আমার দেশ জনপ্রিয় বাংলা নিউজ পেপার

পিলখানা হত্যাকাণ্ড

পাঁচ সেনা কর্মকর্তাকে ‘জঙ্গি আতঙ্ক’ দেখিয়ে ফাঁসাতে চেয়েছিলেন তাপস

সোচ্চার অফিসারদের টার্গেট করে গুম-নির্যাতনের অভিযোগ

‘তাপস হত্যাচেষ্টা মামলা’ ছিল সম্পূর্ণ সাজানো

তাপস নিজেই মামলায় কোনো প্রমাণ দিতে পারেননি

সেনাবাহিনীতে ‘জঙ্গিবাদ’ আছে এমন ধারণা প্রতিষ্ঠাই মূল উদ্দেশ্য

আবু সুফিয়ান
পাঁচ সেনা কর্মকর্তাকে ‘জঙ্গি আতঙ্ক’ দেখিয়ে ফাঁসাতে চেয়েছিলেন তাপস

২০০৯ সালে বিডিআর হত্যাকাণ্ডের পর দেশের সেনাবাহিনীতে যে আতঙ্ক, অস্থিরতা ও অবিশ্বাসের পরিবেশ তৈরি হয়েছিল, তার সুযোগ নেওয়া হয় রাজনৈতিকভাবে। যেসব সেনা অফিসার সৎ, দেশপ্রেমিক ও বিডিআর হত্যাকাণ্ড নিয়ে সোচ্চার ছিলেন তাদের একে একে সেনাবাহিনী থেকে বের করে দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, ‘তাপস হত্যাচেষ্টা মামলা’র নামে কয়েকজনকে আটক করে নির্যাতনও চালানো হয়।

এ মামলার উদ্দেশ্য ছিল স্পষ্ট, সেনাবাহিনীর ভেতরে ‘ইসলামি জঙ্গিবাদ’ রয়েছে, এমন ধারণা প্রতিষ্ঠা করা। এজন্য পাঁচজন দেশপ্রেমিক জুনিয়র অফিসারকে টার্গেট করা হয়। তারা বিডিআর বিদ্রোহ দমন, তদন্ত, আলামত সংগ্রহসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানতেন এবং সব ক্ষেত্রে সোচ্চার ছিলেন। গত ৩০ নভেম্বর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার কাছে জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন পিলখানা হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে যে প্রতিবেদন জমা দেয়, তাতে এসব তথ্য উঠে আসে।

বিজ্ঞাপন

স্বাধীন তদন্ত কমিশনের সাক্ষ্যে উঠে এসেছে, তাপসকে আজীবন নিরাপত্তা দিতে এবং সেনাবাহিনীতে ভয় তৈরি করতে সম্পূর্ণ সাজানো, মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ‘তাপস হত্যাচেষ্টা মামলা’ দাঁড় করানো হয়েছিল। যাতে সেনাবাহিনীর কোনো অফিসার বিডিআর বিদ্রোহে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নিয়ে মুখ খুলতে না পারেন।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, সেনাবাহিনীর ভেতরে ‘জঙ্গিবাদ’ আছে এ বর্ণনা প্রতিষ্ঠার জন্যই প্রথমবারের মতো ইউনিফর্ম পরিহিত অবস্থায় সেনাসদস্যদের গুম করা হয়। তাদের এ মামলায় জড়ানো হয় এমনভাবে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ আর আওয়াজ তোলার সাহস না পান। বড় রাজনৈতিক ব্যক্তি, আমলা কিংবা বিশিষ্ট নাগরিককে গুম বা হত্যা সবই যাতে বিনা বাধায় করা যায়, সে ফ্যাসিবাদী পরিবেশই তৈরি করা হচ্ছিল। এ ঘটনার মাধ্যমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে পুরোপুরি ভীত, বিভ্রান্ত ও নিষ্ক্রিয় করে ফেলাই ছিল মূল লক্ষ্য।

প্রতিবেদনে বলা হয়, তাপস হত্যাচেষ্টা মামলায় বাদী ফজলে নূর তাপস নিজেই সাক্ষ্যপ্রমাণ দিতে ব্যর্থ হন। ফলে পুলিশ মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদনে ঘটনাটিকে ভিত্তিহীন ঘোষণা করে। মামলায় কোনো সামরিক অফিসারের নাম ছিল না এটিও স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়।

যারা বিডিআর হত্যাকাণ্ডের সুবিচারের জন্য সোচ্চার ছিলেন, সে পাঁচ অফিসার হলেন ক্যাপ্টেন রেজাউল করিম ও ক্যাপ্টেন খন্দকার রাজীব হোসেন (বরখাস্ত), মেজর হেলাল (বিডিআর মহাপরিচালকের সচিবালয়ের জেনারেল স্টাফ অফিসার-২, সমন্বয়ক), ক্যাপ্টেন সুবায়েল বিন রফিক (ডিজির এডিসি) এবং ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ ফুয়াদ খান (জেনারেল স্টাফ অফিসার-৩, অপারেশন)।

পিলখানায় তদন্ত, তদন্ত-সহায়তা ও সমন্বয়ের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা এ অফিসারদের হঠাৎ সরিয়ে দেওয়া হয়। উদ্দেশ্য ছিল তাদের হাতে থাকা গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ নষ্ট করা এবং তাদেরই অপরাধী বানিয়ে ভয়াবহ দৃষ্টান্ত তৈরি করা।

ডিজিএফআইয়ের সাবেক ডিজি মেজর জেনারেল ফজলে আকবর, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমরুল কায়েস, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সালেহ এবং তৎকালীন ঢাকা সেক্টর কমান্ডার কর্নেল আজিজ এ মামলাকে ভিন্ন খাতে নিতে সরাসরি ভূমিকা রাখেন বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে।

সাক্ষ্য অনুযায়ী, ক্যাপ্টেন রেজাউল করিম ২৫ ফেব্রুয়ারি সকালে র‍্যাব-৩-এর কর্মকর্তা হিসেবে নিউমার্কেট গেট লক্ষ্য করে বিদ্রোহীদের দিকে গুলি ছোড়েন। আদেশ না থাকা সত্ত্বেও উদ্ধার উদ্যোগ নেওয়ার কারণে তাকে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়। পরে তিনি পিলখানায় নিরাপত্তা দায়িত্ব ও আলামত সংগ্রহের কাজে যুক্ত ছিলেন। এ সময় ডিজিএফআই ক্যাপ্টেন রেজাকে পিলখানা থেকে তুলে নিয়ে যায়।

ক্যাপ্টেন রাজিব, ক্যাপ্টেন ফুয়াদ, ক্যাপ্টেন সুবায়েল ও মেজর হেলাল সবাই বিদ্রোহপরবর্তী সময়ে পিলখানায় দায়িত্ব পালন করছিলেন। ২৬ ফেব্রুয়ারি উদ্ধার অভিযান শুরুর কোনো নির্দেশ না পেয়ে তারা নিজেরাই অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র নিয়ে বিপদাপন্ন সহকর্মীদের উদ্ধার পরিকল্পনা করেন। ঘটনাপরবর্তী সময়ে সেনাপ্রধান মইন উ আহমেদ এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দরবারেও হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করেন তারা।

সাক্ষ্যে জানা যায়, তদন্তে কোনো আলামত পেলে তা গোয়েন্দা সংস্থার অনুমতি ছাড়া তদন্ত কমিটিকে না দিতে বারবার চাপ প্রয়োগ করা হয়। ক্যাপ্টেন ফুয়াদ বিষয়টি অমান্য করায় গোয়েন্দা সংস্থার রোষানলে পড়েন এবং পরে ডিজিএফআই তাকে তুলে নিয়ে যায়।

ক্যাপ্টেন সুবায়েল ও মেজর হেলাল তৎকালীন ডিজি বিডিআরের পারসোনাল স্টাফ হিসেবে পিলখানা ছাড়া ছিল অসম্ভব। কিন্তু ডিজির নির্দেশে ছলচাতুরীর মাধ্যমে কর্নেল আজিজ আহমেদ তাদের ডিজিএফআইয়ে রেখে আসেন এবং পরে তারা আটক হন।

এমন অভিযোগ আরো দৃঢ় হয় যখন তাপস হত্যাচেষ্টা মামলায় আটক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ডিজিএফআই মৌখিকভাবে গ্রেপ্তার, জেআইসিতে নির্যাতন এবং সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেওয়ার মতো অভিযোগ ওঠে। তদন্ত আদালতের সামনে উপস্থিত হওয়া কর্মকর্তারা ‘সম্পূর্ণ ভেঙে পড়া’ অবস্থায় ছিলেন—এমন মন্তব্যও দিয়েছেন এক ব্রিগেডিয়ার।

তদন্তের আলামত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছিল মোবাইল যোগাযোগের নকশা, বিস্ফোরক, ডেটোনেটর ও একটি ট্রাংকভর্তি অস্ত্র। কিন্তু সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট কমান্ডার সাক্ষ্য দিয়ে জানান, আলামতগুলোর কোনোটিই গ্রহণযোগ্য বা বিশ্বাসযোগ্য নয়। বিশেষ করে ১৬ ইসিবি ক্যাম্প থেকে উদ্ধার করা এক ট্রাংক অস্ত্রের বিষয়ে ইউনিট কমান্ডাররা জানান, ইউনিটে এমন কোনো উদ্ধার অভিযান হয়নি; এটি হলে পুরো ইউনিটে বড় আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়াত।

তদন্ত আদালতের সদস্যরাও ঘটনাস্থল পরিদর্শন নিয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়েছেন। মোবাইল সিমের মালিকানা নিশ্চিত করা হয়নি। পুলিশের ডিবি অফিসাররাও জানিয়েছেন—তাপস হত্যাচেষ্টা ‘ঘটেনি’।

প্রথম পর্যায়ের তদন্তে কোনো প্রমাণ না পাওয়ার পরও অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের এক মাস ধরে নির্যাতন করা হয় বলে অভিযোগ। পরে সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেওয়ার পর তাতে টাইপ করা স্বীকারোক্তিতে স্বাক্ষর দিতে বাধ্য করা হয়।

সামরিক আদালতের পরবর্তী ধাপ—সামারি অব অ্যাভিডেন্স ও কোর্ট মার্শালে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন সে কর্মকর্তারাই, যারা তদন্ত আদালতে যোগদান করেছিলেন তদন্তের মাঝপথে। আটক কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যদের ব্ল্যাকমেইল ও লাঞ্ছনার অভিযোগও পাওয়া যায়।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, তথাকথিত তাপস হত্যাচেষ্টা মামলার গল্প তাই শেষে দাঁড়ায় একটি সাজানো নাটকে, যার লক্ষ্য ছিল সত্যকে চাপা দেওয়া, সেনাবাহিনীকে স্তব্ধ করে দেওয়া এবং বিডিআর হত্যাকাণ্ডের মূল রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতাকে আড়াল করা।

Google News Icon

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন