
সাইদুর রহমান রুমী

বাংলাদেশের সমাজ কাঠামোতে ন্যায়বিচার সবসময় একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। শহরে অবস্থানরত মানুষের জন্য আদালত, আইনজীবী বা বিচারিক ব্যবস্থা সহজলভ্য হলেও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কাছে ন্যায়বিচার অনেক সময়ই এক কঠিন বাস্তবতা। জটিল বিচার প্রক্রিয়া, মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা, উচ্চ খরচ এবং সামাজিক বাধাÑসবকিছু মিলিয়ে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে নারীরা ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, আদালতের দ্বারস্থ হতে অনিচ্ছুক থাকে। অথচ রাষ্ট্রীয় নীতির মূল লক্ষ্য হলো ন্যায়বিচারকে সবার জন্য সহজলভ্য করা। এই লক্ষ্যপূরণে স্থানীয় সরকার বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তায় বাস্তবায়িত ‘বাংলাদেশ গ্রাম আদালত সক্রিয়করণ প্রকল্প’ এক সময়োপযোগী ও কার্যকর পদক্ষেপ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। বর্তমানে তৃতীয় পর্যায়ের কার্যক্রম চলমান, যা নিছক একটি উন্নয়ন প্রকল্প নয়; বরং এটি মূলত একটি সামাজিক রূপান্তরের সূচনা, যেখানে ন্যায়বিচার শুধু শহরের দেয়ালে আটকে না থেকে গ্রামের মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাচ্ছে ।
বিগত ২০০৯ সালে বাংলাদেশ সরকারের স্থানীয় সরকার বিভাগ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) সহায়তায় ‘বাংলাদেশ গ্রাম আদালত সক্রিয়করণ’ শীর্ষক পাইলট প্রকল্পটি শুরু হয়। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল ইউনিয়নপর্যায়ে গ্রাম আদালত ব্যবস্থা কার্যকর করা, বিচার সেবাকে সহজলভ্য করা এবং জনগণকে প্রান্তিক পর্যায়ে ন্যায়বিচারের আওতায় আনা ।
জনগণের মধ্যে আইনি সচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রকল্পটি কার্যক্রম কয়েকটি ধাপে পরিচালিত হচ্ছে। প্রথমপর্যায়ে নির্বাচিত ৩৫১টি ইউনিয়নে পাইলট প্রকল্প চালু করা হয়। সেখানে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় এবং গ্রাম আদালতের কার্যক্রমকে স্বচ্ছ ও সহজ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই ধাপ সফল হওয়ার পর দ্বিতীয় পর্যায়ে এর আওতা আরো সম্প্রসারিত করা হয়, যাতে ১ হাজার ৮০টি ইউনিয়নের জনসাধারণ উপকৃত হয়েছেন।
বর্তমানে প্রকল্পের তৃতীয় পর্যায় চলমান রয়েছে (২০২২-২০২৭ মেয়াদে)। এ পর্যায়ে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বিচারিক সেবায় নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা, আইনি সহায়তা কার্যক্রমকে প্রাতিষ্ঠানিক করাসহ মামলা নিষ্পত্তির প্রক্রিয়াকে দ্রুত করা। প্রকল্পের আওতায় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য ও স্থানীয় নেতৃত্বকে নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, প্রচারণা চালানো হচ্ছে, যাতে মানুষ গ্রাম আদালত সম্পর্কে বিস্তারিত জানে এবং গ্রাম আদালতের মাধ্যমে মামলার নিষ্পত্তি করে।
এ প্রকল্পের সাফল্যের অন্যতম দিক হলো মামলা নিষ্পত্তির গতি ও ব্যয়। গড়ে মাত্র ১৮ দিনে একটি মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে এবং খরচ পড়ছে প্রায় ৩২৮ টাকা। এ পর্যন্ত এক লাখেরও বেশি মানুষ গ্রাম আদালতের সেবা গ্রহণ করেছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ প্রান্তিক নারী। নারীরা শুধু আবেদনকারী হিসেবেই আসছেন না, বরং ইউনিয়ন পরিষদের নারী সদস্যরা (শতকরা প্রায় ১৫ শতাংশ) সক্রিয়ভাবে বিচার প্রক্রিয়ায় অংশ নিচ্ছেন ।
প্রকল্পটি যেভাবে গড়ে উঠেছে, তা নিছক একটি প্রশাসনিক কৌশল নয়; বরং মানুষের মৌলিক চাহিদার সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। প্রান্তিক মানুষ আগে আদালতে যেতে ভয় পেত, কারণ মামলা মানেই বছরের পর বছর খরচ আর দৌড়ঝাঁপ। এখন ইউনিয়ন পরিষদেই গ্রাম আদালতের মাধ্যমে তারা দ্রুত নিষ্পত্তি পাচ্ছে। প্রকল্পের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর পর্যন্ত প্রায় ১ লাখ ৩৬ হাজার মামলা গ্রাম আদালতে করা হয়েছে, যার মধ্যে ৩৬ হাজারের বেশি করেছে নারীরা। এটি এক ঐতিহাসিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়, কারণ নারীরা আগে যেখানে নিজেদের অধিকার ক্ষুণ্ণ হলে বিচারপ্রার্থী হতে চাইতেন না, সেখানে এখন তারাই ন্যায়বিচার চেয়ে সামনে আসছেন। আরো উল্লেখযোগ্য দিক হলো, দায়ের করা মামলার প্রায় ৭৮ শতাংশই নিষ্পত্তি হয়েছে। এই পরিসংখ্যান শুধু সংখ্যার খেলা নয়; বরং আস্থা সৃষ্টির মাপকাঠি। সাধারণ মানুষ এখন বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, প্রত্যন্ত অঞ্চলেও হাইকোর্ট-সুপ্রিম কোর্টের মতো বড় বড় আদালত ছাড়াও ন্যায়বিচার পাওয়া সম্ভব এবং সেটিও সহজ উপায়ে।
গ্রাম আদালতের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি, অনেক নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী যেমন নৃ-গোষ্ঠী, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, হিজড়া সম্প্রদায়, দলিত এবং দরিদ্র জনগণ গ্রাম আদালতের সেবা সম্পর্কে অবগত নয়। অনেকেই জানে না তারা ভরণপোষণ বা অবমাননাকর আচরণের প্রতিকার বা ছোট ছোট দেওয়ানি ও ফৌজদারি বিষয়ে আইনি সহায়তা পেতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে আমাদের সমাজে নারীরা ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে অবহেলিত ও বঞ্চিত ছিল। পরিবারের পুরুষ সদস্যদের অনুমতি ছাড়া তারা অনেক সময়ই আইনের আশ্রয় নিতে পারত না। সামাজিক কুসংস্কার, সম্মানের ভয় কিংবা প্রতিহিংসার আশঙ্কায় নারীরা চুপ থাকতেই বাধ্য হতো। কিন্তু প্রকল্পটি নিয়মিত প্রশিক্ষণ, আইনি সচেতনতা কার্যক্রম এবং ইউনিয়ন পরিষদের নারী সদস্যদের সক্রিয় সম্পৃক্ততার মাধ্যমে এই পরিস্থিতিতে পরিবর্তন এনেছে। এখন অনেক নারী মুধু নিজেদের মামলা করছে না বরং অন্য নারীদেরও অনুপ্রাণিত করছে। এতে নারীর নেতৃত্ব, আত্মবিশ্বাস এবং সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। দীর্ঘ মেয়াদে এই প্রবণতা গ্রামীণ সমাজে জেন্ডার সমতা ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। গ্রাম আদালত আইন নারীর স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিরোধীয় বিষয় নিষ্পত্তিতে গ্রাম আদালত গঠনের ক্ষেত্রে নারী সদস্য মনোনয়নের বাধ্যবাধকতার বিধান রয়েছে।
গ্রাম আদালত আইন, ২০০৬ অনুযায়ী, ‘কোনো স্ত্রী কর্তৃক তাহার বকেয়া ভরণপোষণ আদায়ের মামলা’ গ্রাম আদালতের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করার বিধান রয়েছে। ফলে একজন বিবাহিত এবং ক্ষেত্রবিশেষে একজন তালাকপ্রাপ্ত নারী (স্ত্রী) জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে তার বকেয়া ভরণপোষণ/খোরপোশ আদায়ের জন্য এখন থেকে ইউনিয়ন পরিষদে গ্রাম আদালত ব্যবস্থার মাধ্যমে মামলা করতে পারবে। ভরণপোষণ বলতে থাকা, খাওয়া, পরা ইত্যাদি ব্যক্তিগত জীবনের সব অপরিহার্যতা পূরণ বোঝায় এবং এই পূরণ হতে হবে সংশ্লিষ্ট পক্ষদের সামাজিক অবস্থানুসারে। স্ত্রীর ভরণপোষণ/খোরপোশের পূর্ণ দায়িত্ব স্বামীর। অন্য কোনো পারিবারিক বিষয় যেমন তালাক, সন্তানের অভিভাবকত্ব ইত্যাদি বিষয়ে গ্রাম আদালত কোনোরূপ সিদ্ধান্ত দিতে পারবে না। নারীর স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিরোধীয় বিষয় নিষ্পত্তিতে গ্রাম আদালত গঠনের বিধান রয়েছে, যে অধিকারের বিষয়ে অনেক ক্ষেত্রেই কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। অনেক মানুষ এখনো জানেন না গ্রাম আদালত কীভাবে কাজ করে। সামাজিক কুসংস্কার এবং পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা নারীর অংশগ্রহণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। ইউনিয়ন পর্যায়ে পরিকাঠামো ও জনবল সীমিত। তাছাড়া বিদ্যমান আইনগুলোর কিছু জায়গায় সংশোধন প্রয়োজন, যাতে গ্রাম আদালতের কার্যক্রম আরো কার্যকর হয়। তবে ইতিবাচক দিক হলো এসব চ্যালেঞ্জ সরকার, স্থানীয় নেতৃত্ব, উন্নয়ন সহযোগী এবং নাগরিক সমাজের সমন্বিত প্রচেষ্টায় মোকাবিলা করা সম্ভব।
গ্রাম আদালত শক্তিশালীকরণের তৃতীয় পর্যায় বাংলাদেশের ন্যায়বিচার ব্যবস্থার নতুন দর্শন। যদি এটি সফলভাবে বাস্তবায়িত হয়, তবে দেশের বিচারব্যবস্থার ওপর চাপ অনেক কমে যাবে। উচ্চ আদালতে মামলা কমে আসবে, ফলে বিচারকরা জটিল মামলা নিষ্পত্তিতে অধিকতর সময় দিতে পারবেন। সবচেয়ে বড় কথা, গ্রামীণ জনগণ আর ন্যায়বিচারকে দূরের বিষয় মনে করবেন না। নারীরা হবে সমান অংশীদার, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী হবে অন্তর্ভুক্ত আর সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে আইনের শাসন।

বাংলাদেশের সমাজ কাঠামোতে ন্যায়বিচার সবসময় একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। শহরে অবস্থানরত মানুষের জন্য আদালত, আইনজীবী বা বিচারিক ব্যবস্থা সহজলভ্য হলেও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কাছে ন্যায়বিচার অনেক সময়ই এক কঠিন বাস্তবতা। জটিল বিচার প্রক্রিয়া, মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা, উচ্চ খরচ এবং সামাজিক বাধাÑসবকিছু মিলিয়ে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে নারীরা ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, আদালতের দ্বারস্থ হতে অনিচ্ছুক থাকে। অথচ রাষ্ট্রীয় নীতির মূল লক্ষ্য হলো ন্যায়বিচারকে সবার জন্য সহজলভ্য করা। এই লক্ষ্যপূরণে স্থানীয় সরকার বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তায় বাস্তবায়িত ‘বাংলাদেশ গ্রাম আদালত সক্রিয়করণ প্রকল্প’ এক সময়োপযোগী ও কার্যকর পদক্ষেপ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। বর্তমানে তৃতীয় পর্যায়ের কার্যক্রম চলমান, যা নিছক একটি উন্নয়ন প্রকল্প নয়; বরং এটি মূলত একটি সামাজিক রূপান্তরের সূচনা, যেখানে ন্যায়বিচার শুধু শহরের দেয়ালে আটকে না থেকে গ্রামের মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাচ্ছে ।
বিগত ২০০৯ সালে বাংলাদেশ সরকারের স্থানীয় সরকার বিভাগ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) সহায়তায় ‘বাংলাদেশ গ্রাম আদালত সক্রিয়করণ’ শীর্ষক পাইলট প্রকল্পটি শুরু হয়। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল ইউনিয়নপর্যায়ে গ্রাম আদালত ব্যবস্থা কার্যকর করা, বিচার সেবাকে সহজলভ্য করা এবং জনগণকে প্রান্তিক পর্যায়ে ন্যায়বিচারের আওতায় আনা ।
জনগণের মধ্যে আইনি সচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রকল্পটি কার্যক্রম কয়েকটি ধাপে পরিচালিত হচ্ছে। প্রথমপর্যায়ে নির্বাচিত ৩৫১টি ইউনিয়নে পাইলট প্রকল্প চালু করা হয়। সেখানে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় এবং গ্রাম আদালতের কার্যক্রমকে স্বচ্ছ ও সহজ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই ধাপ সফল হওয়ার পর দ্বিতীয় পর্যায়ে এর আওতা আরো সম্প্রসারিত করা হয়, যাতে ১ হাজার ৮০টি ইউনিয়নের জনসাধারণ উপকৃত হয়েছেন।
বর্তমানে প্রকল্পের তৃতীয় পর্যায় চলমান রয়েছে (২০২২-২০২৭ মেয়াদে)। এ পর্যায়ে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বিচারিক সেবায় নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা, আইনি সহায়তা কার্যক্রমকে প্রাতিষ্ঠানিক করাসহ মামলা নিষ্পত্তির প্রক্রিয়াকে দ্রুত করা। প্রকল্পের আওতায় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য ও স্থানীয় নেতৃত্বকে নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, প্রচারণা চালানো হচ্ছে, যাতে মানুষ গ্রাম আদালত সম্পর্কে বিস্তারিত জানে এবং গ্রাম আদালতের মাধ্যমে মামলার নিষ্পত্তি করে।
এ প্রকল্পের সাফল্যের অন্যতম দিক হলো মামলা নিষ্পত্তির গতি ও ব্যয়। গড়ে মাত্র ১৮ দিনে একটি মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে এবং খরচ পড়ছে প্রায় ৩২৮ টাকা। এ পর্যন্ত এক লাখেরও বেশি মানুষ গ্রাম আদালতের সেবা গ্রহণ করেছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ প্রান্তিক নারী। নারীরা শুধু আবেদনকারী হিসেবেই আসছেন না, বরং ইউনিয়ন পরিষদের নারী সদস্যরা (শতকরা প্রায় ১৫ শতাংশ) সক্রিয়ভাবে বিচার প্রক্রিয়ায় অংশ নিচ্ছেন ।
প্রকল্পটি যেভাবে গড়ে উঠেছে, তা নিছক একটি প্রশাসনিক কৌশল নয়; বরং মানুষের মৌলিক চাহিদার সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। প্রান্তিক মানুষ আগে আদালতে যেতে ভয় পেত, কারণ মামলা মানেই বছরের পর বছর খরচ আর দৌড়ঝাঁপ। এখন ইউনিয়ন পরিষদেই গ্রাম আদালতের মাধ্যমে তারা দ্রুত নিষ্পত্তি পাচ্ছে। প্রকল্পের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর পর্যন্ত প্রায় ১ লাখ ৩৬ হাজার মামলা গ্রাম আদালতে করা হয়েছে, যার মধ্যে ৩৬ হাজারের বেশি করেছে নারীরা। এটি এক ঐতিহাসিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়, কারণ নারীরা আগে যেখানে নিজেদের অধিকার ক্ষুণ্ণ হলে বিচারপ্রার্থী হতে চাইতেন না, সেখানে এখন তারাই ন্যায়বিচার চেয়ে সামনে আসছেন। আরো উল্লেখযোগ্য দিক হলো, দায়ের করা মামলার প্রায় ৭৮ শতাংশই নিষ্পত্তি হয়েছে। এই পরিসংখ্যান শুধু সংখ্যার খেলা নয়; বরং আস্থা সৃষ্টির মাপকাঠি। সাধারণ মানুষ এখন বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, প্রত্যন্ত অঞ্চলেও হাইকোর্ট-সুপ্রিম কোর্টের মতো বড় বড় আদালত ছাড়াও ন্যায়বিচার পাওয়া সম্ভব এবং সেটিও সহজ উপায়ে।
গ্রাম আদালতের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি, অনেক নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী যেমন নৃ-গোষ্ঠী, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, হিজড়া সম্প্রদায়, দলিত এবং দরিদ্র জনগণ গ্রাম আদালতের সেবা সম্পর্কে অবগত নয়। অনেকেই জানে না তারা ভরণপোষণ বা অবমাননাকর আচরণের প্রতিকার বা ছোট ছোট দেওয়ানি ও ফৌজদারি বিষয়ে আইনি সহায়তা পেতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে আমাদের সমাজে নারীরা ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে অবহেলিত ও বঞ্চিত ছিল। পরিবারের পুরুষ সদস্যদের অনুমতি ছাড়া তারা অনেক সময়ই আইনের আশ্রয় নিতে পারত না। সামাজিক কুসংস্কার, সম্মানের ভয় কিংবা প্রতিহিংসার আশঙ্কায় নারীরা চুপ থাকতেই বাধ্য হতো। কিন্তু প্রকল্পটি নিয়মিত প্রশিক্ষণ, আইনি সচেতনতা কার্যক্রম এবং ইউনিয়ন পরিষদের নারী সদস্যদের সক্রিয় সম্পৃক্ততার মাধ্যমে এই পরিস্থিতিতে পরিবর্তন এনেছে। এখন অনেক নারী মুধু নিজেদের মামলা করছে না বরং অন্য নারীদেরও অনুপ্রাণিত করছে। এতে নারীর নেতৃত্ব, আত্মবিশ্বাস এবং সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। দীর্ঘ মেয়াদে এই প্রবণতা গ্রামীণ সমাজে জেন্ডার সমতা ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। গ্রাম আদালত আইন নারীর স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিরোধীয় বিষয় নিষ্পত্তিতে গ্রাম আদালত গঠনের ক্ষেত্রে নারী সদস্য মনোনয়নের বাধ্যবাধকতার বিধান রয়েছে।
গ্রাম আদালত আইন, ২০০৬ অনুযায়ী, ‘কোনো স্ত্রী কর্তৃক তাহার বকেয়া ভরণপোষণ আদায়ের মামলা’ গ্রাম আদালতের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করার বিধান রয়েছে। ফলে একজন বিবাহিত এবং ক্ষেত্রবিশেষে একজন তালাকপ্রাপ্ত নারী (স্ত্রী) জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে তার বকেয়া ভরণপোষণ/খোরপোশ আদায়ের জন্য এখন থেকে ইউনিয়ন পরিষদে গ্রাম আদালত ব্যবস্থার মাধ্যমে মামলা করতে পারবে। ভরণপোষণ বলতে থাকা, খাওয়া, পরা ইত্যাদি ব্যক্তিগত জীবনের সব অপরিহার্যতা পূরণ বোঝায় এবং এই পূরণ হতে হবে সংশ্লিষ্ট পক্ষদের সামাজিক অবস্থানুসারে। স্ত্রীর ভরণপোষণ/খোরপোশের পূর্ণ দায়িত্ব স্বামীর। অন্য কোনো পারিবারিক বিষয় যেমন তালাক, সন্তানের অভিভাবকত্ব ইত্যাদি বিষয়ে গ্রাম আদালত কোনোরূপ সিদ্ধান্ত দিতে পারবে না। নারীর স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিরোধীয় বিষয় নিষ্পত্তিতে গ্রাম আদালত গঠনের বিধান রয়েছে, যে অধিকারের বিষয়ে অনেক ক্ষেত্রেই কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। অনেক মানুষ এখনো জানেন না গ্রাম আদালত কীভাবে কাজ করে। সামাজিক কুসংস্কার এবং পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা নারীর অংশগ্রহণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। ইউনিয়ন পর্যায়ে পরিকাঠামো ও জনবল সীমিত। তাছাড়া বিদ্যমান আইনগুলোর কিছু জায়গায় সংশোধন প্রয়োজন, যাতে গ্রাম আদালতের কার্যক্রম আরো কার্যকর হয়। তবে ইতিবাচক দিক হলো এসব চ্যালেঞ্জ সরকার, স্থানীয় নেতৃত্ব, উন্নয়ন সহযোগী এবং নাগরিক সমাজের সমন্বিত প্রচেষ্টায় মোকাবিলা করা সম্ভব।
গ্রাম আদালত শক্তিশালীকরণের তৃতীয় পর্যায় বাংলাদেশের ন্যায়বিচার ব্যবস্থার নতুন দর্শন। যদি এটি সফলভাবে বাস্তবায়িত হয়, তবে দেশের বিচারব্যবস্থার ওপর চাপ অনেক কমে যাবে। উচ্চ আদালতে মামলা কমে আসবে, ফলে বিচারকরা জটিল মামলা নিষ্পত্তিতে অধিকতর সময় দিতে পারবেন। সবচেয়ে বড় কথা, গ্রামীণ জনগণ আর ন্যায়বিচারকে দূরের বিষয় মনে করবেন না। নারীরা হবে সমান অংশীদার, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী হবে অন্তর্ভুক্ত আর সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে আইনের শাসন।

এরিস্টটলের শিক্ষা আজও ঢাকা ও দিল্লির মতোই প্রযোজ্য, যেমনটি ছিল এথেন্সে—রাজনীতি নাগরিকের আত্মার প্রতিফলন। যখন সমাজ নৈতিকতার দাবি ত্যাগ করে, তখন অবশ্যম্ভাবীভাবে তারা অদূরদর্শী নেতৃত্বের অধীনে পড়ে।
৪ ঘণ্টা আগে
১২ দিনের তীব্র লড়াইয়ের পর ২০২৫ সালের ২৪ জুন ইসরাইল আর ইরান অস্ত্রবিরতিতে রাজি হয়। কিন্তু এই অঞ্চলের যে গভীর উত্তেজনা, এই চুক্তি সেটা দূর করতে পারেনি। সপ্তাহ কয়েক পরে দুপক্ষই তাদের সামরিক ও রাজনৈতিক পরিকল্পনা আরো চাঙা করেছে এবং নতুন লড়াইয়ের কথা মাথায় রেখেছে।
৪ ঘণ্টা আগে
আমরা যেন একটা ঐতিহাসিক মুহূর্ত অতিক্রম করছি; দিগন্তে ফুটে উঠেছে একটি আলোর রেখা। অতিকথন নয়, বাস্তবায়নেরই অঙ্গীকার যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। সেটাই মনে হলো ড. প্রফেসর ইউনূসের ভাষণ শুনতে শুনতে। মনে হচ্ছিল অতীতের কায়েমি স্বার্থের নিগড়ে বাঁধা পুরোনো রাষ্ট্রব্যবস্থার ধ্বংসস্তূপে
৫ ঘণ্টা আগে
আজকের দিনে ডায়াবেটিস নিয়ে কথা বললে আমরা প্রায়ই শুনি—‘অতিরিক্ত খাওয়া’, ‘কম ব্যায়াম’, ‘অতিরিক্ত ওজন’ বা ‘জীবনযাত্রার অনিয়ম’। গণমাধ্যমে নিয়মিত এভাবেই ব্যক্তিগত অভ্যাসকেই বেশি দায়ী করা হয়।
১ দিন আগে