত্রাসীদের গুলির ঘটনায় প্রার্থী-ভোটারসহ সবার মাঝে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। এ বিষয়ে সরকারের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি।
গতকাল শুক্রবার দুপুরে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ ওসমান হাদিকে দুর্বৃত্তরা খুব কাছ থেকে গুলি করে পালিয়ে যায়। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে।
গতকাল গুলিবিদ্ধ হওয়ার আগেই ওসমান হাদি নিজের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। গত ১৪ নভেম্বর হাদি তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে বলেন, ‘গত তিন ঘণ্টায় আমার নম্বরে লীগের খুনিরা অন্তত ৩০টি বিদেশি নম্বর থেকে কল ও টেক্সট করেছে, যার সামারি হলোÑআমাকে সর্বক্ষণ নজরদারিতে রাখা হচ্ছে। তারা আমার বাড়িতে আগুন দেবে। আমার মা, বোন ও স্ত্রীকে ধর্ষণ করবে এবং আমাকে হত্যা করবে।’
এর আগে গত ৫ নভেম্বর চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক ও চট্টগ্রাম-৮ আসনে দলটির মনোনীত প্রার্থী মো. এরশাদ উল্লাহ গণসংযোগকালে সন্ত্রাসীদের হামলায় গুলিবিদ্ধ হন। এছাড়া গত ২৭ নভেম্বর পাবনার ইশ্বরদীতেও প্রকাশ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় সারা দেশের প্রার্থীদের মধ্যে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা-৮ আসনের জামায়াতে ইসলামী মনোনীত প্রার্থী ড. হেলাল উদ্দীন আমার দেশকে বলেন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরদিনই প্রার্থীর ওপর প্রকাশ্যে গুলি চালানোর ঘটনা নির্বাচনকালীন নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এটি নির্বাচন বানচালের সুস্পষ্ট অপচেষ্টা। অবিলম্বে সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শান্তির দাবি জানান তিনি। সেই সঙ্গে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
এ প্রসঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, অবিলম্বে সব প্রার্থীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন এবং নির্বাচন যেন সম্পূর্ণভাবে সন্ত্রাসমুক্ত হয় তার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। তিনি আরো বলেন, আমরা মনে করি, এটা চক্রান্তের অংশ। এটাকে এখনই বন্ধ করার জন্য আমরা সরকারের কাছে আহ্বান জানাই।
জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরদিনই একজন অন্যতম জুলাইযোদ্ধা এবং এমপি প্রার্থীর ওপর প্রকাশ্যে গুলি চালানোর ঘটনা নির্বাচনকালীন নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এটি ভীতি সৃষ্টির সুস্পষ্ট অপচেষ্টা বলেই প্রতীয়মান হয়। হামলাকারীদের অবিলম্বে শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করতে হবে। নির্বাচনের সব প্রার্থী, দলীয় কর্মী ও সাধারণ নাগরিকের নিরাপত্তায় কার্যকর ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। হামলাটি পতিত ফ্যাসিস্ট শক্তির নির্বাচন বানচালের কোনো সুপরিকল্পিত চক্রান্ত কি না, সরকারকে তা গভীরভাবে খতিয়ে দেখার আহ্বান জানান তিনি।
এ প্রসঙ্গে অপরাধ বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক আমার দেশকে বলেন, আজ (গতকাল শুক্রবার) স্বতন্ত্র প্রার্থী ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ ওসমান হাদির ওপর হামলা হয়েছে। এর আগে চট্টগ্রাম-৮ আসনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী এরশাদ উল্লাহ গণসংযোগকালে গুলিবিদ্ধ হন। এসব ঘটনা গ্রহণযোগ্য নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। প্রার্থী ও ভোটারদের নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করছে। এতে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এ ঘটনা নতুন করে সবার মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। শুধু তাই নয়, এ ঘটনা অনেক আসনের প্রার্থীর নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। এছাড়া নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পরাজিত শক্তির অপতৎপরতা রোধেও সজাগ থাকতে হবে।
এই অপরাধ বিশেষজ্ঞ আরো বলেন, অতীতে যেসব আসনে বেশি নির্বাচনি সহিংসতা হয়েছে কিংবা যেসব আসনে সংঘাত-সহিংসতার আশঙ্কা রয়েছে, সেসব আসনে বাড়তি নিরাপত্তাব্যবস্থা নিতে হবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে। একই সঙ্গে সন্দেহভাজনদের আইনের আওতায় আনাও জরুরি। অন্যথায় নির্বাচনি প্রচার বা গণসংযোগে যেকোনো অনভিপ্রেত ঘটনা এমনকি প্রাণহানির মতো ঘটনা বাড়তে পারে। এতে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক কামরুন নাহার আমার দেশকে বলেন, শরীফ ওসমান হাদির গণসংযোগকালে গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা খুবই দুঃখজনক। তফসিল ঘোষণার পরপরই এ ঘটনা যেমন সবার মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে, তেমনি এ বিষয়ে সরকারসহ সবাই সজাগ ও সতর্ক হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, এর আগে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি, এনসিপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল মনোনীত প্রার্থীদের কোনো নিরাপত্তা ঝুঁকি আছে কি না, তা যাচাইয়ে তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু করেছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। পুলিশের পক্ষে কাজটি শুরু করেছে স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি)। ঝুঁকি বিশ্লেষণের পর সংশ্লিষ্ট প্রার্থীদের বিশেষ নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হবে। তথ্যাদি পর্যালোচনার পর কোনো এলাকায় বিশেষ নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলে তাও নেওয়া হবে।
এছাড়া বিভিন্ন দলের প্রার্থীদের গণসংযোগকে কেন্দ্র করে যেন কোনো ধরনের সহিংসতা না হয়, সেজন্য মাঠ পুলিশকে সজাগ থাকতে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে আগাম নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

