এআই দিয়ে রাজনৈতিক প্রচারণার ভিডিও বানাচ্ছে কারা, শঙ্কা কোথায়?

আমার দেশ অনলাইন
প্রকাশ : ২৭ জুলাই ২০২৫, ১৪: ১৯
এআই দিয়ে বানানো ৭০টি ভিডিও বিশ্লেষণ করেছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান ডিসমিসল্যাব

ডেস্কের সামনে মাইক হাতে দাঁড়িয়ে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন মাইলস্টোন স্কুলে বিমান দুর্ঘটনায় নিহত শিক্ষক মাহরীন চৌধুরী, কিছুদিন আগে এমন একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছিল সামাজিক মাধ্যমে। আর তা শেয়ার করতে দেখা গেছে অনেককে, যাদের মধ্যে ছিলেন আইনবিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের মতো ব্যক্তিও। তবে ছবিটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই দিয়ে নির্মিত হওয়ার বিষয়টি বুঝতে পেরে পরবর্তী সময়ে তা সরিয়েও ফেলেন তিনি।

বিজ্ঞাপন

দেখতে ও শুনতে অনেকটাই বাস্তবের মতো হওয়ায় অনেকের জন্যেই এই ধরনের ভিডিওগুলো শনাক্ত করা কঠিন। আর সেই সুযোগটাই নিচ্ছে অনেকে, যাদের মধ্যে আছে রাজনৈতিক দলগুলোও। নির্বাচনের সময় ঘোষণার আগেই নিজ দলের প্রচারণা এবং অন্য দল ও দলের নেতাদের হেয় করতে তৈরি করা হচ্ছে নানা ধরনের এআই ভিডিও। তারপর ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে সামাজিক মাধ্যমে। এমন ৭০টি রাজনৈতিক ভিডিও বিশ্লেষণ করেছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান ডিসমিসল্যাব।

প্রতিষ্ঠানটির গবেষণায় দেখা গেছে, জামায়াতে ইসলামীর সমর্থকরা সর্বপ্রথম এ ধরনের প্রচারণা শুরু করে। পরে তাতে যোগ দেয় অন্য রাজনৈতিক দলগুলোও। এসব ভিডিও তৈরি করতে সময় যেমন কম লাগে, তেমনি নির্বাচনি প্রচারণায় বরাদ্দের তুলনায় খরচও হয় খুবই সামান্য। সে তুলনায় এগুলোর প্রভাব ও বিস্তৃতি অনেক বেশি।

তবে বাংলাদেশে যেভাবে এআই ভিডিওর বিকাশ ঘটেছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শেখানো যায়নি এসব মাধ্যমের ব্যবহার। তার ওপর যদি নির্বাচনি এজেন্ডা ঠিক করে, এভাবে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হয় তবে তা সামাল দেয়া কঠিন হবে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন সংশ্লিষ্টরা।

কীভাবে বানানো হয় এসব ভিডিও

সিঁদুর পরা এক নারী কিংবা রিকশার ওপর বসে থাকা দাঁড়িওয়ালা একজন চালক কোনো একটি দলের পক্ষে ভোট চাইছেন- সামাজিক মাধ্যমে এমন কিছু ভিডিও নিশ্চয়ই চোখে পড়েছে?

খেয়াল করলে দেখবেন এই ধরনের প্রায় সব ভিডিওর দৈর্ঘ্যই হয় সর্বোচ্চ আট সেকেন্ডের। কারণ এসব ভিডিওর প্রায় সবই তৈরি করা হয়েছে গুগলের ভিও টুল দিয়ে। এই টুলস লিখে কিংবা বলে দেয়া নির্দেশনা অনুযায়ী ভিডিও তৈরি করতে পারে দুই থেকে তিন মিনিটের মধ্যে।

এআই বিষয়ক প্রশিক্ষণ দেয়া প্ল্যাটফর্ম লার্নিং বাংলাদেশের ইন্সট্রাক্টর সাব্বির আহমেদ জানান, দিন যাওয়ার সাথে সাথে এআই দিয়ে নির্মিত ভিডিওগুলো এতটাই বাস্তব হয়ে উঠছে যে অভিজ্ঞ চোখেও অনেক সময় তা ধরা কঠিন হয়ে উঠছে। আপনি যদি ভিডিওর জন্য ভালোভাবে প্রম্পট (নির্দেশনা) দেন তাহলে সেই ভিডিওর ক্যারেক্টার, তার চেহারার গঠন, কী পরে আছে, ভিডিওতে কতজন মানুষ আছে- তারা কোন ক্লাসের, তাদের হাতে কী আছে- তারা গুলশান না গ্রামে আছে এসবই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

আর এসব করতে প্রয়োজন হয় না খুব একটা অভিজ্ঞতা কিংবা দামি ডিভাইস। আগে যেমন কোনো ভিডিও বানাতে দামি ডিভাইস লাগতো, সেখানে এখন এক স্মার্টফোনে দিয়েই বানানো যাচ্ছে এমন সব ভিডিও। খরচও হয় খুবই সামান্য। মাত্র হাজার দুয়েক টাকায় কেনা যায় হাজার ক্রেডিট, যা দিয়ে বানানো যায় ৫০টি ভিডিও। কিছু ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ করলে বিনামূল্যেই এসব টুলসে এক্সেস করা যায়।

ইন্সট্রাক্টর সাব্বির আহমেদ একই টুল দিয়ে একটি ভিডিও বানিয়ে দেখান। নির্দেশনায় বলা হয়েছিল, বাঁশ মার্কা চাই, মগেরগঞ্জ এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে আমরা বাঁশ মার্কার পাশেই আছি।

মাত্র ১ মিনিট ১৫ সেকেন্ডের মাথায় হাজির হয় ভিডিওটি। দেখতে পারেন এখানে-

এআই ভিডিও নিয়ে শঙ্কার জায়গা

বুম হাতে একজন নারী সাংবাদিক সিঁদুর-শাড়ি পরিহিত হেঁটে আসা আরেক নারীকে প্রশ্ন করছেন ‘এবারের ভোটটা কাকে দেবেন’?

উত্তরে ওই নারী বলছেন, ‘সব দলকেইতো দেখা হয়েছে, জামায়াতকে এবার সুযোগ দেয়া উচিত।’ এআই দিয়ে তৈরি এই ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।

এমন আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায় রিকশার ওপর বসে থাকা একজন চালক ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে বলছেন, ‘আমার মতো গরিবের কথা কেউ শোনে না ভাই। ওরা শুধু ভোটের সময় আসে আর যায় পাঁচ বছর। এবার আমি নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিয়েছি, জামায়াতের দাঁড়িপাল্লায় ভোট দেবো।’

ডিসমিসল্যাবের গবেষণা অনুযায়ী, এই দুটি ভিডিওই বানিয়েছে জামায়াতে ইসলামীর সমর্থকরা। তবে এআই দিয়ে ভিডিও তৈরির ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই কোনো দলই।

জামায়াতে ইসলামীর সমর্থকরা এই ধরনের ভিডিও বানানো শুরু করলেও পরে তাতে যোগ দেয়, বিএনপি, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলনসহ অন্যান্য দলের সমর্থকরাও।

একটি ভিডিওতে দেখা যায়, দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন শিক্ষার্থীকে একইভাবে একজন পুরুষ সাংবাদিক এসে প্রশ্ন করছেন যে তারা কোথায় ভোট দেবেন। উত্তরে তাদের বলতে শোনা যায়, ‘আমরা ধানের শীষে ভোট দিতে চাই’।

আরেক ভিডিওতে দেখা যায়, জড়ো হয়ে থাকা কিছু মানুষের সামনে একজন তরুণ দাঁড়িয়ে বলছেন, ‘তারুণ্যের প্রতীক শাপলা, এটা একটা শক্তির নাম’।

সময় যাওয়ার সাথে সাথে এআই ভিডিওগুলো এতটাই নিখুঁত হচ্ছে যে সাধারণ মানুষের পক্ষে তো বটেই উচ্চশিক্ষিত অনেকের কাছেও তা বোঝা বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আবারও যদি আইন উপদেষ্টার উদাহরণেই ফিরে যাওয়া হয়, দেখা যাবে একাধিকবার নিজের সামাজিক মাধ্যম থেকে এআই দিয়ে তৈরি ভিডিও তিনি শেয়ার করেছেন।

কখনো সেটা বন্যার পানিতে অর্ধেক ডুবে থাকা শিশুর ছবি কিংবা একটি পত্রিকার ভুয়া ফেসবুক পাতা থেকে ট্রাম্পের মুখে প্রধান উপদেষ্টার প্রশংসার ভিডিও। যদিও এ নিয়ে মন্তব্য চাইলে তাৎক্ষণিকভাবে উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সাইফুল আলম চৌধুরী বলেন, ‘আমরা শিক্ষিত বা স্বল্প শিক্ষিত যে স্তরেরই হই, একটা ফেইক ভিডিওকে আমরা তখনই লুফে নিচ্ছি যখন সেটা আমার কিংবা আমার দলের মতাদর্শের সাথে যাচ্ছে আর বিরোধীদের বিরুদ্ধে যাচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘আবার ভুল হলে নামিয়ে ফেলছি, কিন্তু নামিয়ে ফেলার চর্চা তার মধ্যেই একটা ডিজাস্টার (ক্ষতি) হয়ে গেল।’

ডিসমিসল্যাবের বিশ্লেষণ করা ভিডিওগুলো দেখা হয়েছে ২ কোটি ৩০ লাখের বেশি বার, আর তাতে রিঅ্যাকশন পড়েছে ১০ লাখের বেশি। বিশ্লেষকরা বলছেন, নিজেদের পক্ষে সমর্থন আদায়ের পাশাপাশি অন্যদের মানহানিও থাকে এ ধরনের ভিডিওর টার্গেট।

সাইফুল আলম চৌধুরীর মতে, বর্তমানে ‘ডিপফেক বা তথ্যবিকৃতির’ যে চর্চা দেখা যাচ্ছে তা খুবই প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। এরপরের পর্যায় আসবে, নির্বাচনি প্রচার-প্রচারণা শুরু হলে। আর শেষ পর্যায় দেখা যাবে ভোটের কিছুদিন আগে।

আর বাংলাদেশে যদি ৫০ শতাংশও স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয় তাহলে কেবল ‘ইনফরমেশন ডিজঅর্ডারের কারণে দাঙ্গা লেগে যেতে পারে’ বলেও শঙ্কা প্রকাশ করেন এই বিশ্লেষক, যা কি না এর আগে ইন্দোনেশিয়া আর ব্রাজিলে দেখা গিয়েছিল।

বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রযুক্তির যেভাবে বিকাশ ঘটেছে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে দিয়ে জনসাধারণের সচেতনতা তৈরি হয়নি। ফলে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নির্দিষ্ট এজেন্ডা মাথায় রেখে যদি ভিডিও তৈরি করে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হয়, তবে জটিল পরিস্থিতির উদ্ভব হবে।

অন্য সময়ে অনেক খরচ ও প্রচারণা করেও যাদের পর্যন্ত পৌঁছানো যেত না, এসব কন্টেন্ট দিয়ে মুহূর্তেই তাদের কাছে পৌঁছানোর সুযোগ তৈরি হয় যার থেকে তৈরি হতে পারে বিশৃঙ্খলা। এসব কিছু মাথায় রেখেই ক্ষতি কমাতে নির্বাচনি প্রচার-প্রচারণায় এআই ব্যবহারের নীতিমালা যুক্ত করার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশ্লেষকরা। পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদে গণমাধ্যম ও প্রযুক্তি সম্পর্কে ধারণা তৈরির কোনো বিকল্প নেই বলেও মত তাদের।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

বিষয়:

এআই
এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত