আলজাজিরার বিশ্লেষণ

রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের প্রত্যাবর্তন সুদূরপরাহত

আমার দেশ ডেস্ক
প্রকাশ : ২৮ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯: ০৮
আপডেট : ২৮ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯: ১০

শেখ হাসিনার পতনের পাঁচ মাস পর তার দল আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনগুলো এখন বিভক্ত। দলের পলাতক বা আত্মগোপনে থাকা নেতারা ক্ষমা চাইতে রাজি না হলেও তৃণমূলের পরিস্থিতি ভিন্ন। তাদের কেউ ভীত, কেউ আত্মগোপনে, আবার কেউ ভিন্ন পরিচয়ে শুরু করেছেন নতুন জীবন। বাদ দিয়েছেন রাজনীতিতে ফেরার চিন্তা।

এর মধ্যে বিএনপি ও জামায়াত গুম ও খুনের সঙ্গে জড়িত আওয়ামী লীগ নেতাদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার। অন্যদিকে ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া অংশ তো এক কাঠি সরেস। তারা আওয়ামী লীগের নেতাদের বিচার তো চায়ই, পাশাপাশি নির্বাচনে আসতে দিতে চায় না দলটিকে। এমন পরিস্থিতিতে ৭৫ বছরের পুরোনো আওয়ামী লীগের প্রত্যাবর্তন সুদূর পরাহত বলেই মনে হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

২০২৪ সালের ১৬ জুলাই পুলিশের গুলিতে রংপুরে নিহত হন আবু সাঈদ। সেদিনের এক ভিডিওতে দেখা যায়, ঢাকায় তৎকালীন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রহমান স্থানীয় এক কবির কবিতা আবৃত্তি শোনার পর বলে উঠছেন, ‘চমৎকার’। এমন সময় খবর এলো আবু সাঈদ নিহত হয়েছেন। এ খবরে তাকে উদ্বিগ্ন মনে হয়নি। তিনি ভাবলেশহীনভাবে বললেন, কিছুই হবে না। আমাদের নেতা (হাসিনা) সবকিছু সামলে নেবেন।

এ ঘটনার কয়েকদিন পর হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। এর আগে আন্দোলন দমাতে সরকার হত্যা করে ৮৩৪ জনকে। গত বছরের ১ জুলাই শুরু হওয়া আন্দোলন শেষ হয় ৫ আগস্ট সামরিক হেলিকপ্টারে ভারতে বোন রেহানাসহ হাসিনার পলায়নের মাধ্যমে। নারী ও শিশুসহ এ আন্দোলনে আহত হয়েছেন ২০ হাজারের বেশি মানুষ।

এ আন্দোলন হাসিনার ১৬ বছরের একক আধিপত্যকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে। এখন তার দল সংগ্রাম করছে বাংলাদেশে টিকে থাকার। দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা তাদের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাইতে নারাজ। তবে মধ্যপর্যায়ের নেতা ও সমর্থকরা মনে করছেন, কোথায় ভুল হয়েছে সেটি আওয়ামী লীগের খুঁজে বের করা দরকার।

আওয়ামী লীগকে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের ভুক্তভোগী দাবি করে দলের জয়েন্ট সেক্রেটারি আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, আমরা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের শিকার। আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগ নেতা যদিও কারো নাম উল্লেখ করেননি।

তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, নেতাদের এ ধরনের দাবির অর্থ হচ্ছে, ব্যর্থতাকে অস্বীকার এবং জনসাধারণের অসন্তোষ বোঝার অক্ষমতা।

এদিকে গণঅভ্যুত্থানে খুনের ঘটনায় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের তৃণমূলের অধিকাংশ নেতা আত্মগোপনে অথবা আইনি পরিণতির ভয়ে ভীত। তারা আওয়ামী লীগের রূপান্তর নিয়ে পরিতাপ করছেন।

ছাত্রলীগের খুলনার এক শীর্ষনেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, যখন হাসিনার পালানোর নাটকীয় খবর টিভিতে দেখাচ্ছিল তখনও আমি আমার কর্মীদের নিয়ে খুলনার রাস্তায় ছিলাম। আমি আমার নেতা স্থানীয় এমপিকে কল দেওয়ার চেষ্টা করি। তখন দেখি, তার মোবাইল বন্ধ। সে মুহূর্তে আমি প্রতারিত বোধ করছিলাম।

২০২৪ সালের ২৩ অক্টোবর অন্তর্বর্তী সরকার ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করে। এরপর নিরাপদ জায়গায় যেতে ভয়ংকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন ছাত্রলীগের এক সময়কার ক্ষমতাধর এ নেতা। প্রথমে তিনি পালিয়ে আশ্রয় নেন গোপালগঞ্জে। পরে তিনি মিথ্যা পরিচয় নিয়ে স্থায়ী হন ঢাকায়। তিনি বলেন, আমি আমার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট, ফোন নম্বরসহ সবকিছুই বদলে ফেলেছি। ঢাকায় ছোট্ট একটা ব্যবসা শুরু করেছি। দল আমাদের পুরোপুরি পরিত্যাগ করেছে। আমি কখনো আর রাজনীতিতে ফিরব না।

দেশজুড়ে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের তৃণমূলের বহু নেতা এ ধরনের অনুভূতির কথা জানিয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে অনেকে একেবারে চুপ হয়ে গেছেন। তবে কৃষক লীগের সহ-সম্পাদক সামিউল বশির সরব। তিনি বলেন, ত্যাগী নেতাদের বহুদিন থেকে উপেক্ষা করা হয়েছে। ২০১৪ সাল থেকে সুবিধাবাদী ও স্থানীয় এমপিদের পরিবারের সদস্যরা তৃণমূলে প্রভাব বিস্তার করেছে, যার ফলে এ পরিণতি।

চিকিৎসকদের আওয়ামী লীগপন্থি সংগঠনের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নেতা একই ধরনের হতাশার কথা বলেন। তিনি বলেন, আমাদের দল সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ওপর অত্যধিক নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। আমি অনেক শীর্ষনেতাকে দেখেছি যে, সিদ্ধান্ত কীভাবে নেওয়া হয় বা কারা তা নিচ্ছে তা সম্পর্কে তারা অবগত ছিলেন না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গণতান্ত্রিক অনুশীলনের অভাবও দলটিকে বিশৃঙ্খলার মধ্যে ফেলেছে।

‘জুলাই আন্দোলনে’ হত্যাকাণ্ড চালালেও আওয়ামী লীগ এখনো এজন্য আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চায়নি। পরিবর্তে দলটি বারবার আন্দোলনকে প্রত্যাখ্যান করেছে। যেমন যুবলীগ তাদের ১০ জানুয়ারির একটি প্রেস রিলিজে বলেছে, এটি একটি ‘সন্ত্রাসী বিদ্রোহ’, যা দেশকে ‘পাকিস্তানের আদর্শের’ দিকে ঠেলে দেওয়ার লক্ষ্যে সংগঠিত হয়।

নাছিম আওয়ামী লীগের পতনের পেছনে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরকে দায়ী করেন। তিনি জানান, কোটাবিরোধী আন্দোলনের আড়ালে শিক্ষার্থীদের ‘বিভ্রান্ত’ করার পেছনে ছিল ছাত্রশিবির।

আওয়ামী লীগ আমলে জামায়াতের পাঁচ শীর্ষনেতা এবং প্রধান বিরোধী দল বিএনপির এক সিনিয়র নেতাকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। বিএনপি ও জামায়াত উভয়ই হাসিনা সরকারের অধীনে ব্যাপকভাবে গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ কঠোর দমনপীড়নের মুখোমুখি হয়।

এ ব্যাপারে নাছিম জানান, তার দল ‘কৌশলগত ভুল’ করেছে। কিন্তু এ ব্যর্থতার জন্য প্রাথমিকভাবে ‘গোয়েন্দা ত্রুটিকে’ দায়ী করেন তিনি।

এদিকে হাসিনার ঘনিষ্ঠ সহযোগী এবং সরকার অপসারণ পর্যন্ত ১১ বছর ধরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা আসাদুজ্জামান খান কামাল ভারতীয় সংবাদপত্র ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের সঙ্গে সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে দাবি করেন, আওয়ামী লীগ ‘ইসলামি সন্ত্রাসী এবং সেনাবাহিনী’ দ্বারা পরিচালিত ‘যৌথ ক্যুর’ শিকার হয়েছে।

যদিও এ ব্যাপারে দলের অন্যরা একমত নন। সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তানজিম আহমদ সোহেল তাজ দলের মধ্যে জবাবদিহির অভাবকে সরকার পতনের কারণ হিসেবে দায়ী করেছেন। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশের মানুষের কাছে অন্যায়, নিপীড়ন, দুর্নীতি, কোটি কোটি টাকা লুণ্ঠন ও পাচারের জন্য ক্ষমা চাইতে হবে। আমি এখনো কোনো নেতাকে আত্মোপলব্ধি, আত্মসমালোচনা বা অপরাধ স্বীকার করতে দেখিনি।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক আল মাসুদ হাসানুজ্জামান এ ব্যাপারে বলেন, পার্টির কট্টরপন্থী অবস্থান এবং সিদ্ধান্ত জনগণের ক্ষোভকে উসকে দিয়েছিল, বিদ্রোহের সাফল্যের পথ প্রশস্ত করেছিল।

নির্বাসন বা প্রত্যাবর্তনের অভিজ্ঞতা হাসিনার কাছে নতুন নয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষক হাসানুজ্জামান বলেন, ‘এবার অবশ্য পরিস্থিতি ভিন্ন। নেতা হিসেবে শেখ হাসিনার ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ণ হয়েছে। শেখ হাসিনাকে ছাড়া দল পুনর্গঠন করা চ্যালেঞ্জিং হবে এবং অভ্যন্তরীণ বিভক্তির সম্ভাবনা রয়েছে।

বিএনপি ও জামায়াত উভয়েই গত জুলাই-আগস্টে হত্যার সঙ্গে জড়িতদের বিচার চায়। অন্যদিকে ছাত্ররা আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক বেশি আপসহীন অবস্থান নিয়েছে। সম্প্রতি এক পথসভায় অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা ও ছাত্র আন্দোলনের একজন প্রধান নেতা মাহফুজ আলম বলেন, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হবে না। আমাদের ফোকাসের মধ্যে রয়েছে খুন, গুম ও ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচার করা এবং সংস্কার বাস্তবায়ন এবং বাংলাদেশপন্থি সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করা।

আওয়ামী লীগের দৃষ্টিকোণ থেকে নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে বলে মনে করেন হাসানুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ যদি নির্বাচনে অংশ নিতে পারে, তাহলে দলটির ফিরে আসার জায়গা তৈরি হবে। তবু, নেতৃত্ব, সংগঠন এবং তৃণমূল সংযোগের মাধ্যমে জনগণের আস্থা পুনর্গঠন ছাড়া আওয়ামী লীগের জন্য রাজনৈতিক পুনরুত্থান খুবই কঠিন।

রাজনীতিতে ফেরার জন্য আওয়ামী লীগের চারটি শর্ত পূরণ করতে হবে বলে জানিয়েছেন বিশ্লেষক অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তার মতে, ১৬ বছরের ক্ষমতায় থাকাকালে সংঘটিত অপরাধের জন্য ক্ষমা চাইতে হবে, বিশেষ করে ২০২৪ সালের অভ্যুত্থানের বিষয়ে। তার বর্তমান মতাদর্শ পরিত্যাগ। হাসিনার পরিবারের কোনো সদস্য যাতে আবার দলকে নেতৃত্ব দিতে না পারে তা নিশ্চিত করা। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধসহ জঘন্য অপরাধ সংঘটনের জন্য বিচারের সম্মুখীন হওয়া।

এ বিশ্লেষকের মতে, শেখ হাসিনাসহ জুলাইয়ের অভ্যুত্থানের সময় নৃশংসতার জন্য যারা সরাসরি দায়ী তাদের বিচারের মুখোমুখি হতে হবে। শর্তগুলো পূরণ হলেই তাদের প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে আলোচনা হতে পারে।

আওয়ামী লীগের অনেক কর্মী এখনো হাসিনার প্রতি আস্থা রেখেছেন। তবে তারা ব্যক্তিগতভাবে তার পরিবারের দ্বারা ক্ষমতার অপব্যবহারের সমালোচনাও করেন। এর মধ্যে দেশের বাইরে অবস্থান করা বেশ কিছু আওয়ামী লীগের নেতা টকশোতে অংশ নিয়ে দলকে পুনরায় সংগঠিত করার আহ্বান জানাচ্ছেন। তাদের দাবি ইউনূস সরকার ‘ব্যর্থ হওয়ার পথে’।

তবে এ গল্প দলীয় কর্মীদের কাছে খুব একটা গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না। তাদের দাবি নির্বাসিত নেতাদের পক্ষে বিদেশে থেকে কথা বলা সহজ। দেশের পরিস্থিতি ভিন্ন। এখানে নেতাকর্মীদের লুকিয়ে থাকতে হচ্ছে। খুলনার সাবেক ওই ছাত্রনেতার মতো অনেকেই নিজের পরিচয় প্রকাশ্যে আনতে ভয় পাচ্ছেন। এতে একটি বিষয় পরিষ্কার। সেটি হচ্ছে, আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তন সুদূর পরাহত।

এমবি

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত